গত ২৯ জুলাই চট্টগ্রামের মিরসরাইয়ে ক্রসিং পার হওয়ার সময় একটি মাইক্রোবাসে ট্রেনের ধাক্কা লেগে নিহত হন ১১ জন। এছাড়াও গত আড়াই বছরে লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় ২১৯ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জানা গেছে দুর্ঘটনা নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন এর একটি সংবাদ বিজ্ঞপ্তি থেকে।
লেভেল ক্রসিংয়ের সময় এসব দুর্ঘটনার মূল কারণ হিসেবে গেটম্যান না থাকা, দায়িত্বে অবহেলা, জনবলসংকট ও মানুষের অসচেতনতাকে দায়ী করেছে সংগঠনটি। তবে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে দাবি করা হচ্ছে লেভেল ক্রসিংয়ে এসব দুর্ঘটনার পেছনে দায়ী রেলের তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তি।
এই দাবি কতটুকু সত্য? ট্রেন কাছাকাছি আসলে লেভেল ক্রসিংয়ে কি আসলেই তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তি তৈরি হয়, যা একটি গাড়িকে থামাতে পারে? অনুসন্ধান করেছে রিউমর স্ক্যানার।
সম্প্রতি লেভেল ক্রসিংয়ে গাড়ি দুর্ঘটনা বিষয়ে যে দাবি ছড়িয়েছে
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গত ৩ আগস্ট রাত ১২.৩৭ মিনিটে Zaman Feroz নামক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রশ্ন হল, কেন ট্রেন আসার ঠিক পূর্ব মুহূর্তে গাড়ি যখন রেল লাইনে উঠে, তখনই চাকা অচল হয়ে থুবড়ে দাঁড়িয়ে যায়। (আর্কাইভ) শিরোনামে একটি পোস্ট করা হয়। সেখানে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক বলরাম ভৌমিকের বরাত দিয়ে পোস্টদাতা লিখেন, “যখন ট্রেন লেভেল ক্রসিং এর প্রায় কাছাকাছি চলে আসে অর্থাৎ সীমার মধ্যে এসে যায়, তখন লাইনের মধ্যে চাকার ঘর্ষণের ফলে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পাওয়ার বা তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির কারণে পুরো রেল লাইন আবিষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে সে সময়ে লাইনে অন্য কোন গাড়ি উঠলে সাথে সাথে তার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়। এ কারণে কম সময়ে গাড়িটি রেল লাইন থেকে সরে যেতে পারে না। অথচ যখন রেল গাড়ি নির্দিষ্ট রেঞ্জের বাইরে থাকে তখন লেভেল ক্রসিং পার হওয়াতে কোন সমস্যাই নেই। “
পরবর্তীতে এই পোস্টটি কপি-পেস্ট হয়ে ফেসবুকের বিভিন্ন অ্যাকাউন্ট ও পেজ থেকে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।
ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এরকম আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
এছাড়াও জামান ফিরোজের সেই ফেসবুক পোস্টের ভিত্তিতে জাতীয় দৈনিক আমাদের সময় এর অনলাইন সংস্করণে গত ৩ আগস্ট বিকেল ৪.১৪ মিনিটে ‘ট্রেন আসার পূর্বমুহূর্তে লাইনে উঠে পড়া গাড়ি বিকল হয়ে যায় কেন’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয় (আর্কাইভ)।
রেল কাছাকাছি আসলে তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তি তৈরি হয় দাবিটি কার?
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া পোস্টটিতে তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তি তৈরি হওয়ার ব্যাপারে পদার্থ বিজ্ঞানের অধ্যাপক বলরাম ভৌমিককে সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়। তবে পোস্টে তার সম্পর্কে নাম ছাড়া আর কোন তথ্য নেই, এই নামের ব্যক্তির পরিচয় কি কিংবা তিনি কোন প্রতিষ্ঠানের অধ্যাপক কিংবা তিনি কোথায় এ কথা বলেছেন এ সংক্রান্ত কোন তথ্য পোস্টটিতে নেই। তবে সীতাকুণ্ড কলেজের সুবীর কান্তি রায় নামের এক সহকারী অধ্যাপকের দেয়া একটি পোস্টেও আমরা বলরাম ভৌমিক এর বরাতে উক্ত তথ্যের উল্লেখ দেখতে পাই। সেই সূত্র ধরে উক্ত নামে সীতাকুণ্ড ডিগ্রি কলেজের এক পদার্থ বিজ্ঞানের সহকারী অধ্যাপককে খুঁজে পাওয়া যায়। তার ফেসবুক প্রোফাইলে কোন পোস্ট পাবলিক না থাকায় তিনি এমন কিছু বলেছেন কি না তা জানতে চেয়ে ইতিমধ্যে যোগাযোগ করেছে রিউমর স্ক্যানার। তার কাছ থেকে কোন উত্তর আসলে তা পরবর্তীতে প্রতিবেদনের এই অংশে আপডেট করে নেওয়া হবে।
তবে এই একই তথ্যটি বেশ কয়েকবছর ধরেই ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। তাই এই একই দাবি বাংলাদেশের কেউ সম্প্রতি করে থাকলেও সেটা তার নিজের থেকে উদ্ভাবিত দাবি হওয়ার সম্ভাবনা সেক্ষেত্রে নেই।
ট্রেন ক্রসিং এর কাছাকাছি আসলে কি ঘর্ষণের ফলে পুরো লাইন তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তি দ্বারা আবিষ্ট হয়ে গাড়ী বন্ধ হয়ে যায়?
রেলের চাকা এবং লাইনের মধ্যে ঘর্ষণের ফলে পুরো লাইন ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পাওয়ার বা তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তি দ্বারা আবিষ্ট হয়ে গাড়ী বন্ধ হয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। সাধারণত রেলের চাকা এবং লাইনের মধ্যে ঘর্ষণের ফলে স্থির তড়িৎ সৃষ্টি হয়। এর প্রভাবে সমান্যতম ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ড তৈরি হলেও তার পক্ষে একটি গাড়ীর চালু ইঞ্জিনকে থামিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তাই ক্রসিং এর সময় ট্রেন কাছাকাছি আসলে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তির সৃষ্টির ফলে গাড়ী বন্ধ হয়ে যাওয়ার দাবিটি সঠিক নয়।
উচ্চ শক্তির ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস ব্যবহার করে গাড়ি থামানোর একটি সম্ভাব্য পদ্ধতি রয়েছে যা ইলেকট্রনিক সিস্টেমের ক্রিয়াকলাপকে ব্যাহত করার মাধ্যমে গাড়ী বন্ধ করতে পারে। ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস (EMPs) ঘটে যখন একটি দ্রুত ত্বরান্বিত বৈদ্যুতিক প্রবাহ একটি চৌম্বক ক্ষেত্র তৈরি করে এবং তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তির বিস্ফোরণ ঘটায়। এর মাধ্যমে একটি চলন্ত গাড়ীকে নিরাপদে থামানো সম্ভবপর হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে হয়তো পুলিশ পালিয়ে যাওয়া গাড়ি থামাতে একটি ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক পালস ডিভাইস ব্যবহার করতে পারে। তবে এই প্রক্রিয়া ব্যবহার করে গাড়ী থামানোর প্রচলন এখনও ঘটেনি।
ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তির কারণে গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে দেখা যায়, এই ব্যাপারটি একটি মিথ।
Eptyres.com নামের একটি ওয়েবসাইটে “Is It True That Railway Crossing Can Shut Your Engine Down?” শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, মানুষের মধ্যে ধারণা আছে যে, রেলওয়ে লেভেল ক্রসিং এ তড়িৎ চৌম্বকীয় ক্ষেত্র তৈরি হওয়ায় গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু এটি সত্য নয়। রেলওয়ে ক্রসিং পার হওয়ার সময় এটি গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ করে না।
অনুসন্ধানে Sooriyamathy নামের একটি ব্লগস্পটে উক্ত বিষয় নিয়ে ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারি ‘WHY AUTOMOBILES STALL DURING CROSSING RAILS IF TRAIN IS NEAR?(MYTH EXPLAINED)’ শিরোনামে মিথটি নিয়ে একটি ব্যাখ্যামূলক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।
সেখানে মিথটির দাবির বিপরীতে উল্লেখ করা হয়-
- পারমাণবিক বিস্ফোরণ থেকে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক স্পন্দনের সম্ভাব্য ব্যতিক্রম ঘটনা ছাড়া কেনো চৌম্বক ক্ষেত্র একটি গাড়িকে নিষ্ক্রিয় করতে পারে না।
- ট্রেন বা ট্রেনের রেলপথ উল্লেখযোগ্য বা যথেষ্ট পরিমাণে চৌম্বক ক্ষেত্র নির্গত করে না।
- চৌম্বক ক্ষেত্র যদি বেশ দুর্বল হয় তবে তার দ্বারা একটি কম্পাস সুইকে বিচ্যুত করার সম্ভাবনাও কম, তাই এই অতি নিম্নশক্তি গাড়িকে অক্ষম করতে যথেষ্ট নয়।
এভাবে উল্লেখপূর্বক আরো কিছু ব্যাখ্যা যুক্ত করে উক্ত মিথটিকে ব্লগ প্রতিবেদনটিতে খণ্ডন করা হয়।
অনুসন্ধানে আরো জানা যায় ট্রেন কাছাকাছি না থাকলে কিংবা ট্রেন অনেক দূরে থাকলেও ক্রসিংয়ের সময় রেললাইনে গাড়ী থেমে যেতে পারে। অর্থাৎ গাড়ী ক্রসিংয়ে থেমে যাওয়ার কারণের জন্য ট্রেন নিকটে থাকা জরুরী নয়।
ভাইরাল পোস্টটিতে ট্রেন রেঞ্জের বাইরে থাকলে ক্রসিং এর সমস্যা হয় না বলে যে দাবি সেটিও সঠিক নয়। মূলত ট্রেন কাছাকাছি থাকা না থাকা এখানে গাড়ী থামাতে প্রভাব ফেলে না। যেসব কারণে ক্রসিং এর সময় গাড়ী থামে ঠিক সেসময় ট্রেন কাছাকাছি থাকলে সংঘর্ষের কারণে দূর্ঘটনার শিকার হতে হয়। ট্রেন কাছাকাছি না থাকলে বা অনেক দূরে থাকলে গাড়ীকে নতুনভাবে চালু করা বা নিরাপদে সড়ানোর জন্য পর্যাপ্ত সময় পাওয়া যায়। অর্থাৎ রেল কাছাকাছি থাকলে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স তৈরি হয়ে তা গাড়ী থামাবে না বরং ভিন্ন কারণে থেমে যাওয়া গাড়ী কিংবা ঝুকিপূর্ণ পারাপারের কারণে সামনে পড়া গাড়ী দূর্ঘটনায় পতিত হবে।
তাহলে রেলপথ ক্রসিং এর সময় গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার কারণ কি?
১. আতঙ্কিত হওয়া-
রেলপথে গাড়ি আটকে যাওয়ার প্রাথমিক কারণ হলো লোকজন সতর্কতা সংকেত উপেক্ষা করে, দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে তাদের যানবাহন চালায় এবং তারপরে যখন হঠাৎ ট্রেনের হুইসেল শোনা যায় তখন আতঙ্কিত হয়।
Eptyres.com এর প্রতিবেদনটি বলছে, লেভেল ক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ আতংকিত হওয়া। এটি সবচেয়ে বেশি দেখা যায় যে যানবাহনগুলো ম্যানুয়েল গিয়ারে চলে। রেলওয়ে ক্রসিং পার হওয়ার সময় গাড়ির চালকেরা কখনো কখনো গিয়ার ব্যবহারে দ্বিধায় থাকে। এমতাবস্থায় ট্রেনের হুইসেলের শব্দ হুট করে বেজে উঠলে তারা আতংকিত হয়ে পড়ে, গাড়ির গিয়ার ব্যবহার এবং এক্সিলারেটের ব্যবহারে ভুল করে। ফলে গাড়ি আটকে যায়।
২. রেলক্রসিং এর উচ্চতা
আবার সাধারণত রেলক্রসিং রাস্তার চেয়ে তুলনামূলক উঁচুতে অবস্থিত। এই উত্থিত পৃষ্ঠের উপর দিয়ে যাওয়ার সময় একটি ম্যানুয়াল ট্রান্সমিশন সহ গিয়ার স্থানান্তরিত করার ফলে যানবাহনটি ট্র্যাকের উপর থেমে যেতে পারে।
৩. ত্রুটিপূর্ণ রেলক্রসিং ব্যবস্থা
রেল ট্র্যাকে গাড়ি আটকে যাওয়ার আরেকটি সাধারণ কারণ হলো ত্রুটিপূর্ণ রেল ক্রসিং ব্যবস্থা। রেলপথ ক্রসিং সতর্কতা ব্যবস্থার ক্ষতি, বিদ্যুৎ বিভ্রাট, বা কয়েক মাস ধরে ট্রেন কর্তৃপক্ষের দ্বারা হওয়া অবহেলজনিত ক্ষতির কারণেও রেললাইনল গাড়ী থেমে যাওয়ার ঘটনা ঘটতে পারে।
৪. ক্রসিংয়ের সময় অত্যাধিক ধীরগতি
রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় গাড়ীকে অত্যাধিক ধীরে চালানোর কারণে রেল ট্র্যাকে গাড়ী থেমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার পিছনে জ্বালানী অথবা বাতাস কিংবা উভয়ের ঘাটতি থাকার কারণ থাকতে পারে। দূর্বল ইঞ্জিনের গাড়ীর ক্ষেত্রে এটা বেশি হয়ে থাকে।
৫. ট্রেন আসার আগেই পার হতে পারার অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাস /ঝুঁকি গ্রহণ
দূর থেকে ট্রেনকে যতদূরে মনে হয় ট্রেন তার চেয়েও অনেক কাছে থাকে এবং ট্রেন আমাদের পর্যবেক্ষণের চেয়েও দ্রুত গতিতে আসে। ট্রেন দীর্ঘ আকারের হওয়ায় দূর থেকে তাদের কম গতিশীল মনে হয়। চালকরা প্রায়ই এই দুটি কারণে ভুল করে থাকে এবং যা রেলক্রসিংয়ের সময় ট্রেনের সাথে সংঘর্ষের অন্যতম কারণ। তারা ভাবে ট্রেন যথেষ্ট দূরে আছে এবং তারা ট্রেনের সাথে ধাক্কা লাগার পূর্বেই ক্রসিং পার হয়ে যেতে পারবে। কিন্তু বাস্তবে ট্রেন দ্রুততর আসে এবং ক্রসিং পার হতে গিয়ে দূর্ঘটনার শিকার হতে হয়।
ট্রেনকে সম্পূর্ণরূপে থামতে সাধারণত এক মাইল বা তার বেশি সময় লাগে, তাই যখন ট্রেন আসছে তখন এর থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকা গুরুত্বপূর্ণ, বিশেষ করে অন্ধকার বা কম আলোতে। ঝুঁকি নেয়া এক্ষেত্রে একেবারেই উচিত নয়।
মূলত আপনি একটি চলন্ত ট্রেনের গতি বা দূরত্ব দূর থেকে বিচার করতে পারবেন না। চলন্ত ট্রেনগুলি অপটিক্যাল বিভ্রম তৈরি করে, যার ফলে ট্রেন ধীর গতিতে আসছে এবং বাস্তবের চেয়ে অনেক দূরে বলে মনে হয়।
বিভিন্ন দেশের লেভেল ক্রসিংয়ে সংক্রান্ত নির্দেশনা
লেভেল ক্রসিংয়ে ট্রেন চলার সময় তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তি তৈরি হয় কি না এ সংক্রান্ত বিষয়ে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তবে সেই নির্দেশনাগুলো থেকে তড়িৎচুম্বকীয় শক্তি নিয়ে কিছু পাওয়া যায় নি।
যুক্তরাষ্ট্রের National Highway Traffic Safety Administration, ইন্ডিয়ানা অঙ্গরাজ্যের Indiana Department of Transportation রেলক্রসিং সংক্রান্ত নির্দেশনা, The Texas Department of Insurance এর Railroad Crossing Safety FactSheet, ভারতীয় রেলওয়ের Level Crossing and Gateman সংক্রান্ত নির্দেশনা অনুসন্ধান করে দেখা যায়, এসব নির্দেশনা ও আইনে যানবাহন নিয়ে লেভেল ক্রসিংয়ে পার হওয়ার ব্যাপারে বিভিন্ন নির্দেশনা ও আইন বিষয়ে আলোচনা রয়েছে। কিন্তু রেলক্রসিংয়ে ট্রেন চলার সময় তড়িৎ চৌম্বকীয় শক্তি তৈরি হওয়া এবং এ থেকে সতর্ক থাকা সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা নেই
যানবাহনের লেভেল ক্রসিংয়ে পার হওয়ার সময়ের ভিডিও বিশ্লেষণ
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া “ট্রেন লেভেল ক্রসিং এর প্রায় কাছাকাছি চলে আসে অর্থাৎ সীমার মধ্যে এসে যায়, তখন লাইনের মধ্যে চাকার ঘর্ষণের ফলে ইলেক্ট্রো ম্যাগনেটিক পাওয়ার বা তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির কারণে পুরো রেল লাইন আবিষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে সে সময়ে লাইনে অন্য কোন গাড়ি উঠলে সাথে সাথে তার ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যায়।” দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ইউটিউব থেকে রেলক্রসিংয়ে ট্রেন ও যানবাহনের সংঘর্ষের তিনটি ভিডিও বেছে নেয়। ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনার মূল কারণ, রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় চালকদের অসচেতনতা ও অসাবধানতা।
ভিডিও ১:
EuroNews এর ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৭ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারি “Train Ploughs into car at level crossing in Poland” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত ট্রেন-গাড়ির সংঘর্ষের ১ মিনিট ২২ সেকেন্ডের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওটিতে দেখা যায়, একটি গাড়ি রেলক্রসিং পার হওয়ার সময় দ্রুত গতির ট্রেন এসে সেটিকে ধাক্কা দিয়ে দুমড়েমুচড়ে দিয়েছে। ট্রেন আসার সময় বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, এটি রেলক্রসিংয়ের খুব কাছেই ছিল এবং গাড়িটিও চলমান ছিল। অর্থাৎ গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়নি।
ভিডিও ২:
USDOTNHTSA নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০১৯ সালের ১৬ এপ্রিল “You know it’s true” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত ট্রেন-গাড়ির সংঘর্ষের ৩০ সেকেন্ডের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওটির ২৫ সেকেন্ডে দেখা যায়, চলন্ত একটি ট্রেন রেলক্রসিংয়ে চলন্ত গাড়িকে ধাক্কা দেয়। অর্থাৎ এখানেও রেলক্রসিংয়ে গাড়িটি চলন্ত ছিল।
ভিডিও ৩:
TripBloomz নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি “Railway crossing Dangerous accident” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত ট্রেন-গাড়ির সংঘর্ষের ৪৮ সেকেন্ডের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।
ভিডিওটির ১৫ সেকেন্ডে দেখা যায়, রেলক্রসিংয়ের একপাশে ব্যারিকেড ফেলা হলেও অন্যপাশ থেকে রেলক্রসিংয়ের কাছাকাছি একটি মোটরসাইকেলে করে আরোহী চলে আসার পর মুহুর্তেই মোটরসাইকেলটিকে ট্রেন এসে ধাক্কা দেয়। অর্থ্যাৎ এতো কাছে থাকা সত্ত্বেও মোটরসাইকেলের ইঞ্জিন বন্ধ হওয়ার মতো কোনো ঘটনা সেখানে ঘটেনি।
ট্রেন কাছাকাছি আসলে ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক শক্তির কারণে কি মানুষের লাফানোর শক্তি হারিয়ে যাওয়া সম্ভব?
ভাইরাল পোস্টটিতে আরো উল্লেখ করা হয়, “একবার ভাবুন তো দুটো রেল লাইনের মধ্যে বিস্তারটা কতো! আড়াই বা তিন হাতের বেশি নয়। এ তিন হাত অনেক পুরুষ লাফিয়ে পার হতে পারে।কিন্তু ট্রেন খুবই কাছাকাছি চলে এলে, তখন লাফিয়ে পার হবার চেষ্টা করা মানেই মৃত্যু অবশ্যই।তখন তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির কারণে মানুষ লাফানোর শক্তি হারিয়ে ফেলবে বলেই মৃত্যু নিশ্চিত।এ চুম্বকীয় শক্তির কারণে মানুষকে টেনে রাখবে বলে সমস্ত শরীর অধিক ভার(ওজন) হয়ে যাবে।”
তবে এই দাবিটিও সঠিক নয়। তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির কারণে মানুষ লাফানোর শক্তি হারিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। তথাপি চলন্ত ট্রেনের আসার কারণে অতি ক্ষুদ্র পরিমান তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তি উৎপন্ন হতে পারে আমরা পূর্বেই জেনেছি। এই অতি ক্ষুদ্র পরিমান তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির পক্ষে স্বাস্থ্য কিংবা যন্ত্রের ক্ষতি করা সম্ভব নয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) এর Radiation: Electromagnetic fields শীর্ষক একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায়, ব্যাপক গবেষণা সত্ত্বেও, আজ অবধি এমন কোন প্রমাণ নেই যে নিম্ন স্তরের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের সংস্পর্শ মানব স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
অর্থাৎ, নিম্ন স্তরের ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের সংস্পর্শে মানব স্বাস্থ্যের ক্ষতি হয় না। তাই ট্রেন কাছাকাছি আসলে যদি ক্ষুদ্র কোন ইলেক্ট্রোম্যাগনেটিক ফিল্ডের সৃষ্টিও হয় তা মানুষকে শক্তিহীন করতে পারবে না।
উক্ত বিষয়ে দেশীয় বিজ্ঞান প্লাটফর্ম সাইন্স বী এর ব্যাখ্যা থেকে জানা যায়, ‘চুম্বক ক্ষেত্র দ্বারা কোনো বস্তুকে আকর্ষণ করতে হলে সেই বস্তুকে অবশ্যই ফেরোম্যাগনেটিক কিংবা প্যারাম্যাগনেটিক হতে হবে৷ অপরদিকে মানুষ হচ্ছে দুর্বল ডায়াম্যাগনেটিক। আমাদের শরীরে আয়রন যা কিনা ফেরোম্যাগনেটিক এমন উপাদান বিদ্যমান রয়েছে। তবে সাধারণত এটি হিমোগ্লোবিন হিসেবে আমাদের রক্তে অবস্থা করে৷ এই হিমোগ্লোবিন আবার ডায়াম্যাগনেটিক। এছাড়া আয়রনের পরিমাণও নগন্য৷ আর আমাদের শরীরের ৮০% ই পানি দ্বারা তৈরি৷ ফলে ডায়াম্যাগনেটিল হওয়ার কারণ আকর্ষণ করার বদলে মানুষ উল্টো চুম্বক ক্ষেত্র দ্বারা বিকর্ষিত হবে৷ তাই যদি ট্রেনের কারণে ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক ফোর্স থেকেও থাকে তাহলে মানুষের ভর বা ওজন বাড়ার কোনো সুযোগ নেই৷’
মূলত, কোনো ধরণের নির্ভরযোগ্য ভিত্তি ছাড়াই ট্রেন যখন ক্রসিংয়ে আসে তখন ইলেকট্রোম্যাগনেটিক পাওয়ার বা তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির কারণে পুরো রেল লাইন আবিষ্ট হয়ে গাড়ীর ইঞ্জিন বন্ধ করে দেয় বিষয়ক তথ্যটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
সুতরাং, ট্রেন যখন লেভেল ক্রসিংয়ে আসে তখন ইলেকট্রো ম্যাগনেটিক পাওয়ার বা তড়িৎ চুম্বকীয় শক্তির কারণে পুরো রেল লাইন আবিষ্ট হয়ে গাড়ির ইঞ্জিন বন্ধ হয়ে যাওয়ার কারণে দূর্ঘটনা ঘটে শীর্ষক দাবিটি সম্পূর্ণ গুজব।
তথ্যসূত্র
- Eptyres.com : Is It True That Railway Crossing Can Shut Your Engine Down?
- National Highway Traffic Safety Administration : Always Expect a Train
- Indiana Department of Transportation : Railroad Crossing Facts
- The Texas Department of Insurance : Railroad Crossing Safety FactSheet
- Indian railways : Level Crossing and Gateman
- EuroNews : Train Ploughs into car at level crossing in Poland
- USDOTNHTSA : You know it’s true
- TripBloomz : Railway crossing Dangerous accident
- Daily Samokal: রেলক্রসিংয়ে দুর্ঘটনায় আড়াই বছরে ২১৯ মৃত্যু