এটি হাসান ও হুসাইন (রা.) এর কবরের ভিডিও নয় 

হাসান ইবনে আলী (রা.) ও হুসাইন ইবনে আলী (রা.) ইসলামের প্রারম্ভিক যুগের দুজন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। তারা দুজনেই ইসলামের চতুর্থ খলিফা, আলী ইবনে আবি তালিব (রা.) ও ফাতিমা জাহরা (রা.)-এর সন্তান, এবং মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি। হাসান (রা.) ৬৭০ খ্রিস্টাব্দে বিষপ্রয়োগে মৃত্যুবরণ করেন। অন্যদিকে, হুসাইন (রা.) ৬৮০ খ্রিস্টাব্দে কারবালার যুদ্ধে শহিদ হন।

সম্প্রতি, হাসান (রা.) এবং হুসাইন (রা.) এর রওজা শরীফ বা তাদের কবর দাবিতে পাশাপাশি অবস্থানরত দুটি কবরের ভিডিও ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে।

হাসান ও হুসাইন

ফেসবুকে ভাইরাল এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

টিকটকে ভাইরাল এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ইউটিউবে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এই বিষয়ে ফেসবুকে ভাইরাল একটি ভিডিও প্রায় ২ কোটি ৫০ লক্ষ বার দেখা হয়েছে। ভিডিওটিতে এখন পর্যন্ত প্রায় ২০ লক্ষ ভিন্ন অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে, ভিডিওটি ৩ লক্ষের অধিক বার শেয়ার করা হয়েছে এবং এতে ৩০ হাজারের বেশি মন্তব্য করা হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, পাশাপাশি অবস্থানরত দুই ব্যক্তির কবরের ভাইরাল ভিডিওটি হাসান ইবনে আলী (রা.) ও হুসাইন ইবনে আলী (রা.) এর কবরের নয়। কারণ তাদের কবর ভিন্ন দুই দেশে অবস্থিত। হাসান (রা.) এর কবর সৌদি আরবের মদিনা শহরের জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে অবস্থিত, এবং হুসাইন (রা.) এর কবর ইরাকের কারবালা শহরে অবস্থিত।

অনুসন্ধানের শুরুতে দাবিকৃত ভিডিওটির একাধিক স্থিরচিত্র রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে আলোচিত ভিডিওর মূল বিষয় জানার করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তবে এই অনুসন্ধানে ভিডিওটি সম্পর্কে গ্রহণযোগ্য কোনো তথ্য মেলেনি।

পরবর্তীতে হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা.) এর কবরের অবস্থান সম্পর্কে অনুসন্ধান চালানো হয়।

কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে ইসলাম ধর্ম বিষয়ক ওয়েবসাইট দ্য ইসলামিক ইনফরমেশনে ২০২৩ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হাসান ইবনে আলী (রা.) কে মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে দাফন করা হয়েছিল।  

Screenshot: The Islamic Information.

একই তথ্য পাওয়া যায় উত্তর আমেরিকায় শিয়া মুসলিমদের সেবা প্রদানকারী সংস্থা ইমাম মাহদি অ্যাসোসিয়েশন অফ মারজাইয়া এর ওয়েবসাইটে হাসান (রা.) সম্পর্কিত একটি নিবন্ধে। 

হজ ও ওমরাহ বিষয়ক ওয়েবসাইট হজ ও ওমরাহ প্ল্যানারে জান্নাতুল বাকি কবরস্থান সম্পর্কে একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। জানা যায়, ১৯২৫ সালে ওয়াহাবি মতবাদের প্রভাবে (ওয়াহাবি মতাদর্শ অনুযায়ী, কবরের উপর জটিল ও বড় ধরণের নির্মাণ করা ঠিক নয়) সৌদি কর্তৃপক্ষ জান্নাতুল বাকির অনেক সমাধি ও স্থাপনা ধ্বংস করে। এই কবরস্থানে এখনও হাসান ইবনে আলী (রা.) সহ অন্যান্য প্রমুখ ইসলামিক ব্যক্তিত্বদের কবর অবস্থিত। তবে এগুলো আগের মতো জাঁকজমকপূর্ণ নয়, বরং সাদামাটা উপায়ে চিহ্নিত করা হয়।

একই ওয়েবসাইট জান্নাতুল বাকির বিশিষ্ট কবরগুলোর একটি মানচিত্র খুঁজে পাওয়া যায়। এই মানচিত্রে হাসান ইবনে আলী (রা.) এর নাম দেখা যায়। 

Image: Hajj & Umrah Planner.

হুসাইন ইবনে আলী (রা.) এর কবরের বিষয়ে অনুসন্ধানে ডিজিটাল ইসলামিক লাইব্রেরি আল-ইসলামের ওয়েবসাইটে হুসাইন ইবনে আলী (রা.) এর মাজারের ইতিহাস সম্পর্কিত একটি নিবন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। নিন্ধটি থেকে জানা যায়, হুসাইন (রা.) কে ইরাকের কারবালায় কবর দেওয়া হয়েছিল।

ইসলামিক ঐতিহাসিক স্থানসমূহের তথ্য প্রদানকারী ওয়েবসাইট ইসলামিক ল্যান্ডমার্কের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকেও জানা যায়, হুসাইন ইবনে আলী (রা.) এর বিশ্রামস্থল বা সমাধি ইরাকের কারবালায় অবস্থিত।

ইসলাম ধর্ম বিষয়ক ডিজিটাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম দ্য মুসলিম ভাইবে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হুসাইন (রা.)-এর সমাধিস্থলকে কেন্দ্র করে এবং তার আশপাশের কিছু স্থান নিয়ে একটি মাজার গড়ে উঠেছে। এই মাজার বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আগত লক্ষ লক্ষ ভক্ত ও তীর্থযাত্রীদের আকর্ষণ করে। তারা এখানে এসে তাদের শ্রদ্ধা ও প্রার্থনা নিবেদন করে থাকেন।

পরবর্তীতে, গুগল ম্যাপে হুসাইন (রা.)-এর মাজারের একাধিক ছবি ও ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়, যা আলোচ্য ভিডিওটির সাথে মিলে না।

ডিজিটাল ইসলামিক লাইব্রেরি আল-ইসলামের ওয়েবসাইটে এক প্রশ্নের উত্তরে জানা যায়, হুসাইন ইবনে আলী (রা.) এর মাথা দাফনের স্থান নিয়ে বিভিন্ন মতামত প্রচলিত রয়েছে। কিছু তথ্য অনুযায়ী, তার মাথা ফিলিস্তিনে নেওয়া হয়েছিল, অন্যান্য মতে মিশরে নেওয়া হয়েছিল। কেউ কেউ বলেন যে, তার মাথা সিরিয়ায় রয়েছে। অপর তথ্য মতে, তার মাথা মদিনা অথবা কুফায় রাখা হয়েছে। এই বিষয়ে বিভিন্ন ধারণা ও মতবাদ প্রচলিত।

অর্থাৎ, হাসান ইবনে আলী (রা.) ও হুসাইন ইবনে আলী (রা.) এর কবর ভিন্ন দুই স্থানে অবস্থিত। 

এই বিষয়ে সৌদি আরবের ফ্যাক্ট-চেকিং প্রতিষ্ঠান ‘No Rumors’ এর প্রতিষ্ঠাতা রায়ান আদিল আমাদের জানিয়েছেন, হুসাইন (রা.) এর কবর সৌদি আরবে অবস্থিত নয়।

একই বিষয়ে আরব ফ্যাক্ট-চেকার্স নেটওয়ার্কের ম্যানেজার এবং অনুসন্ধানী সাংবাদিক সাজা মর্তাদা সাথে কথা বলেছি আমরা। তিনি নিশ্চিত করেছেন হাসান (রা.) এর কবর সৌদি আরবের জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে অবস্থিত। হুসাইন (রা.) এর দেহ ইরাকের কারবেলায় রয়েছে, তবে তার মস্তকের অবস্থান নিশ্চিত নয়।

মূলত, মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর নাতি হাসান ইবনে আলী (রা.) ও হুসাইন ইবনে আলী (রা.) এর কবর দাবিতে পাশাপাশি অবস্থানরত দুটি কবরের ভিডিও ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ভাইরাল হয়েছে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, এই দুই ইসলামিক ব্যক্তিত্বের কবর দুটি ভিন্ন দুই স্থানে অবস্থিত। হাসান ইবনে আলী (রা.) এর কবর মদিনার জান্নাতুল বাকি কবরস্থানে অবস্থিত এবং হুসাইন ইবনে আলী (রা.) এর কবর ইরাকের কারবালায় অবস্থিত। তাই ভাইরাল ভিডিওটি তাদের কবরের হওয়া সম্ভব নয়।

সুতরাং, হাসান (রা.) ও হুসাইন (রা.) এর কবরের ভিডিও দাবিতে ইন্টারনেটে প্রচারিত বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img