কবি নজরুলের মৃত্যুদিবস নিয়ে বিভ্রান্তির নেপথ্যে কী?

মুক্তিযুদ্ধের পর ১৯৭২ সালের ২৪ মে কাজী নজরুল ইসলামকে ভারত থেকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। স্বাধীন দেশে ১৯৭৪ সালে কাজী নজরুল ইসলামকে জাতীয় কবির মর্যাদায় সম্মানিত করে বাংলাদেশ সরকার। এর বছর দুয়েক পরেই, ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট(বাংলা ১২ই ভাদ্র) জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম পরলোক গমন করেন। তাঁর মৃত্যুর মধ্য দিয়ে পতন ঘটে বাংলার প্রগতিবাদী বিদ্রোহী সাহিত্যধারার উজ্জ্বল এক নক্ষত্রের।

গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে কবির মৃত্যু ঘটে ১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ২৯ আগস্ট। কিন্তু, বর্তমানে ২৭ আগস্ট দেশব্যাপী জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের মৃত্যুদিবস পালন করা হয়। অর্থাৎ, জাতীয় কবির প্রয়াণ ২৯ আগস্ট হলেও ২৭ আগস্ট তাঁর মৃত্যুদিবস পালন করা হয়। এখন প্রশ্ন হলো, জাতীয় কবির মৃত্যুদিবস নিয়ে এই বিভ্রান্তির শুরু কিভাবে? এ প্রশ্নের উত্তর জানতে আমাদের ফিরে যেতে হবে আরেকটু পেছনে।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট। অর্থাৎ, যেদিন কবির প্রয়াণ ঘটে দিনটি ছিল বাংলা সনের হিসেবে ১৩৮৩ বঙ্গাব্দের ১২ই ভাদ্র। সে হিসেবেই অর্থাৎ, বাংলা সনের হিসেব ধরে জাতীয় কবির মৃত্যুদিবস পালন করা হয় ১২ই ভাদ্র। আর ঠিক এখানেই জাতীয় কবির মৃত্যুদিবস নিয়ে বিভ্রান্তির শুরু। বিষয়টি আরেকটু পরিষ্কার করা যাক।

আধুনিক জ্ঞান বিজ্ঞানের প্রসারের সাথে সাথে সনাতন বিভিন্ন প্রথার বিলোপ ঘটা ইতিহাসের সাধারণ ঘটনা। বাংলা দিনপঞ্জিকাও ইতিহাসের বিভিন্ন সময় সেই সংস্কার যন্ত্রের ভেতর দিয়ে গেছে। ঋতু বিভ্রাটসহ বেশ কিছু আর্থ সামাজিক দিক বিবেচনায় বাংলা দিনপঞ্জির এই সংস্কারসাধন করা হয়েছে।

গত শতাব্দীতে বাংলা দিনপঞ্জিকা সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয় ১৯৫০ সালে। বাংলা দিনপঞ্জিকা আধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত করার উদ্দেশ্যে ১৯৫০ সালে ভারত সরকার প্রখ্যাত বিজ্ঞানী ড.মেঘনাদ সাহাকে প্রধান করে একটি কমিটি গঠন করে। জ্যোতির্বিজ্ঞানের সূক্ষ্ম হিসাব নিকাশ এবং সৌর আবর্তনের নিরিখে ১৯৫৪ সালে মেঘনাদ সাহা কমিটি বাংলা পঞ্জিকাকে সংস্কার করার বেশকিছু সুপারিশ প্রস্তাব করেন। 

পরবর্তীতে, ১৯৬৩ সালে ঢাকাস্থ বাংলা একাডেমি ড. মোহান্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে একটি দিনপঞ্জি সংস্কার কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটি বিভিন্ন বাংলা মাস ও ঋতুতে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আর্থ-সাংস্কৃতিক জীবনের কিছু সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতাকে নির্ণয় করেন। এই প্রতিবন্ধকতা দূর করার জন্য ১৯৬৬ সালের ১৭ই ফেব্রুয়ারি ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমিটি ড.মেঘনাদ সাহা কমিটির মূল্যায়নের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কয়েকটি প্রস্তাব বাংলা একাডেমির কাছে পেশ করে। সেগুলো হলো-

১. বছরের প্রথম পাঁচ মাস অর্থাৎ বৈশাখ থেকে ভাদ্র হবে ৩১ দিনের। 
২. বাকি মাসগুলো অর্থাৎ আশ্বিন থেকে চৈত্র হবে ৩০ দিনের মাস। 
৩. প্রতি চতুর্থ বছরের(লিপ ইয়ার) ফাল্গুন মাসে অতিরিক্ত একটি দিন যোগ করে তা হবে ৩১ দিনের। 

পরবর্তীতে, ১৯৯৬ সালে ড.মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর পুত্র ও ভাষা আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক মুহাম্মদ তকীয়ূল্লাহ পূর্বের দিনপঞ্জির লিপইয়ার সংক্রান্ত দুর্বলতা সমাধান করে নতুন দিনপঞ্জিকার সুপারিশ করেন। আধুনিক এই দিনপঞ্জিকায় গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার এবং বাংলা তারিখের দিনগুলোর স্থির ছিল। অর্থাৎ, প্রতিবছর বাংলা সনের প্রথম দিন অর্থাৎ, পহেলা বৈশাখ হবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের তারিখ অনুযায়ী ১৪ই এপ্রিল। এতে পহেলা বৈশাখ ছাড়াও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় দিবস বাংলা সনের সাথে সমন্বয় করাও সহজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। বাংলাদেশ সরকার এই সুপারিশ অনুমোদন করে ১৯৯৬ সালে বঙ্গাব্দ ১৪০২-১৪০৩ বর্ষপঞ্জি প্রকাশ করে। এর নাম দেওয়া হয় “শহীদুল্লাহ পঞ্জিকা”। 

সবশেষ, ২০১৫ সালে বাংলা একাডেমির তৎকালীন মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খানের নেতৃত্বে বাংলা দিনপঞ্জির সাথে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের সামঞ্জস্যপূর্ণ সংস্কারের জন্য একটি কমিটি গঠন করে। উক্ত কমিটির সুপারিশ অনুসারে-

১. বাংলা সনের প্রথম ৬ মাস হবে ৩১ দিনের। 
২. বাকি ৬ মাসের মধ্যে ফাল্গুন ব্যতীত অন্য ৫ মাস হবে ৩০ দিনের এবং ফাল্গুন মাস হবে ২৯ দিনের। 
৩. লিপইয়ারের বছর ফাল্গুন মাস হবে ৩০ দিনের। 

এই কমিটির সুপারিশ অনুসারে নতুন করে সংস্কার করা হয় বাংলা দিনপঞ্জি। বর্তমানে এই দিনপঞ্জিই সরকারিভাবে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। 

এবার ফিরে আসা যাক কবির মৃত্যুদিবস বিভ্রান্তিতে। কবির মৃত্যুর সময়, অর্থাৎ ১৯৭৬ সালে সনাতন বাংলা দিনপঞ্জিকা অনুসারে বাংলা দিন-তারিখ গণনা করা হতো। সেই হিসেবে কবির মৃত্যুদিবস ১২ই ভাদ্র হলো সনাতন দিনপঞ্জিকার বাংলা তারিখ। যা গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ছিল ১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট।  কিন্তু, পরিবর্তিতে সংস্কারকৃত আধুনিক বাংলা দিনপঞ্জি অনুসারে কবির মৃত্যুদিবস ১২ই ভাদ্র পড়েছে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ২৭ আগস্টে। আর যেহেতু কবির জন্মদিবস বাংলা সন মতে পালন করা হয়, সেহেতু কবির মৃত্যুদিবস পালনে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের দিন-তারিখ উপেক্ষা করা হয়। অর্থাৎ, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডার অনুসারে ২৯ আগস্ট মৃত্যুবরণ করলেও সংস্কারকৃত বাংলা দিনপঞ্জি মোতাবেক বাংলা ১২ই ভাদ্র ইংরেজি ২৭ আগস্টে পড়ায় কবির মৃত্যুদিবস ২৯ আগস্টের পরিবর্তে ২৭ আগস্ট পালন করা হয়।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img