অস্থির ও বেকার লোকদের জন্য টিকটক তৈরি করার দাবিতে ঝাং ইয়ামিংয়ের নামে ভুয়া মন্তব্য প্রচার

সম্প্রতি, টিকটক ‘প্রতিষ্ঠাতা টিকটক অ্যাপটি কেবল মানসিকভাবে অস্থির ও বেকার লোকদের জন্য তৈরি করেছেন এবং এই ধরনের মানুষের সংখ্যা ভারতে সব থেকে বেশি’ শীর্ষক দাবিতে  অ্যাপটির প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়ামিংয়কে উদ্ধৃত করে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ),এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, টিকটক কেবল মানসিকভাবে অস্থির ও বেকার লোকদের জন্য তৈরি করা এবং এই ধরনের মানুষের সংখ্যা ভারতে সব থেকে বেশি’ শীর্ষক মন্তব্যটি টিকটকের প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়ামিংয়ের নয় বরং কোনোপ্রকার তথ্যপ্রমাণ ব্যতীত টিকটক প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়ামিংকে উদ্ধৃত করে দীর্ঘদিন ধরেই উক্ত মন্তব্যটি ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে।

সূত্রহীন মন্তব্য

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে GH Gossip নামের একটি ওয়েবসাইটে ২০২০ সালের ২০ মে ‘TikTok Was Created For Jobless and Unstable People – TikTok Founder, Zhang Yiming Reveals’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: GH Gossip

প্রতিবেদনটিতে ঝাং ইয়ামিংয়ের ‘টিকটক কেবল মানসিকভাবে অস্থির ও বেকার লোকদের জন্য তৈরি করেছেন এবং এই ধরনের মানুষের সংখ্যা ভারতে সব থেকে বেশি’ শীর্ষক একটি বক্তব্যের ডিজিটাল ব্যানার প্রচার করে পাঠকদের কাছে এই বক্তব্যের বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাওয়া হয়। তবে প্রতিবেদনটিতে থেকে ঝাং ইয়ামিং এই বক্তব্যটি প্রদানের সময় ও স্থান সম্পর্কে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

পাশাপাশি Opera News এর ওয়েবসাইটে প্রায় তিন বছর আগে  ‘Read this: Zhang Yiming say’s he created Tik Tok for jobless and unstable people’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদনেও দাবি করা হয়, ঝাং ইয়ামিং বলেছেন, ‘টিকটক কেবল মানসিকভাবে অস্থির ও বেকার লোকদের জন্য তৈরি করেছেন এবং এই ধরনের মানুষের সংখ্যা ভারতে সব থেকে বেশি।’ তার এই বক্তব্যের ফলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমটি ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে।

Screenshot: Opera News

তবে উক্ত প্রতিবেদনেও এই বক্তব্যটি তিনি কখন, কোথায় দিয়েছেন এমন কোনো তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এছাড়া ওয়েবসাইটটিতে উক্ত প্রতিবেদনটি ‘Gossip Celebrity’ বা সেলেব্রেটিদের নিয়ে গুঞ্জন বা গালগল্প ক্যাটাগরিতে প্রকাশ করা হয়েছে। 

উক্ত ওয়েবসাইটগুলো ছাড়াও আরও একাধিক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত কিছু প্রতিবেদন দেখুন I Created Tik Tok For Jobless And Unstable People” – Tik Tok Founder – Celebrities – Nairaland (Nairaland),  “I Created Tik Tok For Jobless And Unstable People” – Tik Tok Founder (misspetitenaijablog). 

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটারের ভ্যারিফাইড অ্যাকাউন্টে এই প্রসঙ্গে  ২০২২ সালে প্রকাশিত সূত্রহীন একটি টুইট দেখুন এখানে। 

তবে এসব ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বাহিরে ঝাং ইয়ামিংয়ের উক্ত বক্তব্যের বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রিউমর স্ক্যানার টিমের এই পর্যন্ত অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে, টিকটক প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়ামিংয়ের টিকটক খোলার কারণ ও এর সঙ্গে ভারতীয়দের জড়িয়ে দীর্ঘদিন ধরে যে বক্তব্যটি প্রচার করা হচ্ছে তার কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র নেই।

অন্যান্য ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান কি বলছে?

দাবিটি নিয়ে সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

এর মধ্যে ভারতীয় গণমাধ্যম Republic World  ২০২০ সালের ২০ মে Fact Check: Did TikTok Founder Zhang Yiming Say Indian Tiktok Users Were ‘unstable’?  শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানায়, গণমাধ্যমটি টিকটক প্রতিষ্ঠাতার বক্তব্য দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পর্কে অনুসন্ধান করে। 

Screenshot: Republic World

অনুসন্ধানে প্রতিষ্ঠানে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে অথবা টিকটকের অফিসিয়াল টুইটার অ্যাকাউন্টে এমন কোনো বক্তব্যের অস্তিত্বের হদিস মেলেনি। 

এছাড়া ভারতীয় ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Hoax or Fact প্রায় তিন বছর আগে ‘Tik Tok Founder Zhang Yiming Calls Indians Jobless, Unstable: Fact Check’ শীর্ষক একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনে জানায়, ঝাং ইয়ামিংয়ের নামে উক্ত উদ্ধৃতিটি ২০১৯ সালের ডিসেম্বর থেকে টুইটার, হোয়াটসঅ্যাপ সহ বিভিন্ন প্লাটফর্ম ও ইন্টারনেটে পোস্টার ও ছবি আকারে প্রচার হয়ে আসছে। 

Screenshot: Hoax or Fact

প্রতিবেদনটিতে আরও উল্লেখ করা হয়, ২০২০ সালের মে মাসে gistmania.com and ghgossip.com নামের দুইটি অনির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইট তাদের পাঠকদের টিকটক প্রতিষ্ঠাতার উক্ত বক্তব্য নিয়ে আলোচনা করতে বলে। যদিও টিকটক প্রতিষ্ঠাতার উক্ত বক্তব্যের বিষয়ে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

টিকটকের সাথে ভারতীয়দের দ্বন্ধ

২০২০ সালের ১৫ জুন ভারতের লাদাখে বিরোধপূর্ণ চীন ভারত সীমান্তে দুই দেশের সৈন্যদের মধ্যে হাতাহাতি ও সংঘর্ষে ভারতের অন্তত বিশজন সৈন্য নিহত হয়। এ ঘটনার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে৷ এরই ধারাবাহিকতায় ভারত ৫৯ টি চীনা মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। যার মধ্যে টিকটকও ছিল। 

Screenshot: BBC Bangla 

এছাড়া ভারতীয় গণমাধ্যম সূত্রে, ২০১৯ সালে বিশ্বব্যাপী শুরু হওয়া করোনা সংক্রমণের জেরে ভারতীয়দের মধ্যে চীনা বিরোধী মনোভাব তৈরির ব্যাপারেও তথ্য পাওয়া যায়। 

সেন্সর টাওয়ার নামে একটি প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা উল্লেখ করে ২০২০ সালের ৪ জুন ভারতীয় অনলাইন পোর্টাল Latestly তাদের বাংলা সংস্করণে ‘TikTok: বয়কট চাইনিজ অ্যাপ! টিকটক ডাউনলোডের চাহিদা একধাক্কায় কমল ৫০ শতাংশ‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে জানায়, ২০২০ সালের মার্চ এবং মে মাসের মধ্যে ভারতে অ্যাপেল এবং গুগল প্লে স্টোরে টিকটক অ্যাপের ডাউনলোড ৩৫.৭ মিলিয়ন থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৭ মিলিয়নে, যা প্রায় ৫১ শতাংশ। 

Screenshot: Latestly

অর্থাৎ উপরোক্ত প্রতিবেদন দুইটি থেকে জানা যায়, বিশ্বব্যাপী করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ও ভারত-চীন সীমান্তে উত্তেজনার জেরে ভারতীয়দের মধ্যে টিকটক নিয়ে বিরূপ মনোভাব ও শেষ পর্যন্ত দেশটিতে টিকটক নিষিদ্ধ করা হয়েছিল। 

মূলত, শর্ট ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম টিকটক একটি চীনা প্রতিষ্ঠান, এর প্রতিষ্ঠাতা চীনের নাগরিক ঝাং ইয়ামিং। তার নামে ২০১৯ সাল থেকে টিকটক প্রতিষ্ঠার কারণ ও টিকটকে ভারতীয়দের সংখ্যাধিক্যতা নিয়ে ‘প্রতিষ্ঠাতা টিকটক অ্যাপটি কেবল মানসিকভাবে অস্থির ও বেকার লোকদের জন্য তৈরি করেছেন এবং এই ধরনের মানুষের সংখ্যা ভারতে সব থেকে বেশি’ শীর্ষক একটি মন্তব্য ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। তবে অনুসন্ধানে ঝাং ইয়ামিংয়ের বক্তব্য দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি নিয়ে কোনো তথ্যসূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি। বরং দীর্ঘদিন ধরেই তথ্যসূত্র ছাড়াই বিভিন্ন অনির্ভরযোগ্য ওয়েবসাইটে উক্ত দাবিটি প্রচার হয়ে আসছে। 

সুতরাং, টিকটক প্রতিষ্ঠার কারণ ও টিকটকে ভারতীয়দের সংখ্যাধিক্যতা নিয়ে প্লাটফর্মটির প্রতিষ্ঠাতা ঝাং ইয়ামিংয়ের বক্তব্য দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img