যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মন্তব্য দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা

সম্প্রতি  “যুদ্ধ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলবে না” শীর্ষক উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের নামে দেশের গণমাধ্যমগুলোতে কিছু প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। 

গণমাধ্যমে প্রকাশিত এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন ইনকিলাব, মানবজমিন, নিউজ২৪, যমুনা টিভি, ঢাকা টাইমস২৪, এসএ টিভি

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের মন্তব্য দাবি করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদটি সঠিক নয় বরং বরং পররাষ্ট্রমন্ত্রীর উপস্থিতিতে এক অনুষ্ঠানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক মীজানুর রহমানের করা একটি মন্তব্যকে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর করা মন্তব্য দাবিতে গণমাধ্যমে প্রচারিত হয়েছে।

কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ‘Atv news’ নামে একটি ফেসবুক পেইজে ২৬ অক্টোবর “জাতিসংঘের  আঙিনায়  শেখ হাসিনা” (আর্কাইভ) শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি লাইভ ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রায় ৪১ মিনিটের ভিডিওটির শুরুতেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জাতিসংঘের ব্যর্থতা, সফলতায় নেতত্বস্থানীয় ও সদস্যগুলোর ভূমিকা, দ্বিধা-দ্বন্ধ নিয়ে আলোচনা শুরু করেন। পাশাপাশি জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্যপদ প্রাপ্তির ইতিহাসও তুলে ধরেন তিনি। এছাড়া বিশ্ব শান্তি রক্ষায় বাংলাদেশের ভূমিকা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রচেষ্টা, জঙ্গিবাদ ও করোনা মোকাবিলা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর অবস্থান সম্পর্কেও আলোচনা করেন তিনি।

আলোচনার এক পর্যায়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন জাতিসংঘে কোনো বৈষম্য নেই উল্লেখ করে বলেন, জাতিসংঘে সাড়ে ১৬ কোটি লোকের বাংলাদেশ, আমেরিকার ৩০ মিলিয়ন লোকের আমেরিকা আর ৮ হাজার লোকের নাউরুর সবার কিন্তু একটি ভোট। ঐখানে কোনো রকম বৈষম্য নেই। তবে সিকিউরিটি কাউন্সিলে কোনো ডেমোক্রেসি নাই। আজকে সময়ের দাবি হলো, সিকিউরিটি কাউন্সিলে কিছু রিফর্ম করা।

আব্দুল মোমেন ইউক্রেন যুদ্ধ প্রসঙ্গে বলেন, কেউ কেউ জাতিসংঘের বাইরে গিয়ে অনেক রকম সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন। যার ফলে আমরা বিপদে আছি। অনুষ্ঠানে উপস্থিত জবির সাবেক ভিসি মীজানুর রহমানকে দেখিয়ে তিনি বলেন, বিভিন্ন যুদ্ধ বিগ্রহ লেগেই আছে। আমরা দেখলাম গালফ ওয়ার, ইরাক ওয়ার, ইরাক-ইরান ওয়ার, সোমালিয়ান ওয়ার…কিন্তু এবারের যুদ্ধটা আমাদের জন্য বেশ অসুবিধা করেছে। বাংলাদেশের জোর দাবি, যুদ্ধ বন্ধ হোক৷ 

এছাড়া গুম প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আমাদের দেশে কিছু কিছু মানুষ নিখোঁজ হয়। আমাদের দেশের লোকসংখ্যা আমেরিকার লোকসংখ্যার অর্ধেক৷ তাদের নিখোঁজ হয় কয়েক লক্ষ লোক আর আমাদের নাকি ৭৬ নিখোঁজ হয়েছে। এর মধ্যে আটজনকে আমরা পেয়েছিও।  কবে হয়েছে? সেই ২০০৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত। এসময় তিনি আমেরিকার সাথে বাংলাদেশের বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয় নিয়েও তুলনামূলক আলোচনা করেন।

পুরো ভিডিওটিতে আমেরিকাকে নিয়ে এসবের বাইরে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনকে আর কোনো মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে কোনো মন্তব্য তিনি করেননি। 

এছাড়া বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অফিসিয়াল ফেসবুক পেইজে একইদিনে “পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে কিছু মিডিয়ায় অসত্য সংবাদ/টিভি স্ক্রল প্রচারের প্রতিবাদ” (আর্কাইভ) শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ  বিজ্ঞপ্তি খুঁজে পাওয়া যায়।

এই সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে জানা যায়, ঢাকা, কিছু মিডিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেন, এমপিকে ভুলভাবে উদ্ধৃত করে অসত্য সংবাদ/টিভি স্ক্রল প্রচার করেছে। 

এগুলোর মধ্যে আছে, “যুদ্ধ ছাড়া আমেরিকার অর্থনীতি চলবেনা”, “ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধ হলে তাইওয়ানে যাবে আমেরিকা”, “যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধপ্রিয় দেশ, যুদ্ধ ছাড়া দেশটির অর্থনীতি সচল থাকে না”, যুদ্ধেই সচল থাকে যুদ্ধপ্রিয় আমেরিকার অর্থনীতি”, “যুদ্ধ পরিস্থিতি তৈরি করাই হলো যুক্তরাষ্ট্রের মূলকাজ”। কিন্তু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের নামে এধরণের সংবাদ শিরোনাম দিয়ে/টিভি স্ক্রল ভিত্তিহীন। 

পরবর্তীতে মূলধারার জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠে একইদিনে “যুদ্ধ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলবে না : মীজানুর রহমান” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

এই প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, গত ২৬ অক্টোবর বুধবার রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম আয়োজিত ‘জাতিসংঘের আঙিনায় শেখ হাসিনা’ শীর্ষক সেমিনার আয়োজন করা হয়। 

এই সেমিনারে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যুদ্ধের অর্থনীতি। যুদ্ধ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলবে না। এজন্য বিশ্বের কোথাও না কোথাও তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ চালিয়ে যায়।

অর্থাৎ, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে প্রচারিত সংবাদের বক্তব্যটি প্রকৃতপক্ষে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মীজানুর রহমান দিয়েছিলেন। 

মূলত, গত ২৬ অক্টোবর রাজধানীর জাতীয় প্রেস ক্লাবে বাংলাদেশ প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরাম আয়োজিত ‘জাতিসংঘের আঙিনায় শেখ হাসিনা’ শীর্ষক সেমিনার আয়োজন করা হয়। এই সেমিনারে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে মন্তব্য করতে গিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য ও প্রগতিশীল কলামিস্ট ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মীজানুর রহমান বলেন, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি যুদ্ধের অর্থনীতি। যুদ্ধ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি চলবে না। এজন্য বিশ্বের কোথাও না কোথাও তারা যুদ্ধ-বিগ্রহ চালিয়ে যায়। অধ্যাপক মীজানুর রহমানের এই বক্তব্যটিই পরবর্তীতে বাংলাদেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে এই সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের নামে প্রচার করা হয়। কিন্তু ড. এ কে আব্দুল মোমেনের প্রায় ৪১ মিনিটের পুরো বক্তব্যে কোথাও তাকে যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি নিয়ে মন্তব্য করতে শোনা যায়নি। 

সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনীতি সম্পর্কে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের মন্তব্য দাবি করে গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img