আগস্টের বন্যায় এআই ছবি বাড়িয়েছে বিভ্রান্তি

অতিবৃষ্টি ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে আগস্টের ২০ তারিখ থেকে দেশের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি হয়। গত ০৩ সেপ্টেম্বর সরকারের দেওয়া সর্বশেষ তথ্যমতে এই বন্যায় সারাদেশে ৭১ জনের মৃত্যু হয়েছে। এতে আক্রান্ত হয় ১১টি জেলার অন্তত অর্ধকোটি মানুষ। এসব এলাকায় বন্যায় ক্ষত এখনো শুকায়নি। এই বন্যা ঘিরে অর্ধ-শতাধিকের বেশি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করেছে রিউমর স্ক্যানার৷ এসব ভুয়া তথ্যের প্রবাহে যেমন ছিল পুরোনো ও ভিন্ন দেশের ছবি বা ভিডিওর প্রচার, তেমনি উদ্ধার কার্যক্রম ঘিরেও ছিল অপতথ্যের ভয়াবহতা। এসবের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়িয়েছে অস্তিত্বহীন কিছু ছবি, যেগুলো আদতে কোনো ভিত্তিই নেই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি এসব ছবি বন্যার প্রেক্ষাপটে এমনভাবে প্রচার করা হয়েছে যা দেখে ছবিগুলো বন্যারই ভয়াবহতার দৃশ্য মনে করে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়েছে। রিউমর স্ক্যানার এমন অন্তত দশটি ছবি শনাক্ত করেছে।  

এসব ছবির মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচার করা হয়েছে একটি শিশুর ছবি যাকে বন্যার পানিতে অর্ধ নিমজ্জিত অবস্থায় দেখা যায়। একই ছবি নিয়ে একটি ভিডিও ভাইরাল হয়, যেখানে তাকে পানির মধ্যে হাত নেড়ে সাহায্যের জন্য আহ্বান জানাতে দেখা যায়। এই ছবিটি দেশের বিভিন্ন অঙ্গনের জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব, রাজনৈতিক দল এবং গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে। এমনকি ছবিটি ফান্ড কালেকশনের লিফলেট এবং বিভিন্ন সেচ্ছাসেবী সংগঠনের প্রচারণায়ও ব্যবহৃত হয়েছে।

বন্যায় এআই ছবি
Collage: Rumor Scanner

তবে রিউমর স্ক্যানার ছবিটি বিশ্লেষণ করে জানিয়েছে, এটি এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি। 

এছাড়া বাকি যে নয়টি ছবি ছড়িয়েছ,  সেগুলোর মধ্যে সেনাবাহিনী কর্তৃক এক বৃদ্ধ ব্যক্তিকে উদ্ধার, পানিতে একটি শিশু ডুবে যাওয়ার সময়ে চিৎকারের দৃশ্য, ফারাক্কা বাঁধের বিপরীতে চারাক্কা নামে বাঁধ নির্মাণের দৃশ্য, বাংলাদেশ নৌবাহিনীর উদ্ধার কাজ চালানোর দৃশ্য, বন্যার পানিতে অসহায় পিতার কোলে শিশুর ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য, বন্যার নিমজ্জিত গ্রামের দৃশ্য, বন্যার পানিতে গর্ভবতী নারীর অসহায়ত্বের দৃশ্য, বন্যার ফলে কুড়েঘরের সামনে কাঁদা মাটিতে সন্তানদের নিয়ে মায়ের ঘুমিয়ে থাকার দৃশ্য, বন্যায় ফরিদপুরের সরকারি রাজেন্দ্র কলেজের রাস্তার বর্তমান অবস্থার দৃশ্য দাবিতে এআই দিয়ে তৈরি ছবি প্রচার করা হয়েছে৷ 

Collage: Rumor Scanner

ছবিগুলো যে আসল বা বাস্তব নয় তা নিশ্চিত হতে ফ্যাক্টচেকাররা সাধারণত তিনটি পন্থা অবলম্বন করে থাকেন। প্রথমত দেখা হয়, ছবিটির উৎস কী। দ্বিতীয়ত দেখা হয়, ছবির উপাদানগুলোয় কোনো অসামঞ্জস্যতা আছে কিনা। সর্বশেষ দেখা হয়, এআই ছবি যাচাইয়ের সাইট ছবিটি সম্পর্কে কী জানাচ্ছে। ছবিটি যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি করা হয়, তাহলে অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ছবিটি যে ব্যক্তি বানিয়েছেন, তিনি পাবলিক পোস্টের মাধ্যমে বিষয়টি জানিয়ে দেন। ফলে তথ্য যাচাইকারীদের ক্ষেত্রে বিষয়টি সহজেই সমাধানে পৌঁছানো সম্ভব হয়। তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই ক্রিয়েটরের খোঁজ পাওয়া যায় না৷ প্রযুক্তির সহজলভ্যতার সুযোগে এআই দিয়ে ছবি তৈরি এখন খুবই সহজ ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন অনেক ছবিই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে পোস্ট করা হয়, যেগুলোতে ‘এআই দিয়ে বানানো’ এমন তথ্য না দেওয়া থাকলে বোঝা বেশ মুশকিল যে ছবিটি বাস্তব নয়৷ প্রথম পন্থাটি তাই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সাম্প্রতিক বন্যায় এআই দিয়ে তৈরি যেসব ছবি ছড়িয়েছে তার কোনোটিরই ক্রিয়েটরকে খুঁজে পাওয়া যায়নি৷  

ছবির উপাদানগুলোর অসামঞ্জস্যতা সংক্রান্ত দ্বিতীয় যে পন্থা, তা পুরোপুরি পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণ নির্ভর। এআই ছবি নিয়মিত যাচাই করে থাকেন এমন অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট ছবি দেখলেই অনুমান করে নিতে পারেন যে ছবিটি বাস্তব নাও হতে পারে৷ সাম্প্রতিক বন্যায় ছড়িয়ে পড়া একটি শিশুর ভাইরাল ছবিটিও যে এআই দিয়ে তৈরি, তা বিশ্লেষণের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়েছে দেশি-বিদেশি একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান। ছবিটি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, ছবিটির আলোর প্রতিফলন, শিশুটির চোখের অভিব্যক্তি, কপালের ভাঁজ এবং ঠোঁটের অস্বাভাবিকতা – এসবের মধ্যে কিছু অসংগতি রয়েছে, যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দ্বারা তৈরি ছবিতেই সাধারণত দেখা যায়।

Image analysis: Rumor Scanner 

এই ধরনের অসংগতি দেখা দেওয়ায় ছবিগুলো যাচাই করার জন্য বিভিন্ন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শনাক্তকরণ ওয়েবসাইটের (, , ) সাহায্য নেওয়া হয়। ওয়েবসাইটগুলোর বিশ্লেষণে বন্যা সংশ্লিষ্ট ছবিগুলো এআই দ্বারা তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ৬০ থেকে ৯১ শতাংশ পর্যন্ত ফলাফল দিয়েছে।

এআই দিয়ে তৈরি ছবির মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ঘটনার ভয়াবহতা বোঝানোর চেষ্টা থাকে৷ তবে এক্ষেত্রে ছবিটি বাস্তব ধরে নিয়ে অনেকেই বিষয়টিতে বিভ্রান্ত হন। আমরা এমনও অনেক তথ্য পেয়েছি যে অনেক ব্যক্তি আছেন যারা কিনা এমন ছবি দেখে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন৷ অথচ এসব ছবির বাস্তব কোনো অস্তিত্বই নেই৷ তবে এবারের বন্যায় এআই ছবি ব্যবহার করে রীতিমতো মানুষের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। বিএনপির জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভীর নাম ব্যবহার করে চালু থাকা একটি পেজ থেকে বন্যার পানিতে গর্ভবতী নারীর অসহায়ত্বের দৃশ্যের একটি ছবি পোস্ট করে বলা হয়, তাদের টিমের লোকজন উক্ত নারীর সকল খরচের দায়িত্ব নিয়েছে। অথচ ছবিটি এআই দিয়ে তৈরি। পেজটিও রিজভীর নামে চালু থাকা একটি ভুয়া পেজ, যার সাথে বিএনপির এই নেতার কোনো সম্পর্ক নেই। 

 Screenshot: Facebook

কিছুক্ষেত্রে বিনোদনের উদ্দেশ্যেও এআই ছবির প্রচার করা হয়। যেমন, ফারাক্কা বাঁধের বিপরীতে চারাক্কা নামে আরেকটি বাঁধ তৈরির ভুয়া খবরের সাথে এআই দিয়ে চারটি ছবি পোস্ট করা হয়েছে। সচেতন যে কেউই ছবিটি দেখলেই বা তথ্যটি নজরে এলে ভুয়া হিসেবেই মেনে নেবেন। তবে অসংখ্য মানুষের কাছে এই ধরণের পোস্ট পৌঁছে যাওয়ার ফলে অন্তত কিছু সংখ্যক নেটিজেন বিষয়টি নিয়ে বিভ্রান্তিতে যে পড়বেন না সে আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না৷ 

Screenshot: Facebook 

অর্থাৎ, গত আগস্টে বাংলাদেশে হওয়া ভয়াবহ বন্যায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই দিয়ে তৈরি ছবির প্রচার ছিল চোখের পড়ার মতো, যা উদ্ধারকাজ থেকে শুরু করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাড়িয়েছে বিভ্রান্তি।

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img