ছেলের বির্তকিত মন্তব্যের জেরে অপপ্রচারের শিকার মা

গত ১৫ মে (বৃহস্পতিবার) রাত আড়াইটার দিকে নিষিদ্ধঘোষিত সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সভাপতি সাদ্দাম হোসেনের বাবা মুক্তিযোদ্ধা আমিনুল হক মৃত্যুবরণ করেন। পরদিন (১৬ মে) দুপুর ৩টা ৪৩ মিনিটে বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদ (বাগছাস)-এর সহ-মুখপাত্র ফারদিন হাসান তার ব্যক্তিগত ফেসবুক প্রোফাইলে একটি পোস্ট দেন। ওই পোস্টে তিনি লেখেন, “সাদ্দামের বাবা মারা গেসে নিউজটা অসত্য। এদের সবার বাপ তো মারা গেসে সেই ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট।” ফারদিনের পোস্টের মন্তব্য ঘরেই তার পরিবারের নারী সদস্যদের, বিশেষ করে তিনি ও তার মায়ের একটি ছবি ঘিরে আওয়ামী লীগ সমর্থক হিসেবে পরিচিত একাধিক ফেসবুক প্রোফাইল থেকে আপত্তিকর মন্তব্য করা হয়।

উক্ত পোস্টের ২ ঘণ্টা পরেই ফেসবুকে ‘আমি ফারদিন, আমি আমার মা বোনকে বিক্রি করে এমবি কিনে ফেসবুক চালাই’ নামের একটি পেজ সক্রিয় হতে দেখা যায়। পেজটির ট্রান্সপ্যারেন্সি সেকশন অনুযায়ী, এটি ২০২৫ সালের ২০ জানুয়ারি ‘উর্দু কোচিং সেন্টার, বাংলাদেশ শাখা’ নামে তৈরি হয়েছিল। ১৬ মে, ফারদিনের আলোচিত পোস্টের পরেই পেজটির নাম পরিবর্তন করে বর্তমান নাম রাখা হয়। পেজটির প্রোফাইল ছবিতে ফারদিন ও তার মায়ের ওই আলোচিত ছবিটি ব্যবহার করা হয়। কভার ছবিতে ফারদিনসহ তার পরিবারের নারী সদস্যদের আরও একটি ছবি যুক্ত করা হয়।

নাম পরিবর্তনের পর থেকেই পেজটিতে ফারদিনের সঙ্গে বিভিন্ন নারীর ছবি সংগ্রহ করে আপত্তিকর ক্যাপশনসহ পোস্ট (, , ) করা হচ্ছে। এর মধ্যে ফারদিনের মায়ের সঙ্গে তার শৈশবের একটি ছবিও রয়েছে।

১৬ মে রাত ৯টা ২৯ মিনিটে ফারদিন ও তার মায়ের চুম্বনের দৃশ্য দাবিতে পেজটিতে একটি ভিডিও পোস্ট করা হয়। তবে বিশ্লেষণে জানা যায়, ভিডিওটি বাস্তব নয়। ফারদিন ও তার মায়ের ছবি ব্যবহার করে এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানারের পর্যবেক্ষণে ভিডিওটিতে এআই ব্যবহারের একাধিক লক্ষণ পাওয়া গেছে। যেমন: কিছু ফ্রেমে হাতের আঙুল গায়েব হয়ে যাওয়া বা আকৃতি পরিবর্তন, মুখের নড়াচড়া থাকলেও শরীরের ভঙ্গি অপরিবর্তিত থাকা এবং পোশাকের গঠন একরকম থাকা। বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে ভিডিওটি ডিপফেক শনাক্তকারী ‘ডিপফেক-ও-মিটার’ টুলের মাধ্যমে যাচাই করা হয়। টুলটির ‘DSP-FWA (2019)’ মডেল অনুযায়ী, ভিডিওটিতে এআই ব্যবহারের সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ। একই টুলের আরও চারটি ভিন্ন মডেলেও ভিডিওটি এআই প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি হওয়ার প্রবল সম্ভাবনা (৭০ শতাংশের বেশি) শনাক্ত হয়।

Screenshot: Deepfake-O-Meter.

১৭ মে ফেসবুক পেজটিতে লাল শাড়ি পরা এক নারীর ছবি পোস্ট করে দাবি করা হয়, এটি ফারদিন হাসানের মায়ের। তবে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, ছবিটি অন্য একজন নারীর। রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে ছবি শেয়ারিং প্ল্যাটফর্ম ইমগুরে ছবিটির মূল সংস্করণ পাওয়া যায়। মূল ছবিতে থাকা নারীর মুখ ফারদিনের মায়ের সঙ্গে মেলে না। দুই ছবির তুলনামূলক বিশ্লেষণে নিশ্চিত হওয়া গেছে, ইন্টারনেট থেকে সংগ্রহ করা ওই নারীর ছবিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তির ‘ফেস-সোয়াপ’ পদ্ধতি ব্যবহার করে ফারদিনের মায়ের মুখ বসিয়ে প্রচার করা হয়েছে।

Comparison: Rumor Scanner.

একই দিন ফেসবুক পেজটিতে ফারদিনের মায়ের ছবি দাবি করে আরও দুটি (, ) ছবি পোস্ট করা হয়। তবে, অনুসন্ধানে জানা গেছে, এই ছবিগুলো এআই প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি। এআই কনটেন্ট শনাক্তকারী টুল সাইট ইঞ্জিনের বিশ্লেষণে দেখা যায়, ছবিগুলোতে ‘ফেস ম্যানিপুলেশন’ বা মুখ বিকৃতির সম্ভাবনা ৯৯%। প্ল্যাটফর্মটি এগুলোকে সম্ভাব্য ডিপফেক হিসেবে চিহ্নিত করেছে।

গত ১৬ এপ্রিল থেকে এই ফেসবুক পেজ থেকে অপপ্রচার শুরু হয়। এই প্রতিবেদন লেখার সময় (২১ মে) পর্যন্ত চার দিন পেরিয়ে গেলেও আপত্তিকর কনটেন্টগুলো ফেসবুক থেকে সরানো হয়নি। এমনকি পেজটি থেকে ছড়ানো আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও শুধু এখানেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, বরং অন্যান্য ফেসবুক পেজ ও ব্যক্তিগত প্রোফাইলেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে ফারদিন ও তার মায়ের চুম্বনের দৃশ্য দাবি করে প্রচারিত এআই-তৈরি ভিডিওটি ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। 

রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, একটি আপত্তিকর কনটেন্ট প্রচারকারী ফেসবুক প্রোফাইলে ওই ভিডিওটি প্রকাশের পর ১০ হাজার ভিন্ন ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়। ভিডিওটি ৮ লাখ ৫২ হাজার বার দেখা হয়। ভিডিওটিকে সত্য মনে করে অনেক ফেসবুক ব্যবহারকারী মন্তব্যের ঘরে ফারদিন ও তার মাকে উদ্দেশ্য করে আপত্তিকর ভাষায় মন্তব্য করেছেন।

এই ঘটনাটি ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে নারীদের বিরুদ্ধে অপতথ্য ও বিকৃত কনটেন্টের ধারাবাহিক প্রচারণার একটি উদাহরণ মাত্র। সামাজিক মাধ্যমে নারীরা ক্রমশ এআই-জনিত ডিপফেক, ম্যানিপুলেটেড ছবি ও ভিডিওর মাধ্যমে টার্গেট হচ্ছেন। এসব কনটেন্ট প্রায়শই পরিকল্পিতভাবে ছড়ানো হয়, যা ভুক্তভোগীদের ব্যক্তিগত ও পেশাগত জীবনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষতি করে। এর ফলে মানহানি, সামাজিক কলঙ্কের পাশাপাশি নিরাপত্তাহীনতা, মানসিক চাপ এবং আত্মমর্যাদা হারানোর ভয় তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ, চলতি বছরের এপ্রিলে লালমনিরহাটে এআই-তৈরি একটি আপত্তিকর ভুয়া ভিডিওর কারণে এক নববধূ আত্মহত্যা করেন। রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, এটি কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়, বরং ফারদিনের রাজনৈতিক মতামতের জেরে তার মাকে লক্ষ্য করে পরিচালিত একটি পরিকল্পিত অপপ্রচারের অংশ। রিউমর স্ক্যানার আশঙ্কা প্রকাশ করেছে যে, প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে এ ধরনের হেনস্তা ভবিষ্যতে আরও ব্যাপক হতে পারে, যা মোকাবিলায় জরুরি পদক্ষেপ প্রয়োজন।

তথ্যসূত্র

  • Rumor Scanner’s analysis.
  • Sightengine.
  • Deepfake-O-Meter.

আরও পড়ুন

spot_img