ঘূর্ণিঝড়ের সময় জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠানো হয় কেন?

বাংলাদেশের মতো দুর্যোগপ্রবণ দেশের জন্য ঘূর্ণিঝড় একটি আতঙ্কের নাম। ঘূর্ণিঝড়ের সময় বিভিন্ন ধরণের ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কা থাকে। এ সময় জনজীবনের পাশাপাশি স্থাপনার বহু ক্ষয়ক্ষতির উদাহরণ খুঁজে পাওয়া যায়। ঘূর্ণিঝড়ের সময়টায় খেয়াল করলে হয়ত দেখবেন,   জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। কিন্তু কেন এমন নির্দেশনা? 

সম্প্রতি বাংলাদেশে আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় মোখা। সে সময় জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো’র এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ঘূর্ণিঝড় মোখা মোকাবিলার অংশ হিসেবে চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরের জেটি থেকে পণ্যবাহী ১৮টি জাহাজ সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের ‘Cyclone Disaster Preparedness and post Cyclone Rehabilitation Plan-1992‘ অনুযায়ী ঘূর্ণিঝড়ের সিগন্যাল- ৫ এ গেলেই জেটি এবং চ্যানেলের সুরক্ষার্থে জেটির ভেতরের জাহাজগুলোকে বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

সোর্সঃ চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ

সিগন্যাল-৫ এ বলা আছে, বন্দর ছোট বা মাঝারি তীব্রতর এক সামুদ্রিক ঝড়ের কবলে পড়বে। ঝড়ে বাতাসের সর্বোচ্চ একটানা গতিবেগ ঘণ্টায় ৬২-৮৮ কিলোমিটার। ঝড়টি বন্দরকে বাঁ দিকে রেখে উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

জেটি থেকে কেন জাহাজ সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তা জানতে চাইলে বন্দর সচিব ওমর ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, বড় জাহাজগুলো জেটিতে থাকলে ঢেউয়ের কারণে জেটি ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তবে সাগরে জাহাজগুলো ইঞ্জিন চালু রেখে ঢেউ বা ঝড়ের সঙ্গে ভারসাম্য রক্ষা করে ভাসতে পারে। এ জন্য সম্ভাব্য দুর্ঘটনা এড়াতে বড় জাহাজগুলো সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। 

Screenshot: Prothom Alo

ইন্টারন্যাশনাল মেরিটাইম অর্গানাইজেশন এর মতে জাহাজ সাগরে নিরাপদ থাকে। সুপার সাইক্লোন বা হেভিং টো হলে সাগরে জাহাজ ঢেউয়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলতে পারবে, ঢেউ চলে যাওয়ার পর পানিতে আছড়ে পড়বে কিন্তু ডুবে যাবে না। এতে জাহাজে থাকা মালামালও সুরক্ষিত থাকবে।

এসময় জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠিয়ে না দিলে বিপদ বাড়ে। কেননা বর্হিনোঙরে সাধারণ গভীরতা ১০ মিন্টার বা তার আশপাশে। জোয়ারের পানিতে জলোচ্ছ্বাসের ফলে পানির উচ্চতা বৃদ্ধি পেলে তখন ঢেউয়ের ধাক্কায় জাহাজ উপরে উঠে যায়। পরবর্তীতে জাহাজ যখন নিচে নামে সেসময় জাহাজের তলা ফেটে যেতে পারে। ঘূর্ণিঝড়ের সময় জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠানোর এটা অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কারণ। তাই এ আশঙ্কা এড়াতে সাধারণত বন্দর থেকে জাহাজগুলোকে সমুদ্রে ২ হাজার মিটার বা তার বেশি গভীরতায় পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

ঘূর্ণিঝড়ের সময় বন্দরের সুরক্ষার জন্যও জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, যা চট্টগ্রাম বন্দর সচিব ওমর ফারুকের কথাতেই স্পষ্ট। বিশেষজ্ঞদের মতে, জাহাজ বন্দরে থাকলে তীব্র ঝড়ের ফলে সৃষ্ট ঢেউয়ে জাহাজগুলো একটা আরেকটার সাথে প্রচণ্ড ধাক্কা লেগে ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাবনা  তৈরি হতে পারে। এতে বন্দরে রাখা বিভিন্ন প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের ক্ষতি হতে পারে।

এছাড়াও এতে বন্দরের জ্বালানি রাখার স্থান ক্ষতিগ্রস্ত হলে বড় ধরনের বিপদের আশঙ্কা তৈরি হয়। এতে বহুমানুষের প্রাণনাশের সম্ভবনা তৈরি হতে পারে।  

জাহাজ ঠিকমতো চলাচলের চ্যানেলের সুরক্ষা প্রয়োজন। প্রত্যেকটি বন্দরে জাহাজ চলাচলের জন্য আলাদা একটা চ্যানেল থাকে। ঘূর্ণিঝড়ের সময়ে জাহাজগুলো সমুদ্রে পাঠানোর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কারণ হল, ঢেউ বা তীব্র গতির ঝড়ের ফলে বড় জাহাজ বন্দর চ্যানেলে ডুবে গেলে সেই জাহাজ না সরানো পর্যন্ত নৌযান চলাচল বন্ধ হয়ে যেতে পারে। তাছাড়া পরবর্তীতে ডুবে যাওয়া জাহাজ সরানো বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ ব্যাপার।

২০১৭ সালে চট্রগ্রামের আনোয়ারা সৈকতে ক্রিস্টাল গোল্ড নামে একটি জাহাজ আটকা পড়ে। পরবর্তীতে সেটিকে আর সমুদ্রে নেওয়া সম্ভব হয়নি। ১৯২ মিটার দৈর্ঘ্যের বিশালাকৃতির জাহাজটি দীর্ঘদিন আটকে থাকায় প্রায় ৫০০ মিটার জায়গায় পলি জমে যায়৷ পরবর্তীতে ২০২১ সালে জাহাজটি কেটে ফেলা হয়।

Screenshot: The Daily Star

বিভিন্ন স্থাপনার সুরক্ষার ঘূর্ণিঝড়ের সময় জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠানো হয়। ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রে জাহাজ পাঠানো না হলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা থাকে। ১৯৯১ সালে ঘূর্ণিঝড়ের সময় কর্ণফুলী নদীর শাহ আমানত সেতুর মাঝখানের একটি বড় অংশ ভেঙে যায়। সেসময় একটি জাহাজের ধাক্কায় সেতুর মাঝখানের অংশ নদীতে বিলীন হয়ে যায়। 

Screenshot: bdnews24.com

এ ঘটনার পর থেকে বাংলাদেশে সমুদ্রে জাহাজ পাঠানোর নিয়মটি কঠোরভাবে পালন করা হয়। 

গভীর সমুদ্রে জাহাজ পাঠানো নিয়ে সংশ্লিষ্টরা কী বলছেন?

ঘূর্ণিঝড়ের সময় সমুদ্রে জাহাজগুলোকে পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে চট্টগ্রাম বন্দর সচিব মো. ওমর ফারুক রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, “Cyclone Preparedness Plan অনুযায়ী আমরা যখন সাইক্লোন আসার পূর্বাভাস পাই তখন ওই প্ল্যান অনুযায়ী আমার সব রকম ব্যবস্থা নেই। সিগন্যাল বাড়লে কী রকম ব্যবস্থা নেওয়া হবে Cyclone Preparedness Plan এ সবকিছু বলা আছে। কখন জাহাজগুলো বের হয়ে যাবে, কখন জাহাজগুলো ফেরত আনবো সবকিছু। এখানে আমাদের কিছু নিজস্ব এলার্ট আছে। সিগন্যাল- ৫ এ গেলে আমরা জেটি এবং চ্যানেলের সুরক্ষার্থে জেটির ভেতরের জাহাজগুলোকে বহির্নোঙরে পাঠিয়ে দেই। যদি না পাঠাতাম, তাহলে ঝড়, তুফানের কারণে জাহাজগুলো জেটির ক্ষতি করবে নয়তো চ্যানেলে ডুবে গিয়ে চ্যানেল ব্লক হয়ে যেতে পারে।”

ঘূর্ণিঝড়ের সময় জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠানোর বিষয়ে জানতে চাইলে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোস্টাল স্টাডিজ অ্যান্ড ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান ড. হাফিজ আশরাফুল হক রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, ‘বড় বড় ওয়েভ বা ব্রেক ওয়াটার জোন থেকে ঢেউটা প্রডিউস হয়। আমরা যদি ব্রেক ওয়াটার জোনে গভীরে সমুদ্রে জাহাজগুলোকে পাঠিয়ে দিতে পারি তাহলে ক্ষয়ক্ষতি এড়ানো যাবে। আমরা যদি জাহাজগুলোকে গভীর সমুদ্রে পাঠাই তাহলে জাহাজগুলো সেইফ থাকবে।’

এছাড়াও বিশেষজ্ঞদের মতে, বিশ্বের সব পণ্যবাহী বড় জাহাজে দুটি ইঞ্জিন কার্যকর থাকে। দুই ইঞ্জিন চালিয়ে অনেক বড় বড় ঢেউয়ের সাথে তাল মিলিয়ে জাহাজ চলাচল করতে পারে। নাবিকরা ঝড়ের সময় একটি বিশেষ কৌশলে নির্দিষ্ট গতিতে জাহাজ চালিয়ে ভারসাম্য বজায় রাখেন। এতে বন্দরের চেয়ে গভীর সমুদ্রে বেশি সুরক্ষিত থাকে জাহাজগুলো। 

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর অবসরপ্রাপ্ত ক্যাপ্টেন জাহিদুল করিম আকন্দ গণমাধ্যমকে বলেছেন, ‘বঙ্গোপসাগর বা আরব সাগরে ঘূর্ণিঝড়ে গতিপথের অঞ্চল ছাড়া সাধারণত গভীর সমুদ্রের চাইতে তীরবর্তী অঞ্চলের পানি বেশি ঝঞ্জাক্ষুব্ধ হয়। এত বড় জাহাজগুলো জেটিতে বাঁধা থাকলে প্রচণ্ড ঝড়ে একটি আরেকটির ওপর আছড়ে পড়ে বা ধাক্কা খেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হতে পারে। শুধু জাহাজই নয়, শক্তিশালী এই ধাক্কায় বন্দরেরও ক্ষয়ক্ষতি হতে পারে। এছাড়া বন্দরের চ্যানেলে যদি কোনো জাহাজ ডুবে যায় তবে বন্দরে জাহাজ আসা-যাওয়া বন্ধ হওয়ার আশঙ্কাও থাকে। এজন্য আন্তর্জাতিক মেরিটাইম স্ট্যান্ডার্ড অপারেটিং প্রসিডিউর (এসওপি) অনুযায়ী ল্যান্ড লক এরিয়া বা প্রাকৃতিকভাবে বেষ্টিত সুরক্ষিত নৌবন্দর না থাকলে বিশ্বের সর্বত্রই ঝড়ের সময় বড় জাহাজকে গভীর সাগরে পাঠিয়ে দেওয়া। আর তুলনামূলক মাঝারি ও ছোট জাহাজ ও জলযানকে তীরের কাছাকাছি থাকতে বলা হয়।’

সুতরাং, জাহাজের সুরক্ষা, বন্দরের সুরক্ষা, চ্যানেলের সুরক্ষা এবং স্থাপনার সুরক্ষা সহ অন্যান্য সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতি এড়াতেই ঘূর্ণিঝড়ের সময় জাহাজগুলোকে সমুদ্রে পাঠিয়ে দেওয়া হয়।

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img