ভুয়া অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে আরব আমিরাতের প্রতিমন্ত্রীর ছবি ব্যবহার করে আ. লীগের পক্ষে রাজনৈতিক প্রভাব তৈরির চেষ্টা

গত বছরের সেপ্টেম্বরে ‘Tamanna Aktar Yesmin’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইল নিয়ে অনুসন্ধান চালায় রিউমর স্ক্যানার টিম। অনুসন্ধানে উঠে আসে, প্রোফাইলটি থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিমন্ত্রী রিম আল হাশিমির বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও এমনভাবে উপস্থাপন করা হচ্ছিল, যেন প্রোফাইলধারী আওয়ামী লীগের পক্ষে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করছেন।

প্রতিবেদন প্রকাশের কিছুদিনের মধ্যেই প্রোফাইলটি ফেসবুক থেকে সরিয়ে নেওয়া হয়। এরপর নামের বানানে সামান্য পরিবর্তন এনে ‘Tamanna Akhter Yesman’ নামে আরেকটি প্রোফাইল খোলা হয়। নতুন এই প্রোফাইলটিও পূর্বের মতো একই কৌশলে পরিচালিত হচ্ছে। এখান থেকেও রিম আল হাশিমির পুরোনো ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে এমনভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে, যাতে একজন প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ভাবমূর্তি গড়ে তোলা যায়।

ফেসবুকের ট্রান্সপারেন্সি সেকশন বিশ্লেষণে দেখা গেছে, প্রোফাইলটি ২০২৪ সালের ২৪ নভেম্বর খোলা হয়েছে এবং এটি বাংলাদেশ থেকেই পরিচালিত হচ্ছে। সাত মাসের ব্যবধানে এর অনুসারীর সংখ্যা ১৪ হাজার ছাড়িয়েছে।

Screenshot: Facebook.

প্রোফাইলটিতে প্রকাশিত ছবি, ভিডিও ও বিবরণ দেখে সাধারণ ব্যবহারকারীদের মনে হতে পারে, এটি আওয়ামী লীগপন্থি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সক্রিয় কোনো নারী নেত্রীর প্রোফাইল। বিভিন্ন পোস্টে দেখা যায়, তিনি ভারতের কোথাও অবস্থান করছেন এবং সময় সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে তার বাসভবনে সাক্ষাৎ করছেন। এছাড়া ভারতে আসা বিভিন্ন বিদেশি নেতার সঙ্গে তার যোগাযোগ এবং বিদেশ সফরে গিয়ে বিভিন্ন দেশের শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের কথাও উল্লেখ করা হয়।

তবে অনুসন্ধানে এসব দাবির পক্ষে কোনো বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং দেখা গেছে, প্রোফাইলটিতে রিম আল হাশিমির পুরোনো কর্মকাণ্ডের ছবি ও ভিডিও ব্যবহার করে ভিন্ন একটি পরিচয় তুলে ধরার চেষ্টা চলছে। এতে প্রোফাইলধারীকে একজন আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত, প্রভাবশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে উপস্থাপন করা হচ্ছে। কখন কোথায় সফর করেছেন, কখন ফিরেছেন, এমন তথ্যও নিয়মিতভাবে জানানো হচ্ছে। 

উদাহরণস্বরূপ, সম্প্রতি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ‘কিংস তৃতীয় চার্লস হারমনি অ্যাওয়ার্ড’ পাওয়ার পর ‘Tamanna Akhter Yesman’ নামের ফেসবুক প্রোফাইল থেকে দাবি করা হয়, প্রোফাইলধারীও এই পুরস্কার পেয়েছেন। তবে, অনুসন্ধানে প্রমাণিত হয়, এই দাবি মিথ্যা। ‘তামান্না আক্তার ইয়াসমিন’ নামে কোনো ব্যক্তি এই পুরস্কার পাননি। এই দাবিতে প্রচারিত ছবিগুলো ২০২২ সালে দুবাই পুলিশ এবং এক্সপো ২০২০ দুবাইয়ের গিনেস ওয়ার্ল্ড রেকর্ড অর্জনের সঙ্গে সম্পর্কিত। এছাড়া পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন পাওয়া, মনোনয়নের পর ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে সাক্ষাৎ, ব্রিটেন সফর, ব্রিটিশ রাজা-রানী এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠক ও সফর শেষে ভারতে ফেরার দাবিও প্রচার করা হয়। তবে এসব দাবির সঙ্গে ব্যবহৃত ছবিগুলোর প্রতিটিই রিম আল হাশিমির পুরোনো ছবি ও ভিডিও।

Comparison: Rumor Scanner.

রিউমর স্ক্যানার টিম ২০২৫ সালের ১ থেকে ১৫ জুন পর্যন্ত ‘Tamanna Akhter Yesman’ নামের ফেসবুক প্রোফাইলটি নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে। এ সময়ের মধ্যে প্রোফাইলটি থেকে মোট ১০৩টি পোস্ট করা হয়। এর মধ্যে ৭৯টি ছিল শুধুমাত্র ছবি-ভিত্তিক, ২২টি ভিডিওকেন্দ্রিক এবং একটি পোস্টে ছবি ও ভিডিও দুটোই ব্যবহৃত হয়। একটি পোস্ট ছিল শুধুই লেখাভিত্তিক।

এই ১০৩টি পোস্টের মধ্যে ৮৩টিতে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিমন্ত্রী রিম আল হাশিমির ছবি ব্যবহৃত হয়েছে, যা মোট পোস্টের প্রায় ৮০ শতাংশ। বিষয়বস্তুর দিক থেকে সবচেয়ে বেশি মনোযোগ পেয়েছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তার নাম এসেছে ১৮টি পোস্টে, যা মোট পোস্টের প্রায় ১৭ শতাংশ। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাকে ইতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব পোস্টে রাশিয়ার আদালতে রূপপুর প্রকল্পে অর্থ আত্মসাতের কথিত মামলায় তার ‘মুক্তি’, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পক্ষ থেকে শেখ হাসিনা, সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ও টিউলিপ সিদ্দিকের বিরুদ্ধে কথিত অভিযোগ ‘বাতিল’-এর দাবি উঠে এসেছে। পাশাপাশি শেখ হাসিনার সঙ্গে ফোনালাপ ও সাক্ষাতের কথাও উল্লেখ করা হয়েছে।

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসকে ঘিরে ছয়টি পোস্ট করা হয়েছে। এর মধ্যে তিনটিতে বিদেশি নেতাদের সঙ্গে তার নির্ধারিত সাক্ষাৎ বাতিলের দাবি, একটিতে ফিনল্যান্ড সরকারের নিষেধাজ্ঞার দাবি এবং দুইটিতে কথিত ‘তামান্না’র সঙ্গে তার সাক্ষাতের উল্লেখ পাওয়া যায়। এসব পোস্টে ড. ইউনূসকে প্রায় প্রতিবারই নেতিবাচকভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে।

এছাড়া একটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, যুক্তরাজ্যের গোয়েন্দা সংস্থা জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি)-এর ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে। আরেকটি পোস্টে দাবি করা হয়েছে, বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ‘তামান্না’র সঙ্গে সাক্ষাৎ চেয়ে চিঠি দিয়েছেন।

প্রোফাইল থেকে প্রকাশিত এসব পোস্ট নির্দিষ্ট রাজনৈতিক দর্শনের অনুসারীদের কাছে দ্রুত পৌঁছে দিতে নিয়মিতভাবে আওয়ামী লীগপন্থি বিভিন্ন ফেসবুক গ্রুপে শেয়ার করা হয়। ফলে এগুলোর প্রচারমাত্রা বাড়ে এবং তা ফেসবুকের গণ্ডি পেরিয়ে এক্স (সাবেক টুইটার), ইউটিউব, ইনস্টাগ্রাম ও টিকটকের মতো অন্যান্য সামাজিক মাধ্যমেও ছড়িয়ে পড়ে।

এই পোস্টগুলো সাধারণ ব্যবহারকারীরা কতটা বিশ্বাস করছেন, তা মূল্যায়নের জন্য আন্তর্জাতিক নেতাদের সঙ্গে কথিত সাক্ষাতের দাবিসংবলিত পাঁচটি পোস্টকে নমুনা হিসেবে বিশ্লেষণ করা হয়। এসব পোস্টে দুবাইয়ের প্রধানমন্ত্রী, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী, ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লস ও তাঁর স্ত্রী এবং ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতের কথা বলা হয়েছে।

Image Collage: Rumor Scanner.

পাঁচটি পোস্টে মোট ১৮৬টি মন্তব্য পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ১৮৩টি মন্তব্যেই শুভেচ্ছা, অভিনন্দন বা প্রশংসা জানানো হয়েছে, যা মোট মন্তব্যের প্রায় ৯৮ শতাংশ। মাত্র একটি মন্তব্যে সন্দেহ প্রকাশ করা হয়েছে (০.৫৪ শতাংশ) এবং দুইটি মন্তব্যে বিরোধী মত এসেছে (১.০৮ শতাংশ)।

বিশ্লেষণে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয়েছে ‘লাইক’, এরপর ‘লাভ’ রিঅ্যাকশন। বিশ্লেষণ বলছে, প্রোফাইল থেকে প্রচারিত তথ্য ও দাবি অধিকাংশ ব্যবহারকারীর কাছেই বিশ্বাসযোগ্য ও গ্রহণযোগ্য মনে হয়েছে।

আরও পড়ুন

spot_img