বাংলাদেশ দুর্যোগপ্রবণ দেশ। ভৌগোলিক অবস্থান এবং বৈশ্বিক উষ্ণায়নের প্রভাবে প্রায়ই প্রাকৃতিক নানা দূর্যোগ প্রত্যক্ষ করে এ দেশের মানুষ। ঘূর্ণিঝড়, বন্যা, ভূমিকম্প হরহামেশা ঘটতে দেখলেও অন্যান্য প্রাকৃতিক দূর্যোগের সাথে এ দেশের মানুষ খুব একটা পরিচিত নয়। এ জন্য নতুন ধরণের কোনো প্রাকৃতিক দূর্যোগের ঘটনা এ দেশের মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে।
সম্প্রতি এমনই একটি ঘটনা আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার হাকালুকি হাওরের চাতলবিল এলাকায় পানি শূন্যে উড়তে বা জলস্তম্ভ দেখা গেছে। গত ২৩ জুলাই শনিবার বিকালে এই জলস্তম্ভ সৃষ্টির ঘটনা ঘটে। হাকালুকির এই ঘটনা অনেক প্রত্যক্ষদর্শী দেখেন এবং তাদের অনেকে ছবি এবং ভিডিও ধারণ করে সমাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করেন। হাকালুকিতে ঘুরতে গিয়ে Md Mosfiqur Rahman Sakib নামের এক ব্যক্তিও দেখা পায় এই জলস্তম্ভের, সেই ঘটনার ছবি এবং ভিডিও তিনি নিজ ফেসবুক আইডিতে পোস্ট করার পর তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
পরবর্তীতে হাকালুকি হাওরের ঘটা এই ঘটনাটি নিয়ে বিবিসি বাংলা, প্রথম আলো, আরটিভি,চ্যানেল২৪, মানবজমিন, বাংলা ট্রিবিউন, এনটিভি সহ দেশের প্রায় সকল গণমাধ্যমগুলোতেও সংবাদ প্রকাশিত হয়।
তবে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভিডিওটি ছড়িয়ে পড়ার পর অনেকে ঘটনাটিকে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে সংজ্ঞায়িত করে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে কেউ কেউ এটিকে টর্নেডো, তো কেউ জলোচ্ছ্বাস দাবি করেছে। এছাড়াও মূলধারার গণমাধ্যম মাছরাঙা টিভি এবং সময় টিভি‘র অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ‘অলৌকিক’ সম্বোধন করে একই ভিডিও প্রচার করা হয়। তাই বিভ্রান্তি নিরসনে বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে নামে রিউমর স্ক্যানার টিম।

হাকালুকি হাওরে যা ঘটেছে আসলে তা কি?
হাকালুকি হাওরের এই জলস্তম্ভ সৃষ্টির ঘটনায় ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা যায়, হাকালুকি হাওরের পানির ভেতর থেকে লম্বা একটা পানির স্তম্ভ আকাশের দিকে উঠে গেছে। আকাশ কালচে বর্ণ ধারণ করে বিজলি চমকে গর্জন করছে। পানির সেই স্তম্ভটি হাওরের পানি টেনে নিয়ে নড়াচড়া করছে। প্রত্যক্ষদর্শীরাও একইভাবে বর্ণনা করেছে। এলাকাবাসীর ভাষ্য, উপজেলার জায়ফরনগর ও পশ্চিম জুড়ী ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকাজুড়ে হাকালুকি হাওর বিস্তৃত। গতকাল সকাল থেকে প্রচণ্ড গরম পড়ে। একই সঙ্গে চলে লোডশেডিং। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে হঠাৎ আকাশে মেঘ করে। ঝড় শুরু হয়। এ সময় হাওরে ফানেলের মতো দৃশ্য চোখে পড়ে। দু-তিন মিনিট তা স্থায়ী হয়।
অনুসন্ধানে দেখা যায়, হাকালুকি হাওরে আকাশ থেকে নিচে নেমে আসা ফানেলের মতো এই দৃশ্যের ঘটনাটিকে Water Spout বলা হয়ে থাকে, এটি এক ধরনের টর্নেডো।
যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র ও বায়ুমন্ডলীয় সরকারি সংস্থা NOAA এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে ওয়াটার স্পাউট সম্পর্কে একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। সেখানে উল্লেখ করা হয়েছে, ওয়াটার স্পউট (water spout) বলতে বায়ু ও জলীয় বাষ্পের ঘূর্ণায়মান কলামকে বোঝানো হয়। এটি সাধারণত দুই ধরনের হয়। একটিকে বলা হয়, ফেয়ার ওয়েদার ওয়াটারস্পাউট। অন্যটিকে টর্নেডিক ওয়াটারস্পউট।
টর্নেডিক ওয়াটারস্পউট হলো এক ধরনের টর্নেডো, যা পানির উপর তৈরি হয় বা ভূমি থেকে সৃষ্ট হয়ে পানিতে চলে যায়। স্থলজ টর্নেডো ও এই ওয়াটারস্পাউটের বৈশিষ্ট্য একই। টর্নেডিক ওয়াটারস্পাউটগুলো সত্যিকারের টর্নেডোর মতো শুরু হয়। প্রচণ্ড বজ্রঝড়ের সাথে যুক্ত বাতাস দ্বারা প্রভাবিত হয়ে, বায়ু উল্লম্ব অক্ষের উপর উঠে এবং ঘোরে। টর্নেডিক ওয়াটারস্পাউটগুলি সবচেয়ে শক্তিশালী এবং ধ্বংসাত্মক ধরণের হয়।
অপরদিকে ফেয়ার ওয়েদার ওয়াটারস্পউট সাধারণত বিকাশমান কিউমুলাস (মেঘের নানা প্রকারের মধ্যে একটি) মেঘের একটি লাইনের অন্ধকার সমতল ভিত্তি বরাবর গঠিত হয়। এই ধরনের ওয়াটারস্পউটের সময় বজ্রবৃষ্টি বা বজ্রঝড় হয় না। ফেয়ার ওয়েদার ওয়াটার স্পাউট খুব কমই বিপজ্জনক। যে মেঘগুলি থেকে তারা নেমে আসে সেগুলি দ্রুত গতিশীল নয়, তাই ন্যায্য আবহাওয়ার জলস্রোতগুলি প্রায়শই স্থির থাকে। একটি ফেয়ার ওয়েদার ওয়াটার স্পাউট পানিরপৃষ্ঠে বিকশিত হয় এবং উপরের দিকে উঠে। ফানেল আকৃতিটি দৃশ্যমান হলে এই ধরনের ওয়াটার স্পাউটগুলো বিকাশ লাভ করতে থাকে। ফেয়ার ওয়েদার ওয়াটারস্পউট হালকা বাতাসেই তৈরি হয়। তাই তারা সাধারণত খুব কম নড়াচড়া করে। এই ফেয়ার ওয়েদার ওয়াটারস্পউটগুলো যখন মাটিতে বা পানির উপরিভাগে গিয়ে পড়ে তখন দ্রুত বিলুপ্ত হয়ে যায়।
অনুসন্ধানে পাওয়া ওয়াটারস্পউট বিষয়ক এ তথ্যের সাথে হাকালুকি হাওরের ঘটনাটির সম্পূর্ণ মিল পাওয়া যায়। যুক্তরাষ্ট্রের সমুদ্র ও বায়ুমন্ডলীয় সরকারি সংস্থা NOAA এর দেয়া টর্নেডিক ওয়াটারস্পাউট এর বর্ণনা এবং হাকালুকি হাওরে ঘটা ঘটনায় প্রাপ্ত বর্ণনার মিল রয়েছে। তাই হাকালুকি হাওরের ঘটনাটি টর্নেডিক ওয়াটারস্পাউট।
এছাড়াও অনুসন্ধানে ভিন্ন দেশে ঘটা হাকালুকি হাওরের অনুরুপ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমগুলো ওয়াটার স্পাউট হিসেবেই উল্লেখ করেছে। যেমন, রোমে ঘটা অনুরুপ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম The Telegraph ও মিশিগানে ঘটা অনুরুপ ঘটনাকে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম Associate Press ওয়াটারস্পউট হিসেবে উল্লেখ করেছে। অনুরুপ ঘটনাকে CNN, BBC ইত্যাদি সংবাদমাধ্যমগুলোও ওয়াটার স্পাউট হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এদিকে হাকালুকি হাওরের ঘটনায় দৈনিক যুগান্তর কে সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী জানিয়েছেন, ‘পানির উপর শক্তিশালী টর্নেডো সৃষ্টি হলে প্রচণ্ড বেগে ঘূর্ণয়মান বাতাসের টানে পানি স্তম্ভাকারে উপরের দিকে উঠতে থাকে। পানি দিয়ে মোড়ানো বাতাসের তৈরি টর্নেডোর ফলে এমনটা হয়। এটাকে Water Spout বা জলস্তম্ভ বলা হয়। বাংলাদেশে এটি ‘মেঘশূর’ নামেও পরিচিত।‘
প্রথমআলো কে আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ ও দুই যুগ ধরে ঘূর্ণিঝড়, কালবৈশাখী, টর্নেডো ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণাকারী আবদুল মান্নান জানিয়েছেন,
“এটি অবশ্যই একটি শক্তিশালী টর্নেডো ছিল। আমরা সাধারণত স্থলভাগে টর্নেডোর কথা শুনে অভ্যস্ত। কিন্তু আমাদের জলাভূমিগুলোয় এ ধরনের টর্নেডো আঘাত হেনে থাকে। দেশের উপকূলীয় এলাকা, বঙ্গোপসাগর ও জলাভূমিগুলোয় প্রায় প্রতিবছর ছোট ছোট টর্নেডো আঘাত হানার তথ্য আমরা পাই। তবে অন্য টর্নেডোর তুলনায় হাকালুকির টর্নেডোটি বেশ ব্যতিক্রম ছিল। এর ফানেলটির দৈর্ঘ্য কমপক্ষে ৫০০ মিটার বা আধা কিলোমিটার বলে মনে হয়েছে।”
অর্থাৎ, হাকালুকি হাওরে আকাশ হতে পানির ফানেল বা জলস্তম্ভ সৃষ্টির ঘটনাটি ওয়াটারস্পউট। যা বিভিন্ন দেশে নিয়মিত ঘটে থাকে এবং এই জলস্তম্ভ সৃষ্টির ঘটনাটি জলোচ্ছ্বাস কিংবা এলিয়েন এর উপস্থিতি নয়।
ওয়াটারস্পউট কেন ঘটে?
সাধারণত পৃথিবীর গ্রীষ্মমন্ডলীয় এবং উপ-ক্রান্তীয় অঞ্চলে সমুদ্রের পৃষ্ঠের উপর ওয়াটার স্পাউট তৈরি হয়। বছরের সবচেয়ে উষ্ণ তাপমাত্রার সময় পোতাশ্রয় এবং হ্রদেও এটি ঘটতে পারে। ওয়াটারস্পউট তীব্র বজ্রঝড়ের সাথে ও প্রায়শই উচ্চ বাতাস, বড় শিলাবৃষ্টি এবং ঘন ঘন বিপজ্জনক বজ্রপাতের সাথে যুক্ত থাকে। ওয়াটারস্পউটের আরেকটি কারণ বলে মনে করা হয় উল্লম্ব বায়ু শিয়ার, যা বায়ু বল তৈরির জন্য দায়ী এবং যা উচ্চতায় যাওয়ার সাথে সাথে দিক পরিবর্তন করে। এটি জলস্তম্ভ তৈরির সময় আমরা যে ফানেল দেখতে পাই তা তৈরির দিকে নিয়ে যায়।
হাকালুকি হাওরে ওয়াটারস্পউট ঘটার কারণ নিয়ে সিলেট আবহাওয়া অফিসের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ সাঈদ আহমদ চৌধুরী বিবিসি বাংলা‘কে জানিয়েছেন, ‘প্রচণ্ড গরমের কারণে হাওরের পানির ওপরের তাপমাত্রা কমে ওপরে উঠে যাওয়ার কারণে সেখানে টর্নেডোর তৈরি হয়েছে। সেই সময় আশেপাশের শীতল হাওয়া সেই শূন্যতা পূরণ করতে আসায় একটি ঘূর্ণির তৈরি হয়। এর ফলে এই ঘটনা ঘটতে পারে বলে ধারণা তার।’
অপরদিকে, আবহাওয়া অধিদপ্তরের শ্রীমঙ্গল কার্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মো. মুজিবুর রহমান প্রথম আলোকে ঘটনাটি নিয়ে জানিয়েছেন, হাকালুকি হাওরে ছোট আকারের টর্নেডোর দৃশ্য দেখা গেছে; অন্য কিছু নয় এটা। তিনি আরও বলেন, যেখানে বায়ুমণ্ডলের চাপ কম ও তাপমাত্রা বেশি থাকে, সেখানে শূন্যস্থানের সৃষ্টি হয়। এ সময় চারদিক থেকে আসা বাতাসের কারণে ওই স্থানে ঘূর্ণনের সৃষ্টি হয়। প্রবল বেগে মেঘের সঙ্গে বাতাস নিচের দিকে নামতে থাকে। তখন দেখতে অনেকটা ফানেলের মতো লাগে। এটাই টর্নেডো। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ায় এ রকম ঘটনা ঘটছে বলে তিনি মন্তব্য করেন
মূলত, আবহাওয়া বিরূপ আচরণের কারণে আকাশ হতে হাওরে সৃষ্ট ফানেল বা জলস্তম্ভ কিংবা আকাশে পানি উঠে যাওয়ার যে ঘটনা সম্প্রতি হাকালুকি হাওরে ঘটেছে সেই ঘটনাটি ওয়াটারস্পউট। এই ঘটনাটি বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কম পরিচিত হওয়ায় অনেকে এটিকে অনেক ভাবে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন। এটিকে অনেকে জলোচ্ছ্বাস বা এলিয়েন সংশ্লিষ্ট ঘটনা দাবি করলেও মূলত এটি টর্নেডিক ওয়াটারস্পউট।
সুতরাং, সিলেটে হাকালুকি হাওরের আকাশে পানি ওঠা বা জলস্তম্ভ সৃষ্টির ঘটনাটি কোনো জলোচ্ছ্বাস কিংবা এলিয়েনের অস্তিত্ব বিষয়ক ঘটনা নয় বরং এটি একটি টর্নেডিক ওয়াটারস্পউট।