যৌথবাহিনীর অভিযানে মাদক ও অস্ত্রসহ আটক নাফিজ ছাত্রলীগ নেতা নয়

গত ৮ অক্টোবর রাজধানীর খিলক্ষেতের লেকসিটি এলাকায় অভিযান চালিয়ে বিদেশি পিস্তল, ওয়াকিটকি, আইফোন ও বিপুল পরিমাণ মদসহ কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করে যৌথবাহিনী। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন নাফিজ মোহাম্মদ আলম, মো. সুজন মিয়া ও মো. রমজান আলী। এর প্রেক্ষিতে অন্যান্য গণমাধ্যমের মতো দৈনিক কালের কণ্ঠ এর ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেলে একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। উক্ত প্রতিবেদনে গ্রেপ্তারকৃত নাফিজ মোহাম্মদ আলমকে একজন ছাত্রলীগ নেতা বলে দাবি করা হয়। 

কালের কণ্ঠের ফেসবুক পেজে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন এখানে (আর্কাইভ)

ইউটিউব চ্যানেলে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার নাফিজ মোহাম্মদ আলম ছাত্রলীগ নেতা নয় বরং, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তিনি আওয়ামী লীগ বিরোধী হিসেবেই পরিচিত। বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সাথে ছবি ছাড়াও তাকে বিএনপি পরিচয়ে সাবেক প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিনের কর্মসূচি পালন করতেও দেখা গেছে। ফেসবুকে প্রাপ্ত তার বিভিন্ন ছবির মাধ্যমে তাকে বিভিন্ন সময় বিএনপির পক্ষে প্রচারণা চালাতে দেখা গেছে।

আলোচিত দাবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে খিলক্ষেত থেকে নাফিজের গ্রেপ্তারের ঘটনায় প্রকাশিত ভিন্ন কয়েকটি গণমাধ্যমের প্রতিবেদন (দৈনিক ইনকিলাব, যায়যায়দিন, দেশ রূপান্তর, দৈনিক কালবেলাঢাকা পোস্ট) পর্যালোচনা করে রিউমর স্ক্যানার। এতে দেখা যায়, কালের কণ্ঠের ভিডিও প্রতিবেদন ব্যতীত আর কোনো গণমাধ্যমের প্রতিবেদনেই নাফিজ মোহাম্মদ আলমের পরিচয়ে  ছাত্রলীগ নেতা দাবি  করা হয়নি। এছাড়াও একই ঘটনায় কালের কণ্ঠের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত প্রতিবেদনটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, প্রতিবেদনটিতে তারা নাফিজ মোহাম্মদ আলম ডনের সাথে ছাত্রলীগের সম্পৃক্ততার বিষয়ে কোনো কিছু উল্লেখ করেনি।

Screenshot: Kalerkantho

কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে Nafiz Md Alam অফিসিয়াল নামের একটি পেজের সন্ধান পাওয়া যায়। 

Screenshot: Facebook 

পেজটি পর্যালোচনা করে দেখা যায়, এর About সেকশনে লিখা রয়েছে নাফিজ আলম জাতীয়তাবাদী আদর্শে বিশ্বাসী একজন তরুণ ছাত্রনেতা ও সমাজসেবক। 

Screenshot: Facebook

এছাড়াও তার পেজে জিয়াউর রহমান, খালেদা জিয়া, তারেক রহমান ও বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনকে নিয়ে করা একাধিক পোস্ট দেখতে পাওয়া যায়। 

Screenshot Collage by Rumor Scanner


পাশাপাশি পেজটির পিন পোস্ট সেকশন থেকে একটি পোস্ট পাওয়া যায়। যেখানে নাফিজ মোহাম্মদ আলমকে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপির হয়ে প্রচারণ চালাতে দেখা যায়।

Screenshot: Facebook

পরবর্তীতে নাফিজ মোহাম্মদ আলমের বিষয়ে অনুসন্ধানে কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে Beauty Of Sense নামের একটি ফেসবুক পেজ থেকে গত ১০ অক্টোবর করা একটি পোস্টের সন্ধান পাওয়া যায়। 

পোস্টটিতে কালের কণ্ঠের প্রতিবেদনের প্রেক্ষিতে দাবি করা হয়, নাফিজ মোহাম্মদ আলম ছাত্রলীগ নয় বরং বিএনপির রাজনীতির সাথে জড়িত। তিনি বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের একান্ত অনুসারী। উক্ত তথ্যগুলোর ভিত্তি স্বরূপ পোস্টটিতে বিএনপি নেতা ইশরাক হোসেনের সাথে তার ছবি এবং বেগম খালেদা জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে তার নামে তৈরিকৃত ডিজিটাল ব্যানারের ছবি সংযুক্ত করা হয়। এছাড়াও খালেদা জিয়ার জন্মদিন উপলক্ষে নিজ গাড়িতে করে উপহারসামগ্রী বিতরণের একটি ছবিও পোস্টটিতে সংযুক্ত করা হয়েছে।

Collage: Rumor Scanner

পাশাপাশি পোস্টটিতে তার বিরুদ্ধে উত্তরা থানা আক্রমণ করে থানা লুটের অভিযোগ করা হয়। উক্ত তথ্যের প্রেক্ষিতেও Nafiz Md Alam নামের তার ফেসবুক আইডি থেকে থানায় আক্রমণের সময় করা একটি ভিডিওর স্ক্রিনশটও প্রদান করা হয়। 

Screenshot: Facebook

এছাড়াও, পোস্টটিতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে র‍‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব)-এর দ্বারা চালানো নির্যাতনের অভিযোগের ঘটনাগুলো নিয়ে ২০২৩ সালের এপ্রিলে জার্মানিভিত্তিক গণমাধ্যম ডয়েচ ভেলে ও সুইডেনভিত্তিক বাংলাদেশ বিষয়ক গণমাধ্যম নেত্র নিউজের যৌথ উদ্যোগে নির্মিত একটি ডকুমেন্টারির লিংকও প্রদান করা হয়। যেখানে নাফিজ মোহাম্মদ আলমকে ভিকটিম হিসেবে সাক্ষাৎকার দিতে দেখা যায়। এই ডকুমেন্টারিতেও তার কোনো রাজনৈতিক দলের সাথে সংশ্লিষ্টতার কথা বলা হয়নি।

Screenshot: Youtube 

উক্ত ডকুমেন্টারি প্রকাশ পরবর্তী সময়ে ২০২১ সালে করা পর্নোগ্রাফি মামলায় তাকে র‌্যাব গ্রেপ্তার করে র‌্যাব।

র‌্যাবের বিরুদ্ধে নির্যাতনের অভিযোগের বর্ণনা দিয়ে গত আগস্টে দেশিয় বেসরকারি গণমাধ্যম mytv তে দেওয়ার তার আরেকটি সাক্ষাৎকারেরও লিংকও পোস্টটিতে সংযুক্ত করা হয়েছে। 

Screenshot: Facebook 

উক্ত সাক্ষাৎকারে নাফিজ মোহাম্মদ আলম জানান, বিএনপি-জামায়াতের সাথে রাজনৈতিক সম্পর্ক এবং ২০১৮ সালের নির্বাচনের সময় নাশকতা চালানোর অভিযোগ এনে র‌্যাব তাকে আটক করে।  সেসময় র‌্যাব তার ওপর অমানবিক নির্যাতন চালিয়ে জোরপূর্বক স্বীকারোক্তি আদায়ের চেষ্টা করে। 

এছাড়া, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালে গত ৩১ জুলাই বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসিয়াল পেজ থেকে প্রকাশিত এক ভিডিওতে নাফিজকে মাদক ব্যবসায়ী উল্লেখ করে তার বিরুদ্ধে কোটা সংস্কার আন্দোলনে সরকার বিরোধী উস্কানির অভিযোগ তোলা হয়। ভিডিওতে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন সমর্থনে ফেসবুকে করা নাফিজের বিভিন্ন পোস্টের স্ক্রিনশট দেখানো হয়। (বর্তমানে নাফিজের এই অ্যাকাউন্টটি বন্ধ রয়েছে)

কতিপয় গণমাধ্যমে বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে ছাত্রদের বিরুদ্ধে শট গান দিয়ে নাফিজের ফায়ারের ভিডিও ফেসবুকে ভাইরাল হওয়ার দাবি করা হলে ও রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে এমন কোনো ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়নি।

উল্লেখ্য, নাফিজ ২০২১ সালেও বিপুল পরিমাণ মাদকদ্রব্যসহ বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে র‍্যাব এর হাতে আটক হয়েছিলেন। সেসময় গণমাধ্যমে প্রকাশিত সংবাদেও তার কোনো রাজনৈতিক পরিচয়ের উল্লেখ পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ, প্রাপ্ত তথ্যগুলো থেকে এটি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয় যে, যৌথবাহিনীর অভিযানে গ্রেপ্তার নাফিজ মোহাম্মদ আলম ছাত্রলীগ নেতা নয়। 

সুতরাং, যৌথবাহিনীর অভিযানে খিলক্ষেত থেকে মাদক ও অস্ত্রসহ আটক আওয়ামী লীগ বিরোধী নাফিজ মোহাম্মদ আলমকে কালেরকণ্ঠে ছাত্রলীগ নেতা দাবি করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img