সম্প্রতি, বাংলাদেশে বাণিজ্যিক ব্যাংক এবং খোলা বাজার উভয় জায়গাতেই টাকার বিপরীতে মার্কিন ডলারের মূল্য বৃদ্ধি নিয়ে ব্যাপক আলোচনা-সমালোচনা চলছে। আন্তঃব্যাংক ও খোলা বাজারে ডলারের বিনিময় হারের পার্থক্য প্রায় সাড়ে ৯ টাকার ওপরে, যা বাংলাদেশে অতীতে আর কখনও দেখা যায়নি। আন্তঃব্যাংক লেনদেনে ২০২১ সালের এপ্রিল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে টাকার দরপতন হয়েছে ৩ দশমিক ১৮ শতাংশ।

মার্কিন মুদ্রা ডলারের পরিচিতি
ডলার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক প্রবর্তিত, যা আন্তর্জাতিক অর্থনীতি তথা আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত মুদ্রা। এই কারণেই ডলারের মূল্যকে কেন্দ্র করে আন্তর্জাতিক বাজার নিয়ন্ত্রিত হয়। ১৭৬০ সালে প্রথম ডলার ছাপানো হয় এবং তা মুদ্রা হিসেবে সবার কাছেই গ্রহণযোগ্য হয়। পাঁচটি মার্কিন অঞ্চল এবং এগারটি দেশ তাদের সরকারী মুদ্রা হিসেবে মার্কিন ডলার ব্যবহার করে।
ডলারের আধিপত্যের কারণ
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ এবং তার পরবর্তী সময় থেকেই ডলার অন্যতম শক্তিশালী মুদ্রা হিসেবে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। সেসময় ইউরো এবং ব্রিটিশ পাউন্ডের তুলনায় ডলারের প্রভাব বৃদ্ধির হার ছিল বেশি।
এর কারণ হলো, প্রথমতঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হলে ইউরোপের অর্থনৈতিক অবস্থা অনেকাংশে খারাপ হয়ে পড়তে শুরু করে। পাশাপাশি এশিয়ার অর্থনীতিও ক্রমান্বয়ে দুর্বল হতে শুরু করে। ১৯৪৪ সালে এই সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেয় ‘বিশ্ব ব্যাংক’। ঠিক করা হয়, এক আউন্স সোনার দাম হবে ৩৫ ডলার। আর ডলারের আধিপত্যের শুরুটা এখান থেকেই।
দ্বিতীয়তঃ ইউরোপে ‘মার্শাল প্ল্যান’ নামক বিখ্যাত একটি পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয় এবং এই পরিকল্পনায় ইউরোপিয়ান দেশগুলোকে “ডলার” সাহায্য দেওয়া হয়।
তৃতীয়তঃ আন্তর্জাতিক রিজার্ভ কারেন্সি হিসেবে সারা বিশ্বব্যাপী ডলারের ব্যবহার বাড়তে থাকায় ‘ফরেন এক্সচেঞ্জ রিজার্ভ’ হিসেবে প্রথম নির্ধারিত মুদ্রা হয় “ডলার”।
তেল বা জ্বালানি তেলের দামের সঙ্গে ডলারের দামের পরিবর্তনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তেলের অন্যতম বড় আমদানিকারক হওয়ায় ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া কিংবা কমে যাওয়ার সাথে তেলের দামেরও মূল্য বৃদ্ধি কিংবা মূল্যহ্রাস হয়। পৃথিবীতে “ডলার” সব থেকে বেশি ছাপানো মুদ্রার মধ্যে একটি। তাই ডলার যে কোন কিছুর পরিপ্রেক্ষিতে অন্যতম নির্ভরযোগ্য সম্পদ। যে কোন মুদ্রা, সোনা বা শেয়ারের মূল্য বৃদ্ধি কিংবা হ্রাস হওয়ার তুলনায় ডলারের মান অনেকটাই স্থিতিশীল।
সমগ্র পৃথিবীতে অন্য দেশের মুদ্রা এবং পণ্যের লেনদেনে ডলার ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। ডলারের কেনা-বেচার বাজার তাই যথেষ্ট সংগঠিত। পৃথিবীর প্রায় সকল মানুষই ডলার কেনা-বেচা করতে পারেন এবং আন্তর্জাতিক বাজারে ডলারের মাধ্যমেই লেন-দেন সম্পাদিত হয়। এই কারণে ডলারের আধিপত্য অন্য যে কোন মুদ্রার চেয়ে বেশি।
কোন মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম কম-বেশি হওয়ার কারণ
আন্তর্জাতিক বাজারে কোন দেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও একইসাথে আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রপ্তানি আয় এবং প্রবাসী আয় কমে গেলে সেই দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি পায়। এছাড়াও কোন দেশের কেন্দ্রীয় রিজার্ভের মোট পরিমাণ কমে গেলে, সেখানে ডলারের চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে ক্রমাগত বাড়তে থাকলে এবং তা সরবরাহে সংকট দেখা দিলে সেদেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি পায়।
আরও কিছু কারণ রয়েছে যা ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব ফেলে। যেমনঃ কোন দেশে তাদের নিজস্ব নাগরিক বা বিদেশী পর্যটকদের মাধ্যমে নগদ ডলার আসার তুলনায় দেশটির নাগরিক কর্তৃক বিদেশে চিকিৎসা, পড়াশোনা কিংবা পর্যটক হিসেবে নগদ ডলার নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়লে তা সেই দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধিতে প্রভাব রাখে।
বৈশ্বিক চাহিদার ক্ষেত্রে অনেক সময় ব্যাংক বিভিন্ন অবস্থাভেদে আমদানিকারকদের কাছে উচ্চমূল্যে এবং রপ্তানিকারকদের কাছে কম মূল্যে ডলার বিক্রি করে বৈদেশিক মুদ্রাবাজারের সংকটকে তীব্র করে ফলে। সেক্ষেত্রেও সেদেশের মুদ্রার মান কমে যেতে পারে।
ঠিক এর উল্টো ঘটনা সংগঠিত হলে সেই দেশের মুদ্রার বিপরীতে ডলারের মান কমে যাবে।
টাকার বিপরীতে ডলারের দাম কিভাবে বাড়ে
বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এখন মধ্যবর্তী মুদ্রা হচ্ছে ডলার। ফলে ডলারের মুদ্রার বিপরীতেই অবমূল্যায়ন বা পুনর্মূল্যায়ন করা হয়। বাংলাদেশ আমদানি নির্ভর দেশ হওয়ায় আন্তর্জাতিক বাজারে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় বৃদ্ধি ও একইসাথে আমদানি ব্যয়ের তুলনায় রফতানি আয় এবং প্রবাসী আয় কমে গেলে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি পায়।
এছাড়াও বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় রিজার্ভের পরিমাণ কমে গেলে, ডলারের চাহিদা স্বাভাবিকের চেয়ে ক্রমাগত বাড়তে থাকলে এবং সরবরাহে সংকট দেখা দিলে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশের নিজস্ব নাগরিক বা বিদেশী পর্যটকদের মাধ্যমে নগদ ডলার আসার তুলনায় এখান থেকে বিদেশে চিকিৎসা, পড়াশোনা কিংবা পর্যটক হিসেবে নগদ ডলার নিয়ে যাওয়ার প্রবণতা বাড়লে টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্যবৃদ্ধি ঘটে।
বাংলাদেশে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম নির্ধারণকারী প্রতিষ্ঠান
বাংলাদেশের খোলা মুদ্রাবাজার বা কার্ব মার্কেটে টাকার বিপরীতে ডলারের বিনিময় মূল্য বা বিনিময় হার নির্ধারণ করে বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আর্থিক কর্তৃপক্ষ প্রতিষ্ঠান “বাংলাদেশ ব্যাংক”।
কেন্দ্রীয় রিজার্ভের পরিমাণ কমে যাওয়ার কারণ
- রপ্তানি আয়ের চেয়ে আমদানি ব্যয় বেশি হলে
- ব্যক্তি বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান কর্তৃক অবৈধ ডলার মজুদ করার মাধ্যমে।
- অসামঞ্জস্যপূর্ণ রিজার্ভ খরচের কারণে।
- অস্বাভাবিক বেশি নগদ ডলার বিদেশে পাচার হলে।
- সরকারি-বেসরকারি খাতের বড় অঙ্কের বিদেশি ঋণ থাকলে।
- ডলারের মূল্যের তারতম্যের কারণে অধিক লাভের আশায় প্রবাসীরা বৈধ পথে ব্যাংকের মাধ্যমে রেমিট্যান্স না পাঠিয়ে হুন্ডির মাধ্যমে অবৈধভাবে দেশে টাকা পাঠালে।
টাকার বিপরীতে ডলারের মূল্য বৃদ্ধির চিত্র
দেশীয় প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম “প্রথম আলো”র অনলাইন সংস্করণের একটি প্রতিবেদন অনুযায়ী, ১৯৮৩ সালে এসে বাংলাদেশ মধ্যবর্তী মুদ্রা হিসেবে পাউন্ডের পরিবর্তে মার্কিন ডলারকে বেছে নেয়। ১৯৯৩ সালের ১৭ জুলাই বাংলাদেশি মুদ্রাকে চলতি হিসাবে রূপান্তরযোগ্য করা হয়। আর ২০০৩ সালের মে মাস থেকে বাংলাদেশি মুদ্রার ভাসমান বিনিময় হার চালু করা হয়।
দেশের প্রথম সারির সংবাদমাধ্যম “মানবজমিন” এর অনলাইন সংস্করণের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের ৫ই আগস্ট আন্তঃব্যাংক মুদ্রাবাজারে প্রতি ডলার ৮৪ টাকা ৮০ পয়সায় বিক্রি হয়। এক বছরেরও বেশি সময় ধরে এই একই জায়গায় ‘স্থির’ ছিল ডলারের দর। এরপর থেকেই বাড়তে থাকে ডলারের দর। দেখা গেছে, এই ৯ মাসে বাংলাদেশি মুদ্রা টাকার বিপরীতে বিশ্বের সবচেয়ে বড় অর্থনীতির দেশ যুক্তরাষ্ট্রের মুদ্রা ডলারের দর বেড়েছে প্রায় ২.২৪ শতাংশ। এর আগে জানুয়ারি মাসের শুরুতে ডলারের বিনিময়মূল্য ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা করেছিল কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ২৩শে মার্চ ২০ পয়সা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ২০ পয়সা করা হয়। এরপর কয়েক দফায় দাম বাড়ানো হয়। আর গত সোমবার তা বাড়িয়ে ৮৬ টাকা ৭০ পয়সা নির্ধারণ করা হয়।
সাম্প্রতিক সময়ে টাকার বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে কেন?
দেশীয় গণমাধ্যম “দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড” এর অনলাইন সংস্করণের একটি প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী গত বছরের তুলনায় চলতি অর্থবছরের এপ্রিল পর্যন্ত রেমিট্যান্স আয় প্রায় ১৭% কমে যাওয়া এবং উচ্চ আমদানি প্রবৃদ্ধির কারণে দেশে ডলারের চাহিদা অনেক বেড়ে গেছে। গত ১২ মে পর্যন্ত ডলারের চাহিদা মেটাতে বাংলাদেশ ব্যাংক ৫.১১ বিলিয়ন ডলার বিক্রি করেছে। বাংলাদেশের ইতিহাসে এর আগে কখনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে একসাথে এত ডলার বাজারে ছাড়া হয়নি।
চলতি অর্থ বছরের প্রথম ৯ মাসে (জুন-মার্চ) ৬ হাজার ১৫২ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি করেছে বাংলাদেশ। ২০২০-২১ অর্থবছরের একই সময়ে ৪ হাজার ২৭৬ কোটি ডলারের পণ্য আমদানি হয়েছিল।
অর্থাৎ, এই নয় মাসে বাংলাদেশের আমদানি ব্যয় ৪৩ দশমিক ৮৬ শতাংশ বেড়েছে। তার মানে ডলার খরচ বেড়েছে। কিন্তু এর বিপরীতে রপ্তানি বেড়েছে মাত্র ৩২ দশমিক ৯২ শতাংশ। আর রেমিটেন্স কমেছে ১৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। অর্থাৎ, ডলারের মজুদ যা আসছে, তার চেয়ে বেশি খরচ হয়ে যাচ্ছে।
“যদিও রপ্তানি আয় বেড়েছে, কিন্তু তারপরও এক মাসে আট হাজার তিনশো কোটি ডলার আমদানি ব্যয়ের বিপরীতে রপ্তানি আয় হচ্ছে মাত্র চার হাজার পাঁচশো কোটি ডলার। ফলে আমদানি ব্যয় অনেক বেশি থাকছে।” এ কারণেই কেন্দ্রীয় রিজার্ভ ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে ফলে টাকার মান কমে গিয়ে এর বিপরীতে ডলারের দাম বেড়েছে।
এছাড়াও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবেও বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বেই মার্কিন ডলারের বিপরীতে মান হারাচ্ছে স্থানীয় মুদ্রা।
ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ার প্রভাব
কোন দেশে ডলারের দাম বৃদ্ধি হলে স্থানীয় মুদ্রার মুদ্রাস্ফীতি হয় এতে সাধারণ নাগরিকগণ ক্ষতিগ্রস্থ হন। পক্ষান্তরে এতে লাভবান হন প্রবাসীরা যারা দেশে বৈদশিক মুদ্রা পাঠান, রপ্তানি নির্ভর ব্যাংক, ডলার মজুদকারীগণ এবং ফ্রী-ল্যান্সারগণ।
বাংলাদেশের বর্তমান রিজার্ভ
বৈশ্বিক গণমাধ্যম বিবিসি এর বাংলা বিভাগের অনলাইন সংস্করণের প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, একটা দেশের তিনমাসের আমদানির খরচের সমমানের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অবশ্যই থাকতে হবে।
দেশের প্রথমসারির সংবাদমাধ্যম “মানবজমিন” এর অনলাইন সংস্করণের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বলছে, গত রোববার এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়নের (আকু) ২.২৪ বিলিয়ন (২২৪ কোটি) ডলারের আমদানি বিল পরিশোধের পর গত বৃহস্পতিবার দিন শেষে রিজার্ভের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪১.৯০ বিলিয়ন ডলার। গত তিন মাস ধরে (জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি ও মার্চ) প্রতি মাসে ৮ বিলিয়ন ডলারের বেশি পণ্য আমদানি হচ্ছে দেশে। এ হিসাবে এই রিজার্ভ দিয়ে ৫ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব।
উল্লিখিত সকল তথ্য ২১মে ২০২২ পর্যন্ত হালনাগাদকৃত।