রাশিয়ান আর্টিস্ট নয়, ছবিটি তৈরি করেছেন একজন সাবেক আমেরিকান ছাত্র

এই ছবিটা একজন রাশিয়ান artist এর তৈরি” শীর্ষক শিরোনামের একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে বিগত কয়েক বছর ধরে প্রচার হয়ে আসছে।  

যা দাবি করা হচ্ছে

ফেসবুকে গত ১১ জানুয়ারী ‘Doraemon World’ নামক গ্রুপে ‘Jahid Hasan’ নামক অ্যাকাউন্ট থেকে “Unbelievable” (আর্কাইভ) শিরোনামে প্রকাশিত একটি পোস্টে সংযুক্ত ছবিতে একজন নারীকে দেখা যায়। ছবির নিচে লেখা রয়েছে, “এই ছবিটা একজন রাশিয়ান আর্টিস্ট এর তৈরী। এবং ছবিতে মেয়েটি হাসছে। তবে হাসিটি তখনই দেখতে পাবে যখন তুমি একটি চোখ সম্পূর্ণ বন্ধ রেখে এবং আরেকটি চোখ অর্ধেক বন্ধ করে ছবিটি দেখবে!”

সম্প্রতি ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এবং এখানে

একই দাবিতে বিগত বছরগুলোয় ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন – 

২০২১ সাল – এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে
২০২০ সাল – এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে এবং এখানে
২০১৯ সাল – এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এবং এখানে
২০১৮ সাল – এখানে। (আর্কাইভ)।
২০১৭ সাল – এখানে। (আর্কাইভ)
২০১৬ সাল – এখানে। (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত ছবিটি কোনো রাশিয়ান আর্টিস্টের তৈরিকৃত ছবি নয় বরং দৃষ্টিভ্রমের এই ছবিটি তৈরি করেছেন ক্রিস ফ্রেডি নামের একজন আমেরিকান। 

রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতির মাধ্যমে মার্কিন সংবাদমাধ্যম ‘Insider’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ২৮ ফেব্রুয়ারী “40 mind-boggling optical illusions that have stumped the internet” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনে বলা হয়, “ক্রিস ফ্রেডি (Chris Frady) দ্বারা তৈরি এই দৃষ্টি ভ্রমের (Optical illusion) ছবিটি ২০১৫ সালে প্রথম ভাইরাল হয়। মার্কিন অভিনেতা বেন স্টিলার ও গায়িকা বিয়ন্সে-র মুখাবয়ব মিলিয়ে ছবিটি তৈরি করা হয়।” 

ইনসাইডার জানায়, প্রথম দর্শনে মনে হবে যে এটি এক ছেলের ঝাপসা ছবি (মূলত বেন স্টিলার অভিনীত ২০০১ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবি Zoolander এর চরিত্রের ঝাপসা মুখাবয়ব) । আবার যখন এক চোখ হালকা খুলে দেখবেন তখন স্টিলার মুখ অদৃশ্য হবে। এটিকে তখন মনে হবে এক মেয়ের (মূলত বিয়ন্সে-র) হাসিমাখা ছবি। এটি তখন আরও পরিষ্কারভাবে ধরা দেবে আমাদের সামনে। 

ইনসাইডারের দেওয়া তথ্যের সূত্র ধরে পরবর্তীতে ক্রিস ফ্রেডি ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টে ২০১৬ সালের ২৭ সেপ্টেম্বর “Optical Illusion” (আর্কাইভ) শিরোনামের একটি পোস্টে আলোচিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।  

পোস্টে ফ্রেডি লিখেছেন, “আমি গত বছর (২০১৫) একটি ‘সাইকোলজি সেনসেশন এবং পারসেপশন’ ক্লাসের জন্য এটি তৈরি করেছি এবং আমি এটির বেশি কিছু ভাবিনি তবে এটি অনলাইনে ঘুরে বেড়াচ্ছে দেখলাম। তাই আমি ভেবেছিলাম এখানেও এটি পোস্ট করা উচিত।”

ফ্রেডি কি রাশিয়ান নাগরিক? 

ক্রিস ফ্রেডির লিংকডইন অ্যাকাউন্টে উল্লেখ রয়েছে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক। তিনি পড়াশোনা করেছেন কমিউনিটি কলেজ অফ দ্য এয়ারফোর্স এবং অ্যারিজোনা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ে। 

ফ্রেডি কি অ্যারিজোনার শিক্ষক ছিলেন? 

আলোচিত ছবিটি ‘রাশিয়ান কোনো আর্টিস্টের নয়’ জানিয়ে বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘Science Bee’ তাদের ফেসবুক পেজে প্রকাশিত এক পোস্টে (আর্কাইভ) ছবির মূল কারিগর ‘ক্রিস ফ্রেডি’র পরিচয় দিতে গিয়ে জানায়, “তিনি একজন শিক্ষক।”

ক্রিস ফ্রেডিকে একজন শিক্ষক দাবি করে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া আরো কিছু পোস্ট দেখুন – এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন – এখানে এবং এখানে

কিন্তু অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, ক্রিস ফ্রেডি কখনোই শিক্ষক ছিলেন না। 

ক্রিস ফ্রেডি তার ইনস্টাগ্রাম পোস্টে উল্লেখ করেছেন, তিনি ছবিটি ২০১৫ সালে ‘সাইকোলজি সেনসেশন এবং পারসেপশন‘ ক্লাসের জন্য তৈরি করেছিলেন। ইনসাইডার এসেছে, তিনি একই কোর্সের একটি প্রজেক্টের অংশ হিসেবে ছবিটি তৈরি করেছিলেন। 

ফ্রেডির লিংকডইন প্রোফাইলে দেওয়া তথ্যমতে, তিনি ২০১৪ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে মনোবিদ্যা’য় পড়াশোনা করেছেন। সে সময় তিনি “Behavioral Alcohol Research for Clinical Advancement” এবং Evolutionary Psychology “Neuberg” নামক দুইটি ল্যাবে রিসার্চ এসিস্ট্যান্ট বা গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজ করেছেন। 

একজন গবেষণা সহকারী কখনোই ক্লাস নিতে পারেন না। গবেষণা সহকারীর কাজ মূলত গবেষণা কাজে গবেষককে সহায়তা করা। বিশ্ববিদ্যালয়ে একেকজন শিক্ষকের আলাদা আলাদা রিসার্চ ল্যাব থাকে। সেই ল্যাবে শিক্ষার্থীরা গবেষণা সহকারী হিসেবে কাজের সুযোগ পেয়ে থাকেন। ক্রিস ফ্রেডির ক্ষেত্রেও তেমনই ঘটেছে। 

অর্থাৎ, ক্রিস ফ্রেডি শিক্ষক বা গবেষণা সহকারী হিসেবে নয়, মূলত শিক্ষার্থী হিসেবে তার ক্লাসের জন্য উক্ত ছবিটি তৈরি করেছিলেন। 

এমন ছবি এটাই প্রথম নয়

দৃষ্টি বিভ্রম সৃষ্টির এমন ছবি সাধারণত “হাইব্রিড ইমেজ” নামে পরিচিত। ফ্রেডির ছবিটির মতো হাইব্রিড ইমেজের আরেকটি উদাহরণ আলবার্ট আইনস্টাইন এবং মেরিলিন মনরোর ছবি। 

হাইব্রিড ইমেজগুলো একটি ছবির উচ্চ ফ্রিকোয়েন্সিকে অন্য ছবির নিম্ন ফ্রিকোয়েন্সির সাথে একত্রিত করে কাজ করে৷ ফলাফল হিসেবে এমন একটি ছবি তৈরি হয় যা আপনি যে দূরত্ব থেকে এটি দেখছেন তার উপর নির্ভর করে দুটি ভিন্ন উপায়ে উপলব্ধি করা যেতে পারে।

মি.বিন এবং মোনালিসার আলাদা দুইটি হাইব্রিড ইমেজের কাজ দেখুন এখানে। এ বিষয়ে স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি গবেষণা দেখুন এখানে। 

মূলত, মার্কিন নাগরিক ক্রিস ফ্রেডি ২০১৫ সালে অ্যারিজোনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন একটি কোর্সের প্রজেক্টের অংশ হিসেবে মার্কিন অভিনেতা বেন স্টিলার ও গায়িকা বিয়ন্সে-র মুখাবয়ব মিলিয়ে দৃষ্টি ভ্রমের (Optical illusion) ছবিটি তৈরি করেন। কিন্তু বিগত কয়েক বছর ধরে উক্ত ছবিটি রাশিয়ান শিল্পীর তৈরি করা এবং সম্প্রতি ছবির মূল কারিগর ক্রিস ফ্রেডি উক্ত ছবিটি অ্যারিজোনায় শিক্ষক থাকাকালীন তৈরি করেছেন দাবি করে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। অথচ, ফ্রেডি কখনো শিক্ষকই ছিলেন না।  

সুতরাং, দৃষ্টি বিভ্রমের আলোচিত ছবিটি রাশিয়ান শিল্পীর তৈরি এবং ছবির মূল কারিগরকে শিক্ষক দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img