‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাজ্য’ বিষয়ে সম্প্রতি কতিপয় গণমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করেছে। বিষয়টি নিয়ে সংবাদ প্রকাশ করেছে এমন গণমাধ্যমের মধ্যে রয়েছে দৈনিক ইত্তেফাক, আজকের পত্রিকা, বাংলাদেশ জার্নাল, এটিএন বাংলা ইত্যাদি।
এটিএন বাংলা গত ১২ ফেব্রুয়ারি তাদের ইউটিউব চ্যানেল এবং ফেসবুক পেজে এই বিষয়ের উপর একটি ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করে। দৈনিক যায়যায়দিন “বাংলাদেশে যে কোনো সময় বড় ধরনের স’ন্ত্রাসী হা’মলা শঙ্কা” শিরোনামে এবং দ্য ডেইলি ক্যাম্পাস বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হাম’লার আশঙ্কা, সতর্ক করল যুক্তরাজ্য’ শিরোনামে ভিডিও প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, “বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা প্রকাশ করে সতর্কতা জারি করেছে যুক্তরাজ্য। দেশটি বাংলাদেশে অবস্থানরত ও আগত ব্রিটিশ নাগরিকদের সতর্ক থাকার পরামর্শ দিয়েছে। ব্রিটিশ সরকারের মতে, বাংলাদেশে ব্রিটিশ নাগরিক ও যুক্তরাজ্যের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট স্থাপনাগুলোতে হামলার ঝুঁকি রয়েছে।”
দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিবেদনে যুক্তরাজ্য কত তারিখে এই সতর্কতা জারি করে সে বিষয়ে কোনো তথ্য উল্লেখ করেনি। তবে রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, গত বছরের, (২০২৪) ০৩ ডিসেম্বর একই বিষয়ে ‘বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার ঝুঁকি নিয়ে ভ্রমণ সতর্কতা যুক্তরাজ্যের’ শিরোনামে আরো একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল তারা, যেখানে সতর্কতা জারির ঘটনাটি ৩ ডিসেম্বর এর বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
বিষয়টি নিয়ে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধান
অনুসন্ধানে বিদেশ ভ্রমণকারী ব্রিটিশ নাগরিকদের জন্য ট্রাভেল এডভাইস প্রদানকারী যুক্তরাজ্যে সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগের এক্স হ্যান্ডেল FCDO Travel Advice পর্যালোচনা করে দেখা যায়, বাংলাদেশে ভ্রমণের জন্য গত বছরের ১৮ জুলাই থেকে এ বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় ২০ বার উক্ত ওয়েবসাইট তাদের ট্রাভেল এডভাইস হালনাগাদ করেছে। এসব হালনাগাদে মূল নিদর্শনগুলো প্রায় একইরকম থাকতে দেখা গেছে, মূলত সমসাময়িক ঘটনাপ্রবাহগুলো হালনাগাদ করে প্রতিক্ষেত্রে যুক্ত করা হয়েছে। যেমন, গত ৩ ডিসেম্বরের পর চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি এবং ৩১ জানুয়ারি বিশ্ব ইজতেমার তথ্য যুক্ত করে হালনাগাদ করা হয়েছে। ওয়েবপেজটি ৩১ জানুয়ারি সর্বশেষ হালনাগাদ হয়েছে।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর এর হালনাগাদকৃত তথ্যের ভিত্তিতে বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা বিষয়ক সংবাদ সেসময় বিভিন্ন গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়। এছাড়াও, সোশ্যাল মিডিয়ায় বিষয়টি নিয়ে নানান আলোচনা সৃষ্টি হয়। এটির ভিত্তিতে বাংলাদেশের পরিস্থিতি নিয়ে বিভ্রান্তিকর অপপ্রচারও ঘটে।
গত বছরের ৩ ডিসেম্বর উক্ত অংশে মূল্যায়ন হালনাগাদ করে ‘Terrorists are likely to try to carry out attacks in Bangladesh.’ দেওয়ার তথ্য পাওয়া যায়। উপরে উল্লিখিত এক্স হ্যান্ডেল পর্যালোচনা করে একই রকম মূল্যায়ন হালনাগাদ বিভিন্ন দেশের ক্ষেত্রে নিয়মিত হয়ে আসছে বলে দেখা গেছে।
যুক্তরাজ্যের সরকারি ওই ওয়েবসাইটে ফরেন ট্রাভেল এডভাইস শাখার বাংলাদেশ অংশের ‘সেফটি এন্ড সিকিউরিটি’ অংশের টেরোরিজম পার্টে ‘Terrorists are likely to try to carry out attacks in Bangladesh.’ উল্লেখ থাকায় এই বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা যুক্তরাজ্যের হিসেবে সংবাদ প্রকাশ করে।
তবে সম্প্রতি দেখা গেছে কতিপয় গণমাধ্যম নতুন কোনো হালনাগাদ ছাড়াই একই বিষয়ে ফেব্রুয়ারি মাসেও সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কার বিষয়ক সংবাদ প্রকাশ করেছে।
এদিকে অনুসন্ধানে দেখা গেছে, যে বাক্যের ভিত্তিতে যুক্তরাজ্যের সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কার বিষয়ে সংবাদ গত ডিসেম্বরে এবং চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে প্রচারিত হয়েছে, সেই একই লেখা , অর্থাৎ, ‘Terrorists are likely to try to carry out attacks in Bangladesh.’ বাক্যটি আগেও উক্ত অংশে ছিল। অনুসন্ধানে ২০২৩ সালেও একই বাক্যটি উক্ত অংশে খুঁজে পাওয়া গেছে।

আরো অনুসন্ধানে, এর পূর্বে ২০২২, ২০২১, ২০২০, ২০১৯ এবং অন্তত ২০১৮ সাল পর্যন্তও উক্ত ওয়েবসাইটের ‘টেররিজম’ অংশে “Terrorists are very likely to try to carry out attacks in Bangladesh.” এই বাক্যটির উল্লেখ পাওয়া গেছে।
অর্থাৎ, সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা সংক্রান্ত এই বিবৃতিটি আগেও ছিল (কিংবা আগে থেকেই ছিল)।
এছাড়া, শুধু বাংলাদেশের ক্ষেত্রেই নয়, একই রকম বাক্যের উল্লেখ ভারত, ইন্দোনেশিয়া, বেলজিয়াম, কানাডা, ফ্রান্স, জার্মানি, কুয়েত, রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা এবং স্পেনের মতো দেশগুলোর জন্যও উল্লেখ রয়েছে বলে অনুসন্ধানে দেখা যায়।
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বর্তমানে ‘Terrorists are likely to try to carry out attacks’ উল্লেখ থাকলেও, ভারতসহ কয়েকটি দেশের ক্ষেত্রে এই অংশে ‘Terrorists are very likely to try to carry out attacks’ উল্লেখ রয়েছে।

অনুসন্ধানে জানা গেল, বাংলাদেশে সন্ত্রাসী হামলার আশঙ্কা সংক্রান্ত যুক্তরাজ্যের ট্রাভেল এডভাইস আগেও ছিল এবং এটি সাম্প্রতিক নতুন কোনো সতর্কবার্তা নয়। অন্তত ২০১৮ সাল থেকে একই ধরনের বার্তা সেখানে উল্লেখ রয়েছে, তবে সংবাদ প্রতিবেদনগুলোতে এই প্রেক্ষাপট উল্লিখিত হয়নি। এছাড়া, বাংলাদেশের মতো অন্যান্য বিভিন্ন দেশেও একই ধরনের সতর্কতা রয়েছে, কিন্তু এসব প্রতিবেদনে সে বিষয়টিও উল্লেখ করা হয়নি। ফলে অনেকে এটি সম্প্রতি দেওয়া একদম কোনো নতুন সতর্কতা এবং এমন সতর্কতা কেবল বাংলাদেশের জন্যই দিয়েছে বলে মনে করতে পারে, যা বাস্তবতার চেয়ে অতিরিক্ত উদ্বেগ তৈরি করতে পারে। যথাযথভাবে প্রেক্ষাপটের উল্লেখ এবং তুলনামূলক বিশ্লেষণ না থাকায় এই ধরনের অসম্পূর্ণ সংবাদ পরিবেশন বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে ভুল ধারণা সৃষ্টি করতে পারে। এই সংবাদগুলোর প্রেক্ষিতে সামাজিক মাধ্যমে ‘বাংলাদেশে যে কোন সময় বড় ধরনের সন্ত্রাসী হামলা হতে পারে’ শীর্ষক বিভিন্ন রকম পোস্ট, কমেন্টস হয়েছে, যেগুলোতে বিভ্রান্তি এবং ভীতি তৈরি হতে দেখা গেছে। যার ফলে রিউমর স্ক্যানার এই প্রতিবেদনগুলি বিভ্রান্তিকর হিসেবে মনে করে।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s Analysis
- GOV. UK website
- FCDO Travel Advice X handle