দ্রব্যমূল্যের লাগামহীন উর্ধ্বগতিতের প্রভাবে জনজীবন অতিষ্ঠ। নিম্ন বিত্ত হতে শুরু করে উচ্চ বিত্ত সকলের কপালেই পরেছে চিন্তার ভাঁজ। তবে এই সমস্যা শুধু বাংলাদেশের গণ্ডির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির প্রভাবে টালমাটাল বিশ্ব অর্থনীতি। দেশে দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পণ্যদ্রব্যের দাম। বিশ্ব জুড়ে খাদ্যের জন্য হাহাকার বেড়েই চলছে।
চলমান এই বাস্তবতায়, গত ০৭ জুন প্রকাশিত বিশ্ব ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে-
২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রবৃদ্ধি ১.২% থেকে ২.৯% হ্রাস পেতে পারে। বিশ্ব “দুর্বল প্রবৃদ্ধি এবং উচ্চ মূল্যস্ফীতির একটি প্রলম্বিত সময়ের মধ্যে” প্রবেশ করছে
বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদনে আরো বলা হয়েছে-
মুদ্রাস্ফীতির বিপদ আজ উল্লেখযোগ্য। বিশ্বের বেশিরভাগ অংশে দুর্বল বিনিয়োগের কারণে প্রশমিত প্রবৃদ্ধি সম্ভবত পুরো দশক জুড়ে অব্যাহত থাকবে৷ মুদ্রাস্ফীতি এখন বহু দেশে বহু-দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ এবং সরবরাহ খুব ধীর গতিতে বাড়ছে । তবে সবচেয়ে মারাত্মক ঝুঁকি যেটা, তা হল মুদ্রাস্ফীতি দীর্ঘ সময় জুড়ে অব্যাহত থাকতে পারে।
মুদ্রাস্ফীতি কি?
মুদ্রাস্ফীতি বলতে কোনো দেশের অর্থনীতিতে মুদ্রার সরবরাহ বৃদ্ধি তথা মুদ্রার অবমূল্যায়নকেই বোঝানো হয়। অর্থাৎ, কোনো দেশের অর্থনীতিতে যখন মুদ্রার সরবরাহ বাড়ে কিন্তু একই সময়ে পণ্য ও সেবার সরবরাহ অপরিবর্তিত থাকে তখনই মূল্যস্ফীতি হয়। আর এই মূল্যস্ফীতি থেকেই মুদ্রাস্ফীতি ঘটে।
ইউরোপের অন্যতম বৃহৎ অর্থনীতির দেশ জার্মানিতে বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতির হার গত মে মাসে বেড়ে ৭ দশমিক ৯ শতাংশ হয়েছে। যা জার্মানির ৫০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ।
৪০ বছরের মধ্যে মুদ্রাস্ফীতির সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছেছে যুক্তরাজ্যে। দেশটিতে এক বছরে খাদ্যদ্রব্যের দাম বেড়েছে প্রায় ৭ শতাংশ।
বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির কারণ কি?
বিশ্বব্যাপী দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির পেছনে কি কি কারণ আছে তা জানার চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। বিষয়টি বিস্তর পর্যালোচনার পর আমরা যেই কারণগুলো জানতে পেরেছি তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলোঃ-
- কোভিড-১৯ মহামারির কারণে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা।
- রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে বিশ্বব্যাপী খাদ্যপণ্যের আমদানি-রপ্তানিতে ব্যাঘাত।
- জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বন্যা, খরা ও ঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগের কারণে বিশ্বজুড়ে খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস।
- নিজ দেশে পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশগুলো কর্তৃক পণ্য রপ্তানি নিষিদ্ধ।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে করোনো মহামারি ও রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাব:
করোনো মহামারির প্রকোপ ঠেকাতে ২০১৯ সালের শেষ হতে ২০২১ সালের শুরুর কয়েক মাস পর্যন্ত দেশে দেশে লকডাউন ও নানা বিধিনিষেধের কারণে স্থবির হয়ে পরেছিলো বিশ্ব অর্থনীতি। মহামারির ওই ভয়াবহ সময়ে বিধিনিষেধের কারণে এক দেশের সাথে অন্য দেশের সীমানা ও বিমান চলাচল বন্ধ থাকায় আমদানি নির্ভর দেশগুলোতে দেখা দেয় খাদ্য ঘাটতি। এছাড়াও পরিবহন সংকটের কারণে রপ্তানি কারক দেশগুলোতে বেড়ে যায় পণ্য পরিবহন খরচ। অন্যদিকে শ্রমিক সংকটের কারণে হ্রাস পায় পণ্যের উৎপাদন। এসব মিলিয়ে লাগামহীন ভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে পণ্যের মূল্য। করোনার মহামারির ধকল কাটিয়ে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন বুনছিলো ঠিক সেই সময়টাতেই শুরু হয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। একদিকে রাশিয়া বিশ্বের অন্যতম তেল ও গ্যাস রপ্তানিকারক রাষ্ট্র। অন্যদিকে ইউক্রেন বিশ্বের অন্যতম খাদ্য শস্য উৎপাদন ও রপ্তানিকারক রাষ্ট্র। চলমান যুদ্ধ পরিস্থিতিতে উভয় দেশের রপ্তানি কার্যক্রমই প্রায় স্থবির হয়ে পড়েছে। ফলে বিশ্ব জ্বালানি এবং খাদ্য নিরাপত্তায় পড়েছে নেতিবাচক প্রভাব। যার কারণে বিশ্বে অর্থনীতিতে মুদ্রাস্ফীতি এখন লাগামহীন। জ্বালানি ও খাদ্য মূল্য বৃদ্ধির সাথে অন্যান্য সকল পণ্যের পরিবহন ও উৎপাদন খরচ জড়িত বিধায় অন্যান্য পণ্যের মূল্যও লাফিয়ে বাড়ছে।

গত ১৮ মে, বিশ্বব্যাপী খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে এক বৈঠকে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস বিশ্ববাসীর জন্য সতর্কবার্তা দিয়ে বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনের যুদ্ধের প্রভাবে আসন্ন মাসগুলোতেই বিশ্বব্যাপী চরম খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে। যেখানে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে দরিদ্র দেশগুলো।
তিনি আরো বলেন, মূল্যবৃদ্ধির কারণে এর মধ্যে দরিদ্র দেশগুলো খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে রয়েছে। ইউক্রেনের খাদ্য রপ্তানি যুদ্ধ পূর্ববর্তী অবস্থায় না ফিরলে বিশ্বজুড়েই ক্ষুধা ও অপুষ্টি বাড়বে। এমনকি বিশ্ব দুর্ভিক্ষের মুখেও পড়ে যেতে পারে, যা কয়েক বছর পর্যন্ত চলমান থাকবে।
জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, গেল এক বছরে বিশ্ববাজারে খাদ্যমূল্য প্রায় ৩০ শতাংশ বেড়েছে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব:
জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্বব্যাপী বন্যা, খরা ও ঝড়সহ নানা প্রাকৃতিক দূর্যোগে ব্যাহত হচ্ছে শস্য উৎপাদন প্রক্রিয়া। ফলে সৃষ্টি হচ্ছে খাদ্য সংকট। খাদ্যের চাহিদা চেয়ে জোগান কম থাকায় বাড়ছে পণ্যের মূল্য।
জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে অস্বাভাবিকভাবে তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাওয়ায় পৃথিবীর অন্যতম খাদ্যশস্য উৎপাদনকারী রাষ্ট্র ভারতে প্রায় ৩০ শতাংশ খাদ্যশস্য উৎপাদন হ্রাস পেয়েছে।
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৃষ্টিপাত কমে গিয়ে খরা বৃদ্ধি পাওয়ায় খাদ্যশস্য উৎপাদন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে। ফলে খাদ্য সংকটে আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং সোমালিয়ায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয়। ভয়াবহ খরার ফলে সৃষ্টি দুর্ভিক্ষে এই অঞ্চলে ক্রমেই বাড়ছে ক্ষুধা মৃত্যুর হার। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক সংস্থা অক্সফাম এবং সেভ দ্য চিলড্রেন কর্তৃক প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন বলছে, ইথিওপিয়া, কেনিয়া এবং সোমালিয়ায় ক্ষুধার কারণে প্রতি ৪৮ সেকেন্ডে একজন মানুষ মারা যাচ্ছে।
সম্প্রতি রাষ্ট্রীয় খাদ্য সংকটের কারণে সৃষ্ট মানবিক বিপর্যয়ের ফলে আফ্রিকার দেশ ‘চাদ’ রাষ্ট্রীয়ভাবে ‘জাতীয় খাদ্য সংকট’ ঘোষণা করেছে।
দেশটির সরকার জানিয়েছে, দেশের খাদ্যভাণ্ডার শেষ হতে বসেছে। একদিকে ইউক্রেন ও রাশিয়া থেকে খাদ্যশস্য আসছে না, অন্যদিকে আবহাওয়ার কারণে নিজেদের দেশেও এবছর ফসল কম হয়েছে। ফলে যে কোনোদিন সংকট আরো বাড়তে পারে বলে মনে করা হচ্ছে।
দীর্ঘায়িত খরা এবং ধ্বংসাত্মক দাবানলে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং কানাডায় ব্যাপক পরিমাণ খাদ্যশস্য নষ্ট হয়েছে। তীব্র তাপমাত্রা ও ভারী বৃষ্টির ফলে ইউরোপের বৃহৎ গম রপ্তানিকারক রাষ্ট্র ফ্রান্সে গম উৎপাদন ব্যাহত হয়েছে।
দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধিতে বৃহৎ রপ্তানিকারক দেশগুলো কর্তৃক রপ্তানি নিষিদ্ধ বা সীমিতের প্রভাব
নিজ দেশে দ্রব্যমূল্যের দাম স্থিতিশীল রাখতে অর্থাৎ মুদ্রাস্ফীতির হাত থেকে নিজ দেশের জনগণকে বাঁচাতে বৃহৎ পণ্য রপ্তানিকারক দেশ কর্তৃক পণ্য রপ্তানি বন্ধ এবং রপ্তানির পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছে।
সম্প্রতি পৃথিবীর অন্যতম গম রপ্তানিকারক দেশ ভারত গম রপ্তানি নিষিদ্ধ করেছে। এছাড়াও পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি চিনি উৎপাদন করা এই রাষ্ট্রটি সম্প্রতি চিনি রপ্তানির পরিমাণও সীমিত করার ঘোষণা দিয়েছে। ভারতে এই দুইটি ঘোষণার পরপরই আন্তর্জাতিক বাজারে চিনি ও গমের দাম বেড়ে গেছে।
এছাড়া, গত মে মাসে মালয়েশিয়া সরকার জানিয়েছে, তারা মুরগি এং মুরগির মাংসের রপ্তানি কমিয়ে দেবে কারণ তাদের দেশের ভেতরই এসব খাদ্য দ্রব্যের সংকট দেখা দিয়েছে।
রপ্তানি আয় কমে যাওয়ার কারণ কি?
কোন দেশের নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে উৎপাদন কমে গেলে বা উৎপাদন পদ্ধতি ক্ষতিগ্রস্থ হলে কিংবা উৎপাদিত পণ্য রপ্তানিযোগ্য না হলে রপ্তানি আয় কমে যায়।
আমদানি ব্যয় যে কারণে বৃদ্ধি পায়:
- বিশ্ববাজারে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বেড়ে গেলে।
- বিশ্ববাজারে তেলের দাম বৃদ্ধি পেলে।
- পণ্যের পরিবহণ (আন্তর্জাতিক) খরচ বেড়ে গেলে।
- জ্বালানি, ভোগ্যপণ্য, কাঁচামালের মূল্যবৃদ্ধির কারণে।
- পণ্যের সরবরাহ কমে গেলে।
বাংলাদেশে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির পেছনে যে প্রভাব কাজ করছে:
- বিদেশ থেকে আমদানিকৃত পণ্যের দাম বৃদ্ধি।
- আমদানিকৃত কাঁচামালের দাম বৃদ্ধি।
- দেশীয় পণ্যের উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক এর তথ্যমতে বাংলাদেশে মূল্যস্ফীতি বাড়ার কারণ হচ্ছে-
- স্থানীয় বাজারে কেরোসিন, ডিজেলসহ বিভিন্ন ধরণের জ্বালানি তেলের দাম বৃদ্ধি।
- আন্তর্জাতিক বাজারে খাদ্য ও জ্বালানী তেলের দাম বৃদ্ধি।
- কোভিডে ক্ষতিগ্রস্তদের জন্য প্রণোদনা ও নগদ সহায়তা প্রদান।
- রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ।
এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের হিসাব বলছে, ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের গড় মূল্যস্ফীতি ৬ শতাংশ থাকবে। আর এটি মোকাবেলা করাই হবে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
অর্থাৎ, করোনা মহামারি, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে বিশ্ব অর্থনীতি। মুদ্রাস্ফীতির ফলে দেশে দেশে লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে পণ্যদ্রব্যের দাম। যার ফলে বিশ্বজুড়ে বাড়ছে দারিদ্র্যতা। বিশ্বনেতাদের সম্মিলিত প্রচেষ্টা ব্যতীত এই ভয়াবহ অর্থনৈতিক সংকট কাটিয়ে উঠা প্রায় অসম্ভব।