ঢাবি ছাত্রীকে গণধর্ষণের দৃশ্য দাবিতে চট্টগ্রামের ভিন্ন ঘটনার ভিডিও প্রচার

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “এই মুহূর্তে মধ্যে রাতে রাজধানীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর রাস্তার পাশে ফেলে গেছে দুর্বৃত্তরা।”

অর্থাৎ, প্রচারিত ভিডিওতে দেখানো নারীকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী বলে দাবি করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে তাকে গণধর্ষণ করে রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি তরুণীকে গণধর্ষণ করে রাস্তার পাশে ফেলে যাওয়ার দৃশ্যের নয়। প্রকৃতপক্ষে, গত ১৩ সেপ্টেম্বর সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে নওরিন সুলতানা নামের ওই তরুণী তার আপন মামাসহ কয়েকজনের হামলায় আহত হন, ভিডিওতে সেই ঘটনার দৃশ্যই প্রদর্শিত হয়েছে। এছাড়া, তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী নন; চট্টগ্রামের কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন মহিলা কলেজের ছাত্রী।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ‘ভোরের আওয়াজ২৪’ নামের একটি প্ল্যাটফর্মে ‘চট্টগ্রামে শিক্ষার্থী নওরিন ও পরিবারের ওপর নৃশংস সশস্ত্র হামলা: গ্রেফতার দাবি, চান্দগাঁও পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ক্ষোভ’ শিরোনামে গত ২২ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে কয়েকটি ছবির সংযুক্তি পাওয়া যায়, যার মধ্যে একটির সঙ্গে আলোচিত ভিডিওতে প্রদর্শিত আহত নারীর মিল পাওয়া গেছে।

Comparison : Rumor Scanner

প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘চট্টগ্রামের চান্দগাঁও থানার ৪নং ওয়ার্ডে এক ছাত্রী নওরিন সুলতানা (২৪) ও তার পরিবারের ওপর নৃশংস সশস্ত্র হামলার অভিযোগ উঠেছে। হামলায় নওরিন, তার মা ও ভাই গুরুতর আহত হয়েছেন। আহতদের চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে জরুরি বিভাগে ভর্তি করা হয়েছে। নওরিন সুলতানা কাপাসগোল সিটি কর্পোরেশন মহিলা কলেজের বিবিএ (অনার্স) চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তিনি জানান, তার পরিবার প্রায় ৩০-৩৫ বছর ধরে শান্তিপূর্ণভাবে তাদের পৈতৃক সম্পত্তিতে বসবাস করছে। কিন্তু একই এলাকার কিছু জগড়াটে ও আইন অমান্যকারী ব্যক্তি দীর্ঘদিন ধরে তাদের সম্পত্তি দখলের চেষ্টা করে আসছিল।

ভিকটিমের অভিযোগ অনুযায়ী, ১২ সেপ্টেম্বর রাত ১১টার সময় প্রথমবারের মতো হামলাকারীরা তাদের বাসায় অনুপ্রবেশ করে। তারা নওরিন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মারধর এবং হত্যার হুমকি দেয়। এতে তার পরিবার আতঙ্কে পড়ে। পরদিন, ১৩ সেপ্টেম্বর সন্ধ্যা ৭টার সময় হামলাকারীরা ফের বসতবাড়িতে প্রবেশ করে। তারা দেশীয় অস্ত্র, লাঠি, লোহার রড, দা-বটি ও চাকু নিয়ে আসবাবপত্র ভাঙচুর করে। হামলার সময় নওরিনের মাথায় ইট দিয়ে আঘাত করা হয়, যা তার কপাল ফেটে রক্তাক্ত হয়ে যায়।…”

গত ২২ সেপ্টেম্বরে ‘চট্টলচিত্র’ নামের আরেকটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনেও একই তথ্য পাওয়া যায়। তবে প্রতিবেদনের কোথাও গণধর্ষণের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

পরবর্তীতে ‘Aydaa Nora’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গত ১৪ সেপ্টেম্বরে প্রচারিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। পোস্টটিতে ৭টি ছবির সংযুক্তি পাওয়া যায়, যার ৫টি ছবির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত দৃশ্যের মিল পাওয়া যায়।

Comparison : Rumor Scanner

পোস্টটির ক্যাপশনে বলা হয়, ‘আমি হসপিটালে ভর্তি অবস্থায় এখনো নিরাপত্তাহীনতায় ভুগতেছি। গতকাল (১৩/০৯/২৫) সন্ধ্যা সাতটার সময় আমাকে খুন করার উদ্দেশ্যে আমার নিজ আপন মামা এবং কিছু কাজিনদের সাথে নিয়ে হুট করে অতর্কিত হামলা চালাই, আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দেওয়ার জন্য। গতকাল সন্ধ্যায় হামলা করার আগের রাতেও (১২/০৯/২৫ তারিখ রাত ১১ টার দিকে) আমাকে চুল ধরে টানাটানি করে মারছিল। যার কারণে সেদিন রাতেই আমি থানায় অভিযোগ করছিলাম নিরাপত্তাহীনতার জন্য। দুপুরে পুলিশ এসে ঘটনা তদন্ত করার কথা থাকলেও আসেনি। সেই রাত পার হয়ে এবং গতকাল দিন পার হয়ে সন্ধ্যা সাতটায় আমার মামা কিছু দল গঠন করে সন্ধ্যায় আমার উপর হামলা চালাই। আমি কেন জিডি করছি, আমাকে এই বাড়িতে আর থাকতে দিবে না। মারতে মারতে মারি ফেলবে, তারপরেও জিডি বা আইনগত ব্যবস্থা নিতে পারব না। নিলেই মেরে ফেলবে আমাকে এসব হুমকি দেয়। আমি এসব হুমকি তোয়াক্কা না করলে তখনই আমাকে খুন করে মেরে ফেলার সর্বোচ্চ চেষ্টা শুরু করে। মাঝখান দিয়ে লোডশেডিং এর অন্ধকারের সুযোগে সাথে সাথে দুই সেকেন্ড না হতেই কোথায় থেকে ইট মেরে আমার মাথায় কেমন যখম করছে ছবিতে দেখতে পাচ্ছেন।…’ উক্ত পোস্টের কোথাও গণধর্ষণের দাবির উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, উক্ত ফেসবুক অ্যাকাউন্টটি পর্যবেক্ষণে ওই তরুণীর আরও বেশ কিছু ছবি ও ভিডিও পাওয়া যায়, যা থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে অ্যাকাউন্টটি মূলত ভিডিওতে প্রদর্শিত তরুণীরই। অ্যাকাউন্টটিতে তিনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিসেবে ‘কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন মহিলা কলেজ’ এবং নিকনেম হিসেবে ‘নওরিন’ উল্লেখ করেছেন।

এছাড়াও, এ বিষয়ে অনুসন্ধানে অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘দ্যা ডেইলি ক্যাম্পাস’ এর ওয়েবসাইটে ২৬ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “(আলোচিত) ভিডিওটির ব্যাখ্যা দিয়েছে চট্টগ্রাম জেলা পুলিশ। ভিডিওটি ভাইরাল হওয়ার পর পুলিশের সাইবার ইনভেস্টিগেশন সেল তদন্তে নামে এবং ঘটনাটির প্রকৃত সত্য উদঘাটনে তৎপরতা চালায়। তদন্তে দেখা যায়, প্রচারিত ভিডিওটি চট্টগ্রাম মহানগরীর চান্দগাঁও থানার ৪ নম্বর ওয়ার্ড এলাকায় ১৩ সেপ্টেম্বর ঘটে যাওয়া একটি জমি সংক্রান্ত পারিবারিক বিরোধের ঘটনায় ধারণ করা। সেখানে নওরিন সুলতানা (২৪) নামের এক তরুণী ও তার পরিবারের ওপর তাদেরই আত্মীয়দের দ্বারা হামলার ঘটনা ঘটে। এতে নওরিন, তার মা ও ভাই আহত হন এবং পরে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। নওরিন সুলতানা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন। তিনি চট্টগ্রামের কাপাসগোলা সিটি কর্পোরেশন মহিলা কলেজের বিবিএ (অনার্স) চতুর্থ বর্ষের ছাত্রী। এছাড়া, এ ঘটনায় ধর্ষণের কোনো অভিযোগ বা প্রমাণ পাওয়া যায়নি বলেও তদন্তে উঠে এসেছে।..”

এছাড়াও, এ বিষয়ে ‘বাংলাদেশ পুলিশ’ এর ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকে ২৬ সেপ্টেম্বরে প্রচারিত একটি পোস্টে বলা হয়, “সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়ানো একটি ভিডিওতে দাবি করা হচ্ছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর রাস্তার পাশে ফেলে রাখা হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে ভিডিওটি চট্টগ্রামের চান্দগাঁও এলাকায় ১৩ সেপ্টেম্বর জমি সংক্রান্ত পারিবারিক বিরোধের জেরে নওরীন সুলতানা নামে এক তরুণীর ওপর হামলার ঘটনা। তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী নন, চট্টগ্রামের একটি কলেজের চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। এ ঘটনায় নওরীন ও তার পরিবারের সদস্যরা আহত হন এবং মামলাও দায়ের হয়। পুলিশের তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে এ ঘটনার সঙ্গে ধর্ষণের কোনো সম্পর্ক নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রীকে গণধর্ষণের পর ফেলে রাখার দাবিটি সত্য নয়।”

সুতরাং, গত ১৩ সেপ্টেম্বরে চট্টগ্রামে সম্পত্তি সংক্রান্ত বিরোধের জেরে হামলায় এক তরুণীর আহত হওয়ার ঘটনাকে ঢাকায় তরুণীকে গণধর্ষণ করে রাস্তার পাশে ফেলে যাওয়ার দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img