কাতারে চলছে ফুটবল বিশ্বকাপ। বিশ্বকাপের শিরোপার লড়াইয়ে অংশগ্রহণকারী দেশগুলো লড়ছে সমানতালে। তবে সেই লড়াইয়ে বরাবরের মতোই বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে ফুটবলের অফসাইড নিয়ম৷ অফসাইডের ফাঁদে পড়ে বাতিল হয়ে যাচ্ছে দলগুলোর কষ্টার্জিত গোল।
এই অফসাইডকে আরও কঠিন করে তুলেছে তথ্য-প্রযুক্তির ব্যবহার। ফলে অফসাইড নিয়ে দর্শকদের মধ্যে বিশ্বকাপ শুরু থেকেই চলছে তর্ক-বিতর্ক। এই তর্ক-বিতর্কেরই একটি অংশ ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলের সময়ে অফসাইড থাকা না থাকা নিয়ে৷ সমর্থকদের একটি অংশের দাবি, পেলে যে সময়ে খেলেছেন, সেই সময়ে অফসাইডের নিয়ম ছিল না।
এমন দাবি সংক্রান্ত দীর্ঘদিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।
বিপরীতে এই দাবির পক্ষে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ব্যঙ্গ করার নজিরও আছে৷
তবে পেলের সময় কি প্রকৃতপক্ষে ফুটবলে অফসাইড ছিল? ফুটবলে অফসাইড নিয়ম কখন চালু হয়? অফসাইড নিয়মটাই বা কি আসলে?
পেলের সময় কি প্রকৃতপক্ষে ফুটবলে অফসাইড ছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর অনুসন্ধানে খেলাধুলা ভিত্তিক ওয়েবসাইট Sportskeeda.com এ ২০২০ সালের ৫ মে “10 Famous football myths debunked” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানায়, ব্রাজিল কিংবদন্তি পেলে খেলার সময় অফসাইড ছিল না, তাই তিনি বেশি গোল করতে পেরেছেন। এটা মূলত একটি মিথ বা উপাখ্যান।
প্রকৃতপক্ষে পেলে তার ফুটবল ক্যারিয়ার শুরু করেছিলেন ১৯৫৭ সালে। তখনও ফুটবলে অফসাইডের নিয়ম ছিল। শুধু তাই নয়, বর্তমানে অফসাইডের যেসব নিয়ম দেখা যায়, পেলের সময় অফসাইডের নিয়ম তার চেয়ে বেশি কঠোর ছিল।
প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, ফুটবলে অফসাইড নিয়ম চালু হয়েছিল ১৮৬৩ সালে৷ পরবর্তীতে দুই দফায় ১৯২৫ ও ১৯৯০ সালে নিয়মটি পরিবর্তন করা হয়।
পেলের ক্যারিয়ার শুরুর পূর্বে অফসাইড নিয়ম প্রয়োগের উদাহরণ
অনুসন্ধানে পাওয়া sportskeeda এর তথ্যের সত্যতা মিলে ফিফা ফুটবল বিশ্বকাপ ১৯৫৪ এর ফাইনাল ম্যাচেও অফসাইডের কারণে হাঙ্গেরির ফেরেঞ্চ পুসকাস নামে এক খেলোয়াড়ের গোল বাতিল হয়েছিল।
১৯৫৪ বিশ্বকাপের এই ফাইনালে মুখোমুখি হয়েছিল তৎকালীন পূর্ব জার্মানি ও হাঙ্গেরি৷ খেলায় ৩-২ গোলে এগিয়েছিল পূর্ব জার্মানি৷ তবে শেষ মুহূর্তে ৮৮ মিনিটে হাঙ্গেরির ফেরেঞ্চ পুসকাস সমতাসূচক গোল দেয়। তবে অফসাইডে রেফারি গোলটি বাতিল করে দেয়।
অর্থাৎ, ব্রাজিলের পেলে তার ক্যারিয়ার শুরুর পূর্ব থেকেই ফুটবলে অফসাইড নিয়ম চালু ছিল এবং এজন্য গোল বাতিলের ঘটনাও ঘটেছে।
ফুটবলে অফসাইড নিয়মের সূচনা
ফুটবলে অফসাইড নিয়মের সূচনা অনুসন্ধানে অলিম্পিকের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত “Offside in football: Rules and how they work” শীর্ষক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৮৬৩ সালে সর্বপ্রথম অফসাইড চালু করা হয়। এই নিয়মটি চালু করেছিল বিশ্ব ফুটবলের নিয়ন্ত্রক সংস্থা ফিফা, ইউরোপীয় ফুটবলের নিয়ন্ত্রক উয়েফার সদস্য ও ফুটবলের বিভিন্ন নিয়ম-নীতি নিয়ে কাজ করা ইন্টারন্যাশনাল ফুটবল এসোসিয়েশন বোর্ড (আইএফএবি) এর স্থায়ী সদস্য The Football Association।
এই নিয়মটি করা হয়েছিল খেলোয়াড়দের গোল করার সুযোগ খুঁজতে সবসময় প্রতিপক্ষের গোলের কাছে লুকিয়ে থাকা থেকে বিরত রাখার উদ্দেশ্যে।
অফসাইডের নিয়মের বিবর্তন
অফসাইড চালুর সময়ে নিয়মটি ছিল, প্রতিপক্ষের গোলকিপার সহ তিনজন খেলোয়াড় সামনে থাকতে হত। এর কম হলেই অর্থাৎ যদি সামনে একজন খেলোয়াড় এবং গোলকিপার থাকত তাহলেই অফসাইড ধরা হত। অফসাইডের এই নিয়ম ১৯২৫ সাল পর্যন্ত কার্যকর ছিল।
তবে এরপর এই নিয়মে পরিবর্তন এনে তিনজনের পরিবর্তে সামনে প্রতিপক্ষের গোলকিপার সহ অন্তত দুজন খেলোয়াড় থাকার নিয়ম করা হয়, যা ১৯৯০ সাল পর্যন্ত চালু ছিল। এরপর অফসাইডের নিয়মে আরও কিছু পরিবর্তন আসে যা এখনো চলমান।
বর্তমান সময়ে অফসাইডের নিয়ম হচ্ছে, আক্রমণে আসা দলের কোনো খেলোয়াড় যদি প্রতিপক্ষ দলের ডিফেন্ডারদের তৈরি করা সমান্তরাল রেখার আগে চলে যায়, তখন সেটি অফসাইড হিসেবে ধরা হয়।
অর্থাৎ আক্রমণকারী দলের কোনো খেলোয়াড় বল ছাড়া প্রতিপক্ষ দলের কোনো ডিফেন্ডারের আগে যেতে পারবেন না। তাকে বল নিয়ে প্রতিপক্ষ দলের ডিফেন্ডারকে পার হতে হবে অথবা বল গ্রহণের সময় ডিফেন্ডারের সমান্তরালে বা পেছনে থাকতে হবে। যদি এর ব্যত্যয় ঘটে তখনই সেটি অফসাইড হিসেবে বিবেচিত হবে।
অলিম্পিকের ওয়েবসাইটে প্রদত্ত ছবিটি থেকে এটি আরও ভালোভাবে বুঝা যায়।
বর্তমান অফসাইড নিয়ম অনুযায়ী, সাদা লাইনের বাইরে অবস্থানরত খেলোয়াড়টি অফসাইড অবস্থানে রয়েছে। ফলে এই মুহূর্তে কোনো গোল হলে সেটি অফসাইড হিসেবে বাতিল হয়ে যাবে।
উল্লেখ্য, ফুটবলে অফসাইড নিয়মকে আরও যুতসইভাবে কার্যকর করতে ফিফা ২০১৬ সালে ভিডিও অ্যাসিস্টেন্ট রেফারি (ভিএআর) নামে নতুন প্রযুক্তির সূচনা ঘটায়। এটি খেলার ভিডিও রিপ্লের মাধ্যমে মাঠের রেফারিকে বিশেষ করে অফসাইডের ক্ষেত্রে সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে সাহায্য করে থাকে।
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ফুটবলে অফসাইডের যে নিয়ম সেটি দেড়শ বছরেরও বেশি সময় ধরে চালু আছে এবং এই নিয়ম নানা বিবর্তনের মধ্য দিয়ে বর্তমান রূপে এসে পৌঁছে। এই হিসেবে ব্রাজিলের কিংবদন্তি ফুটবলার পেলে যেহেতু গত শতাব্দীরই খেলোয়াড়, সুতরাং তাঁর সময়ে ফুটবলে অফসাইড নিয়ম ছিল না, এই তথ্যটি সঠিক নয়।
মূলত, পেলে ১৯৫৭ সালে ফুটবলে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন৷ অপরদিকে ফুটবলে অফসাইড নিয়ম চালু হয় ১৮৬৩ সালে। কেবল শুরুই নয়, বিশ্বকাপের মতো বড় মঞ্চেও নিয়মটির প্রয়োগ দেখা যায়। তবে সময়ে সময়ে দুই দফায় নিয়মটির পরিবর্তন হলেও পেলের ক্যারিয়ার শুরুর পর থেকে অফসাইডের নিয়ম সবসময় কার্যকর ছিল।
সুতরাং, ‘পেলের সময় অফসাইড নিয়ম ছিল না’ শীর্ষক দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Sportskeeda.com: 10 Famous football myths debunked
- Olympic.com: Offside in football: Rules and how they work
- Dw.com: The Miracle of Bern: West Germany’s run to 1954 World Cup win
- Pavilion.com: অফসাইডের যত নিয়ম