গত ০৫ এপ্রিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি ‘নিউজ’ সাইট লিংককে সূত্র হিসেবে দিয়ে দাবি করা হয়, ঢাকা সেনানিবাসে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এই হামলায় ৯ জন সেনা সদস্য নিহত এবং একইসাথে ২ জন জঙ্গিও নিহত হয়েছে। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এমন কোনো ঘটনাই বাস্তবে ঘটেনি। সূত্র হিসেবে দেওয়া যে সাইটের লিংক দেওয়া হয়েছে সেই সাইটটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কোনো তথ্য প্রমাণ ছাড়াই ব্লগস্পটের বিনামূল্যের ডোমেইন সাইট ব্যবহার করে ভুয়া এই সংবাদ প্রকাশ করে পরবর্তীতে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট গত বছরের (২০২৪) আগস্ট পরবর্তী সময় থেকে এই ধরণের ব্লগস্পটের বিনামূল্যের ডোমেইন সাইটগুলোর ওপর নজর রাখছিল। চলতি এপ্রিল পর্যন্ত এমন অন্তত ১৬টি সাইটের সন্ধান পাওয়া গেছে, যেগুলোতে বাংলাদেশকে জড়িয়ে অপতথ্যের প্রচার ছিল নিয়মিত। রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের দীর্ঘ অনুসন্ধানে বেরিয়ে এসেছে এসব সাইটের পেছনে কারা আছেন, কারাই বা এসব সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে দিচ্ছেন এবং কাদের এসব অপতথ্যের শিকার বানানো হচ্ছে।
ব্লগস্পটের বিনামূল্যের ডোমেইন কীভাবে তৈরি হয়?
ব্লগস্পট হল সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগলের একটি ফ্রি ব্লগিং প্লাটফর্ম। এই প্লাটফর্মে (http://www.blogger.com) বিনামূল্যে ব্লগ সাইট তৈরি করে তাতে নিয়মিত লেখা প্রকাশের সুবিধা রয়েছে। প্রক্রিয়াটিও বেশ সহজ। ইমেইল অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করে পছন্দের নাম দিয়ে ব্লগসাইটটি খোলা হয়৷ বিনামূল্যে হওয়ায় ইউআরএলে blogspot শব্দটি থাকে। যেমন, কেউ যদি Bangladesh নাম দিয়ে ব্লগ খুলতে চান, তাহলে তার ইউআরএল হবে https://bangladesh.blogspot.com/।
এটি এসইও (SEO) ফ্রেন্ডলি ব্লগিং প্লাটফর্ম হওয়ায় গুগল থেকে অসংখ্য ভিজিটর আসে এই প্লাটফর্মে। ফলে যে কোনো লেখা সহজেই কম সময়ে অসংখ্য ভিজিটরদের কাছে পৌঁছে দেওয়া যায়। তাছাড়া, ফেসবুকে সাধারণত নেটিজেনরা কোনো তথ্যের পক্ষে সমর্থনমূলক লিংক খোঁজেন। এই সুযোগ নিয়ে এই ধরণের ব্লগসাইটের মাধ্যমে লেখা প্রকাশ করে লিংকটি পোস্টগুলোতে যুক্ত করে দেওয়ার প্রবণতা দেখা যায়, যা আলোচিত তথ্যটিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার প্রয়াস হিসেবে দেখা হয়। মূলত এই প্লাটফর্ম ব্যবহার করেই গেল বছরের অন্তত সেপ্টেম্বর থেকে একাধিক ব্লগসাইট তৈরি করে বাংলাদেশকে নিয়ে অপতথ্য প্রচার করা হচ্ছে।
ব্লগস্পটের একাধিক সাইটে অপতথ্য
গত বছরের (২০২৪) আগস্টে বাংলাদেশে যখন গণঅভ্যুত্থান ঘটে এবং এর প্রেক্ষিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হয়। ঠিক তার পরের মাসেই অপতথ্য প্রচারের নতুন এই কৌশল রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিটের নজরে আসে। ‘স্বাধীন বাংলাদেশ নিউজ ২৪৭’ নামের একটি সাইট থেকে ০৫ সেপ্টেম্বর প্রথম অপতথ্য প্রচারের হদিস মেলে। সে মাসে এই সাইটে অন্তত ৬৫টি কথিত সংবাদের মাধ্যমে লেখা প্রকাশ করে পরবর্তীতে ফেসবুকে তা ছড়িয়ে দেওয়া হয়। পরবর্তী মাসগুলোতেও একই কার্যক্রম চালানো হয়েছে। একই প্রক্রিয়ায় অপতথ্যের প্রচার চালিয়েছে এমন আরো অন্তত ১৫টি সাইটের সন্ধান মিলেছে। এসব সাইটের অন্তত পাঁচটিতে দেশি-বিদেশি গণমাধ্যমের নাম ও লোগো ব্যবহার করে সাইটগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে। তাতে সফল হয়েছে এমন প্রমাণও পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। এর মধ্যে ‘ডেইলি নিউজ বিডি আওয়ামী লীগ’ জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকার লোগো, ‘আমার দেশ’ জাতীয় দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার নাম ও লোগো, ‘ভোরের ডাক’ জাতীয় দৈনিক ভোরের ডাক পত্রিকার নাম ও পরিবর্তিত লোগো, ‘বিবিসি নিউজ বাংলা ২৪৭০’ ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসির বাংলা সংস্করণের নাম ও লোগো এবং ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’ ভারতের কলকাতার দৈনিক আনন্দবাজারের নাম ব্যবহার করা হয়েছে। অনুসন্ধানে পাওয়া সাইটগুলোর সবগুলো অবশ্য এখন সক্রিয় নেই।
‘স্বাধীন বাংলাদেশ নিউজ ২৪৭’ নামের যে সাইটটি থেকে প্রথম অপতথ্যের প্রচার শুরু হয়, তাতে গত ফেব্রুয়ারির পর থেকে নতুন কোনো ‘সংবাদ’ প্রচার করা হয়নি। এমনকি অপতথ্য সম্বলিত পুরোনো সকল সংবাদও সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবে কাছাকাছি নামের (স্বাধীন নিউজ ২৪৭) সাইটটিতে এরপরই অপতথ্যের প্রচার শুরু হয়, যা এখনও চলমান রয়েছে। এছাড়া, কার্যক্রম শুরুর পর বর্তমানে নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে এমন সাইটগুলোর মধ্যে রয়েছে ডেইলি নিউজ বিডি আওয়ামী লীগ, বিবিসি নিউজ বাংলা ২৪৭০, বাংলাদেশেরও, লিমা আক্তার ২০২২, বাংলাদেশ ৪৩৪৮, বাংলাদেশ ৩৪৪৭ এবং লিমা আক্তার ৩৪৪। শেষোক্ত পাঁচটি সাইটে এখন আর প্রবেশই করা যায় না।
এসব সাইটের অপতথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গণমাধ্যম এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোচনায় আসা ঘটনাগুলো নিয়মিত নজর রাখেন এসব কথিত সংবাদ তৈরির কারিগররা। ঘটনার সাথে মিল রেখে কাছাকাছি সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নামে ভুল তথ্য প্রকাশ করা হয়। যেমন, গত ০৭ মার্চ ফ্রান্সে বসবাসরত বাংলাদেশি অনলাইন এক্টিভিস্ট পিনাকী ভট্টাচার্য তার ফেসবুক পেজের মাধ্যমে জানান যে হাসপাতালে তার একটি সার্জারি হবে। এর প্রেক্ষিতে পরদিন ‘আমার দেশ’ নামের ব্লগস্পটের একটি ডোমেইন সাইটে দাবি করা হয়, পিনাকী ভট্টাচার্য হাসপাতালে অপারেশন টেবিলেই মারা গেছেন। অথচ, পিনাকীর অপারেশন সফল হয়েছিল এবং তিনি সুস্থ আছেন। এসব সাইটে অপতথ্যগুলো প্রকাশের পর নির্দিষ্ট কিছু ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে সেগুলোর লিংক একই মতাদর্শের গ্রুপগুলোতে প্রচার করা হয়।
পেছনে সংঘবদ্ধ চক্র
ব্লগস্পটের বিনামূল্যের ডোমেইন সাইটগুলো কারা পরিচালনা করছে তা জানতে গেল কয়েক মাস ধরেই অনুসন্ধান চালাচ্ছিল রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট। এসব সাইটে কথিত প্রকাশিত সংবাদগুলো ফেসবুকে কারা নিয়মিত প্রচার করছেন তা নজর রাখা হচ্ছিল। দীর্ঘ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ভুয়া পরিচয় ব্যবহার করে চালু থাকা একাধিক ফেসবুক অ্যাকাউন্ট, পেজ এবং গ্রুপ নিয়মিত ভিত্তিতে শুধু এসব অপতথ্যই প্রচার করেছে।
অ্যাকাউন্টগুলোর পরিচয় এবং কার্যক্রম বিশ্লেষণ করতে গিয়ে সংঘবদ্ধ অন্তত দুইটি চক্রের সন্ধান পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট, যারা কিনা সমষ্টিগতভাবে এসব সাইটের অপতথ্য ছড়িয়ে দিচ্ছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এর মধ্যে একটি চক্রের সম্ভাব্য মূলহোতা হিসেবে থাকা একটি অ্যাকাউন্ট হচ্ছে তাপসী তাবাসসুম ঊর্মি (ইংরেজিতে অ্যাকাউন্টের নাম Tapasshe Tabassum Urmi)। এই অ্যাকাউন্টটিতে কোটা সংস্কার আন্দোলনে নিহত আবু সাঈদসহ অন্য নিহতদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্যের অভিযোগে গত বছরের ৭ অক্টোবর লালমনিরহাট জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট পদ থেকে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া তাপসী তাবাসসুম উর্মির নাম এবং পরিচয় ব্যবহার করা হয়েছে। তবে এই অ্যাকাউন্ট খোলা হয়েছে এই ঘটনারও মাস ছয়েক পূর্বে, গত বছরের ০১ এপ্রিল। শুরুতে অ্যাকাউন্টটির নাম ছিল রিম ঝিম (Rim Jhim)। আগস্টের গণঅভ্যুত্থান পূর্ববর্তী সময়ে এই অ্যাকাউন্ট ব্যবহার হয়েছে নারীদের স্পর্শকাতর ছবি ফেসবুকের বিভিন্ন গ্রুপে প্রচারের কাজে। এই কাজে একটি গ্রুপকেও ব্যবহার করা হয়েছে, যার এডমিনও এই অ্যাকাউন্ট। সাত হাজারের অধিক ফলোয়ার সমৃদ্ধ এই অ্যাকাউন্ট থেকে গত বছরের সেপ্টেম্বরে ব্লগস্পটের বিনামূল্যের ডোমেইনে তৈরি সাইটের অপতথ্য প্রচার শুরু হয়। অক্টোবরে তাপসী তাবাসসুম উর্মির ঘটনাটি দেশব্যাপী আলোচনার পর এই অ্যাকাউন্টটির নাম বদলে উর্মির নাম ও ছবি লাগানো হয়। এই অ্যাকাউন্টের পোস্টে নিয়মিত আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক লীগের অফিশিয়াল ফেসবুক পেজ থেকে কমেন্ট করার প্রমাণ পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট।
অ্যাকাউন্টটি অপতথ্যগুলো প্রচার করতে একটি পেজ এবং গ্রুপকে ব্যবহার করে আসছে। ‘স্বাধীন নিউজ ২৪৭’ নামের পেজটি ‘সজীব ওয়াজেদ জয়’ নামে খোলা হয় গত বছরের ০৭ নভেম্বর। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নাম বদলে বর্তমান নাম রাখা হয়৷ এই পেজ এবং তাপসী তাবাসসুম উর্মি নামের অ্যাকাউন্টটি ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ নামে একটি গ্রুপের এডমিন। গ্রুপটি অবশ্য বেশ পুরোনো। ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামে এটি খোলা হয় ২০২০ সালের ০৭ সেপ্টেম্বর। ২০২৩ সালে গ্রুপটিতে জুয়ার কার্যক্রম চালানো শুরু হয় ‘Betx365 official Agent group’ এই নামে পরিবর্তন করে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে ২০২৪ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর ‘স্বাধীন বাংলাদেশের খবর ২৪/৭’ নাম রাখা হয়। এরমধ্যে ১৫ নভেম্বর ফের ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নাম রাখা হলেও সর্বশেষ গত ১৯ ফেব্রুয়ারি বর্তমান নামটি রাখা হয়। এই গ্রুপের আরেক এডমিন আকাশ ইসলাম (Akash Islam) নামের একটি অ্যাকাউন্ট। ২০২৪ সালের ২৯ মার্চ অ্যাকাউন্টটি চালুর সময় নিবিড় চৌধুরী নাম ছিল। সম্প্রতি নাম বদল করা হয়েছে। অ্যাকাউন্টটি চালুর পর শুরুর দিকে অ্যাকাউন্টধারী নিজেকে মোহাম্মদ আলী পরিচয় দিয়ে জুয়ার প্রচারণা চালাতো। এই কাজের জন্য একটি ফোন নম্বরও ব্যবহার করা হয়। পরবর্তীতে গত বছরের সেপ্টেম্বরে আলোচিত অপতথ্যগুলোর প্রচারে নিয়োজিত হয় এই অ্যাকাউন্ট। অপ্রিয় সত্য নামে এমন আরেকটি অ্যাকাউন্টও রয়েছে এই চক্রে। ২০২১ সালের ১৩ অক্টোবর চালু হওয়া এই অ্যাকাউন্টের সেপ্টেম্বর পরবর্তী অপতথ্যের একাধিক পোস্টে তাপসী তাবাসসুম উর্মি ও আকাশ ইসলাম নামের অ্যাকাউন্ট দুইটির রিয়েকশন পাওয়া যায়৷ এই চক্রে সত্যের সন্ধানে ও আমার দেশ নামে দুইটি পেজ রয়েছে যেগুলো গত বছরের অক্টোবরে কাছাকাছি সময়ে (যথাক্রমে ০৭ ও ১০ অক্টোবর) চালু করা হয়। দুইটি পেজই চালুর সময় নাম ছিল Tapasshe Tabassum Urmi। পরবর্তীতে নাম বদলে ফেলা হয়। আওয়ামী লীগ পরিবার নিউজ, Md Rocky Ahmed, Jahid Hasan Noyan নামের অ্যাকাউন্টগুলোও একই চক্রের ছড়ানো অপতথ্যগুলো অনিয়মিতভাবে প্রচার করছে। এসব অ্যাকাউন্ট, গ্রুপ এবং পেজের পোস্টগুলো বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট পরস্পরের মধ্যে সম্পর্ক থাকার বিষয়টি লক্ষ্য করেছে। যার যোগসূত্র হিসেবে কাজ করেছে মূলত Tapasshe Tabassum Urmi নামের অ্যাকাউন্টটি। এসব অ্যাকাউন্ট, গ্রুপ এবং পেজ থেকে borer-dak, Sadhinbangladeshnews247, bbcnews2470, sadhinnews247, amardeesh247, fullmoviedownload76246 এসব সাইটে প্রকাশিত অপতথ্যগুলো পোস্ট করা হচ্ছে।
এই অ্যাকাউন্ট, গ্রুপ এবং পেজগুলো থেকে অপতথ্যের পোস্টগুলো নিয়মিত আওয়ামী লীগের দলীয় এবং রাজনীতিবিদদের নামে চালু থাকা অন্তত এক ডজন আনঅফিশিয়াল গ্রুপে (যেমন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ Bangladesh Awami League, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ (ছাএলীগ যুবলীগ), বাংলাদেশ ছাত্রলীগ, বাংলাদেশ ছাত্রলীগ ঢাকা মহানগর উওর, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, Sheikh Fazlul Karim Selim, সায়েমা ওয়াজেদ পুতুল, Tulip Siddiq -MP Fans, প্রতিবাদী মুজিব সেনা ঐক্য পরিষদ অনলাইন ভিত্তিক একটি রাজনৈতিক সংগঠন, ব্রিটিশ আওয়ামীলীগ সাপোর্ট টিম) পোস্ট করা হয়েছে। অনুসন্ধানের সুবিধার্থে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এই চক্রকে ১ নং বলে অভিহিত করছে।
এই চক্রের বাইরে তানিয়া, রাহি, Shakib Hossain, Somi Akhter নামে অন্তত চারটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট এবং MD, Joumouna Tv, Johana Tv, News27, সময়, দৈনিক বাংলা নিউজ নামের অন্তত ছয়টি পেজের সন্ধান পেয়েছে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট, যারা সংঘবদ্ধভাবে bangladesar0, limaaktar2022, bangladesh4348, bangladesh3447, limaakhter344 নামের অন্তত পাঁচটি নিষ্ক্রিয় সাইট এবং banglanewsachehd, mdrasidhe44, bhdhdjjddh নামের অন্তত তিনটি সক্রিয় সাইটে প্রকাশিত অপতথ্য নিয়মিত পোস্ট করেছেন। অ্যাকাউন্টগুলোর অ্যাবাউট সেকশনে এদের পরিচয় সম্পর্কে বিস্তারিত কোনো তথ্য দেওয়া নেই। তবে পেজগুলো গত বছরের অক্টোবর থেকে চলতি এপ্রিলের মধ্যে খোলা হয়েছে। এসব পেজে শূণ্য থেকে সর্বোচ্চ দুইজন ফলোয়ার রয়েছে৷ এরাও মূলত বিভিন্ন গ্রুপে (যেমন, বাংলাদেশ প্রতিদিন, আমার দেশ, ফেসবুক মনিটাইজেশন সাপোর্ট) অপতথ্যগুলো পোস্ট করে আসছেন। অনুসন্ধানের সুবিধার্থে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট এই চক্রকে ২ নং বলে অভিহিত করছে।
কী ধরণের অপতথ্য প্রচার হচ্ছে?
দুইটি চক্রের প্রচারকৃত সাইটগুলোর অপতথ্যের বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার ইনভেস্টিগেশন ইউনিট দেখতে পায়, ১ নং চক্রের সাইটগুলোতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার এবং সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিষয়ে যেসব অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে তার সবগুলোই সরকার ও ড. ইউনূসের বিপক্ষে যায়। এসব অপতথ্যের ৯০ শতাংশই সরকার ও ড. ইউনূসের পদত্যাগ সংক্রান্ত বিষয়ে। অপরদিকে, ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিষয়ে এসব সাইটে যে সকল অপতথ্যের প্রচার করা হয়েছে তার সবগুলোই তার পক্ষে গিয়েছে। এসব অপতথ্যের সিংহভাগই তার দেশে ফেরা সংক্রান্ত। এছাড়া, আগস্ট পরবর্তী বিভিন্ন ঘটনাপ্রবাহে অপতথ্য প্রচারের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের পক্ষে যায় এমন ভাষ্যে সংবাদ প্রচারের প্রবণতা দেখা গেছে এসব সাইটে। অপতথ্যগুলোয় বাহিনীগুলোকেও জড়ানো হয়েছে। এর মধ্যে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং বাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানকে জড়িয়েই অধিকাংশ অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে।
২ নং চক্রের ক্ষেত্রে অবশ্য অপতথ্যের প্রচারে একতরফা প্রবণতা দেখা যায়নি৷ এই চক্রের নিয়ন্ত্রণাধীন সাইটগুলোতে আওয়ামী লীগের পক্ষে যায় এমন অপতথ্যের প্রচার যেমন ছিল, তেমনি দলটির বিপক্ষে যায় এমন ভুয়া তথ্যও প্রচার করা হয়েছে হরহামেশাই। এসব সাইটের একটি সাধারণ বিষয় হচ্ছে একই ‘সংবাদ’ কিছুদিন পরপর পুনরাবৃত্তি করে একই সাইট এবং একই চক্রের অন্যান্য সাইটে প্রকাশ করা হয়। এই কায়দায় শেখ হাসিনার মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুলের গ্রেফতারের ভুয়া খবর দেওয়া হয়েছে অন্তত ছয়বার৷ এসব সাইটে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়ে সবচেয়ে বেশি অপতথ্য প্রচার করা হয়েছে, যার সবক’টিই বাহিনীটির বিপক্ষে যাওয়ার সুযোগ রেখেছে। এসব সাইট বেশিদিন স্থায়ী হচ্ছে না। অধিকাংশই এখন নিষ্ক্রিয় অবস্থায় রয়েছে। কতিপয় সাইট ব্যবহারের সময় সাইটে প্রবেশের কয়েক সেকেন্ডের মধ্যেই ভিন্ন সাইটে নিয়ে যায়৷
নীতিমালা আছে, কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন
ব্লগস্পট দিয়ে তৈরি সাইটগুলোর বিষয়ে ব্লগার কর্তৃপক্ষ উদার নীতিই অবলম্বন করে থাকে। তাদের ভাষ্যমতে, মত প্রকাশের স্বাধীনতার আদর্শ যে পরিষেবার ভিত্তি, এই কন্টেন্ট সেন্সর করলে সেই আদর্শের বিরোধিতা করা হয়। তবে এইসব মূল্যবোধ তুলে ধরার ক্ষেত্রে, তাদের পরিষেবা প্রদান করার ক্ষমতা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতার কাছে ভীতিপ্রদ হতে পারে এমন অবমাননাকর আচরণ তারা প্রতিরোধ করবে বলেই জানিয়ে রেখেছে। ব্লগার এর কমিউনিটি নির্দেশিকা লঙ্ঘন করেছে এমন কন্টেন্ট সংক্রান্ত অভিযোগ জানাতে প্লাটফর্মটি তার পাঠকদের উপর নির্ভর করে থাকে। এক্ষেত্রে যে কোনো পাঠক এখানে অভিযোগ জানাতে বলা হয়েছে।
ব্লগারের নীতিমালায় কোনও ব্যক্তি বা সংস্থার ছদ্মবেশ ধারণ না করতে বা নিজেকে ভুলভাবে উপস্থাপন না করতে সতর্ক করা হয়েছে। এমন কন্টেন্ট এড়িয়ে চলতে পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যা সংশ্লিষ্টদের আসল পরিচয় সম্পর্কে পাঠক-দর্শকদের বিভ্রান্ত করতে পারে। অথচ আলোচিত সাইটগুলোয় ছদ্মবেশে অন্য গণমাধ্যমের নাম ও লোগোর মতো পরিচয় ব্যবহার করে নিয়মিত অপতথ্যের প্রচার চালানো হচ্ছে।
কোনও রাজনৈতিক ব্যক্তি বা সরকারী কর্মকর্তা মারা গেছেন, কোনও দুর্ঘটনার কবলে পড়েছেন বা হঠাৎ গুরুতর কোনও শারীরিক অসুস্থতায় ভুগছেন এমন দাবি করে ভুয়া তথ্য ছড়ানো থেকেও সতর্ক থাকার কথা স্মরণে রাখতে বলা হয়েছে ব্লগারের এ সংক্রান্ত নীতিমালায়। তবু মাসের পর মাস বাংলাদেশে রাজনীতিবিদদের ক্ষেত্রে সমজাতীয় দাবিগুলো প্রচারে ব্লগারেরই বিনামূল্যের সাইটগুলোকে কাজে লাগানো হচ্ছে৷ ব্লগার কর্তৃপক্ষ বলছে, কোনো ব্লগ তাদের কমিউনিটি নির্দেশিকা লঙ্ঘন করেছে বলে মনে হলে লঙ্ঘনের গুরুত্ব অনুযায়ী তারা বিভিন্ন ব্যবস্থা নিতে পারেন। এর মধ্যে রয়েছে ব্লগ অথবা পোস্ট দেখার আগে সংবেদনশীল কন্টেন্ট সংক্রান্ত সতর্কবার্তা দেওয়া, পোস্টটি প্রকাশ করা থেকে সরিয়ে দেওয়া যাতে শুধুমাত্র ব্লগের লেখকই এটি দেখতে পান, আপত্তিকর কন্টেন্ট, পোস্ট অথবা ব্লগ মুছে দেওয়া, লেখকের ব্লগার বা গুগল অ্যাকাউন্ট অ্যাক্সেস বন্ধ করে দেওয়া, উপযুক্ত আইনি কর্তৃপক্ষের কাছে ব্যবহারকারীর বিরুদ্ধে অভিযোগ জানানো। অন্যদিকে এসব সাইটের অপতথ্যগুলো ফেসবুকে প্রচারের ক্ষেত্রে ভুয়া পরিচয় দিয়ে খোলা অ্যাকাউন্ট ও পেজ খোলা হয়েছে৷ মেটার ট্রান্সপারেন্সি সেন্টারে ফেক অ্যাকাউন্ট সম্পর্কে কঠিনভাবে সতর্ক বাণী দেওয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, তাদের লক্ষ্য ফেসবুক থেকে যতটা সম্ভব ভুয়া অ্যাকাউন্ট মুছে ফেলা। এর মধ্যে রয়েছে তাদের নীতি লঙ্ঘনের জন্য দূষিত উদ্দেশ্যে তৈরি করা অ্যাকাউন্টগুলো তারা দ্রুততম সময়ে মুছে ফেলার কাজ করেন৷ মেটার এ সংক্রান্ত নীতিমালা বেশ কঠোর হলেও বছরের পর বছর অন্যের নাম-পরিচয় ব্যবহার করে ভুয়া অ্যাকাউন্ট চালু থাকছে, বিস্তার চলছে অপতথ্যের জাল।