জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে অংশ নিতে যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ড. ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত প্রতিনিধি দলে রয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আবদুল্লাহ মুহাম্মদ তাহের, জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) সদস্য সচিব আখতার হোসেন, যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারা এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যানের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা হুমায়ুন কবির। এছাড়া, যুক্তরাষ্ট্র থেকেই প্রতিনিধি দলে যোগ দেন জামায়াত নেতা ড. নাকিবুর রহমান। এরই প্রেক্ষিতে সম্প্রতি অনলাইনে একটি কথিত সংবাদ প্রতিবেদন প্রচার করা হয়েছে যেখানে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূসের গাড়ি বহরে আ.লীগের হামলায় গুরুতর আহত মির্জা ফখরুল, ড. ইউনূস ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের।
প্রচারিত ভিডিওটিতে যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূসের গাড়ি বহরে হামলার ভিডিও দাবিতে একটি ভিডিও ও আহত অবস্থায় ড. ইউনূস, মির্জা ফখরুল ও মোহাম্মদ তাহেরের ছবিও প্রচার করা হয়।

এরূপ দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে টিকটকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূসের গাড়িবহরে হামলা ও তার প্রতিনিধিদলের কয়েকজন আহত হওয়ার দাবিটি সত্য নয়। প্রকৃতপক্ষে, গত ২৬ মে ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের জয়ের পর আয়োজিত বিজয় শোভাযাত্রায় গাড়ি ধাক্কার একটি ভিডিও, সেই ঘটনায় আহত এক ব্যক্তির ছবি সম্পাদনা, ভিন্ন এক আন্দোলনকারীর ছবি সম্পাদনা এবং অপ্রাসঙ্গিক কিছু ভিডিও ফুটেজ একত্রিত করে তৈরি একটি ভিডিওর মাধ্যমে এই ভুয়া দাবি প্রচার করা হয়েছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদ প্রতিবেদনে ড. ইউনূসের গাড়িবহরে হামলার দৃশ্য দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির একাধিক কি-ফ্রেম নিয়ে রিভার্স সার্চে যুক্তরাজ্য ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘স্কাই নিউজ’ এর ওয়েবসাইটে গত ২৭ মে তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে কয়েকটি ভিডিওরও সংযুক্তি পাওয়া যায়, যার একটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত দৃশ্যের মিল পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, স্কাই নিউজের উক্ত ভিডিও এবং আলোচিত কথিত সংবাদ প্রতিবেদনের ভিডিও একে অপরের প্রতিবিম্ব বা মিররড সংস্করণ।

ভিডিওটিতে প্রদর্শিত ঘটনার বিষয়ে প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, ‘লিভারপুল এফসি ট্রফি প্যারেড চলাকালীন ভিড়ের মধ্যে গাড়ি ঢুকে পড়ার ঘটনায় দু’জন, যাদের একজন শিশু, গুরুতরভাবে আহত হয়েছে। মোট ২৭ জনকে সোমবার (২৬ মে) সন্ধ্যায় শহরের কেন্দ্রস্থল ওয়াটার স্ট্রিটে ঘটে যাওয়া এই ঘটনার পর অ্যাম্বুলেন্সে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়েছে।’ (অনূদিত)
উক্ত ঘটনার বিষয়ে আরো জানতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে কাতার ভিত্তিক সংবাদমাধ্যম ‘আল জাজিরা’র ওয়েবসাইটে গত ২৭ মে তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘সোমবার (২৬ মে) সন্ধ্যায় একটি গাড়ি লিভারপুল সমর্থকদের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে, এতে অন্তত ৬৫ জন আহত হয়েছেন, যাদের মধ্যে কয়েকজন মঙ্গলবার (২৭ মে) রাতেও হাসপাতালে ছিলেন। এই ঘটনা ঘটেছিল লিভারপুলের শহরের কেন্দ্রস্থলে প্রিমিয়ার লিগে লিভারপুলের জয়ের পর দলের অফিশিয়াল বিজয় শোভাযাত্রার সময়। সোমবার সন্ধ্যা ৬টার কিছু পর (জি.এম.টি. ১৭:০০) একটি গাড়ি লিভারপুল সমর্থকদের ভিড়ের মধ্যে ধাক্কা মারে, যারা প্রিমিয়ার লিগ ফুটবল প্রতিযোগিতায় লিভারপুলের জয় উদযাপন করছিলেন।’ (অনূদিত)
এছাড়াও, উক্ত ঘটনার দৃশ্যসম্বলিত আরো অসংখ্য সংবাদ পাওয়া যায় যাতে একইরকম তথ্যের উল্লেখ রয়েছে।
আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদ প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করলে তাতে ড. ইউনূসের কথিত আহত হওয়ার একটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায়। উক্ত ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘বিবিসি’র ওয়েবসাইটে ‘NI Liverpool fan discharged from hospital after being struck by car at parade’ শিরোনামে গত ২৭ মে তারিখে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে কয়েকটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায় যার একটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটির ড. ইউনূসের মুখমণ্ডল ব্যতীত বাকী সবকিছুর মিল পাওয়া যায়। ছবিটিতে ড. ইউনূসের জায়গায় ভিন্ন এক ব্যক্তিকে দেখা যায়। উক্ত ব্যক্তির বিষয়ে বিবিসির প্রতিবেদনটিতে ছবির বর্ণনায় বলা হয়, ‘ঘটনাটি ঘটার সময় জ্যাক ট্রটার তার বন্ধুদের সঙ্গে লিভারপুলের প্রিমিয়ার লিগ জয় উদযাপন করছিলেন’। (অনূদিত)

বিবিসির প্রতিবেদনের বিস্তারিত অংশে বলা হয়, ‘উত্তর আয়ারল্যান্ডের এক ব্যক্তি লিভারপুল ফুটবল ক্লাবের শোভাযাত্রায় গাড়ির ধাক্কায় আহত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন, তবে এখন তিনি ছাড়া পেয়েছেন। কাউন্টি ডাউনের নিউটাউনআর্ডসের জ্যাক ট্রটার এবং তার প্রেমিকা অ্যাবি গ্যালাগারকে সেই গাড়িটি ধাক্কা দেয়, যখন এটি লিভারপুলের ওয়াটার স্ট্রিটে ভক্তদের ভিড়ের মধ্যে ঢুকে পড়ে। ঘটনাটি ঘটেছিল সোমবার (২৬ মে) সন্ধ্যা প্রায় ৬টা BST-তে, যখন হাজার হাজার লিভারপুল এফসি সমর্থক প্রিমিয়ার লিগ জয়ের শোভাযাত্রায় শহরের কেন্দ্রে জড়ো হয়েছিলেন।’ (অনূদিত)
এছাড়া, অনুসন্ধানে ড. ইউনূসের কথিত আহত হওয়ার ছবিটি আসল হওয়ার সপক্ষে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রচারিত ছবিটি মূলত জ্যাক ট্রটারের উক্ত ছবি ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়েছে। উল্লেখ্য, জ্যাক ট্রটারের উক্ত ছবি ও আলোচিত কথিত সংবাদ প্রতিবেদনের ছবিটি একে অপরের প্রতিবিম্ব বা মিররড সংস্করণ।
আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদ প্রতিবেদনটিতে মোহাম্মদ তাহেরের কথিত আহত হওয়ার একটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায়। উক্ত ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ‘দ্য গার্ডিয়ান’ এর ওয়েবসাইটে ‘High court challenge to ‘constitutionally unprecedented’ UK anti-protest law’ শিরোনামে ২০২৪ সালের ২৯ নভেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটিতে একটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায় যার সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটির মোহাম্মদ তাহেরের মুখমণ্ডল ব্যতীত বাকী সবকিছুর মিল পাওয়া যায়। ছবিটিতে মোহাম্মদ তাহেরের জায়গায় ভিন্ন এক ব্যক্তিকে দেখা যায়।

প্রতিবেদনটিতে ছবির বর্ণনায় বলা হয় ‘মেট্রোপলিটন পুলিশ তাদের নতুন ক্ষমতা ব্যবহার করেছে ১৭ নভেম্বর জাস্ট স্টপ অয়েল প্রতিবাদকারীদের বিরুদ্ধে, যারা হোয়াইটহলে হেঁটে যাচ্ছিলেন এবং সামান্য বিঘ্ন সৃষ্টি করছিলেন, কারণ সড়কটি ইতিমধ্যেই পানি সরবরাহের কাজের জন্য আংশিকভাবে বন্ধ ছিল। ফটোগ্রাফ: গাই বেল/আলামী লাইভ নিউজ’’ (অনূদিত)
এছাড়াও, অনুসন্ধানে মোহাম্মদ তাহেরের কথিত আহত হওয়ার ছবিটি আসল হওয়ার সপক্ষে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রচারিত ছবিটি মূলত এই আন্দোলনকারীর পুরোনো ছবি ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়েছে।
এসব ছাড়াও, আলোচিত দাবিতে কথিত প্রতিবেদনটিতে আরো কিছু ফুটেজেরও সংযুক্তি পাওয়া যায় তবে সেগুলোতে ড. ইউনূসের গাড়িবহরে হামলার দাবির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।
আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদ প্রতিবেদনটিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের কথিত আহত হওয়ার একটি ছবিরও সংযুক্তি পাওয়া যায়। তবে অনুসন্ধানে আলোচিত ছবিটির প্রেক্ষাপট বা ছবিটি আসল হওয়ার সপক্ষে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
এছাড়া, প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলেও যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূসের গাড়ি বহরে আ.লীগের হামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. ইউনূস ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের গুরুতর আহত হওয়ার দাবির সপক্ষে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।
উল্লেখ্য, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত কথিত সংবাদ প্রতিবেদনের দাবি সঠিক না হলেও গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, নিউইয়র্কে ড. ইউনূসের সফরসঙ্গী মির্জা ফখরুল – তাসনিম জারাকে গালিগালাজ ও আখতার হোসেনকে হেনস্তা করা হয়েছে।
সুতরাং, যুক্তরাষ্ট্রে ড. ইউনূসের গাড়ি বহরে আ.লীগের হামলায় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, ড. ইউনূস ও বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহেরের গুরুতর আহত হওয়ার দাবি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Sky News – Liverpool parade incident: Two people – including child – seriously injured after car drove into crowd
- Al Jazeera – Liverpool parade car crash: What happened, and who the victims, suspect are
- BBC – NI Liverpool fan discharged from hospital after being struck by car at parade
- The Guardian – High court challenge to ‘constitutionally unprecedented’ UK anti-protest law
- Rumor Scanner’s analysis