সম্প্রতি,‘বন্ধ হয়ে গেল বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতাল’ শীর্ষক দাবিতে একটি তথ্য গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।
গণমাধ্যমে প্রচারিত এমন প্রতিবেদন দেখুন আজকের পত্রিকা, সময় টিভি, সময়ের আলো, মানবকণ্ঠ।
সৈয়দপুরের ফাইলেরিয়া হাসপাতালকে বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতাল দাবি করে চিকিৎসা সংক্রান্ত ওয়েবসাইটে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন ডক্টর টিভি।
সামাজিক যোগাযাগমাধ্যমে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
যা দাবি করা হচ্ছে
গণমাধ্যমের প্রতিবেদন এবং ফেসবুক পোস্ট গুলোতে দাবি করা হচ্ছে, নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত ‘সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ল্যাব’ বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতাল।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ল্যাব বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতাল নয় বরং বাংলাদেশের সাভারেই ফাইলেরিয়া হাসপাতাল অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল নামে ফাইলেরিয়ার জন্য বিশেষায়িত আরেকটি হাসপাতাল আছে।
অনুসন্ধান যেভাবে
দাবিটি নিয়ে অনুসন্ধানে গনমাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন সূত্রে সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ল্যাবের ফটকের একটি ছবি খুঁজে পাওয়া যায়। ফটকের ছবিটিতে হাসপাতালের মূল নামের নিচেই (বিশ্বের প্রথম প্রতিষ্ঠিত ফাইলেরিয়া হাসপাতাল) শীর্ষক একটি লেখা রিউমর স্ক্যানার টিমের দৃষ্টিগোচর হয়।
পরবর্তীতে এ নিয়ে অনুসন্ধানে বেসরকারী টিভি চ্যানেল বৈশাখী টিভির ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘ফাইলেরিয়া হাসপাতাল নির্মাণে বড় ধরণের জালিয়াতি’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুজে পাওয়া যায়।
প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সরকারের সমাজ সেবা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে সাভারের জিনজিরায় ২০১২ সালে নির্মিত হয় বিশেষায়িত ফাইলেরিয়া হাসপাতাল। আট বছর আগে শুরু করা এই হাসপাতালটি নির্মাণের পুরো কাজ শেষ না করেই সব টাকা তুলে নিয়ে গেছে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সরকারি তদন্ত প্রতিবেদন অনুযায়ী প্রায় ৪ কোটি টাকার কাজ বাকি আছে। সমাজ সেবা অধিদপ্তর দফায় দফায় চিঠি দিলেও অসমাপ্ত কাজ শেষ করেনি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। তবে বর্তমানে এই হাসপাতালটি চালু আছে।
পাশাপাশি অনলাইন পোর্টাল ঢাকা পোস্টে একই বছরের ৮ জানুয়ারি ‘ভয়াবহ জালিয়াতি : সংকটে সাভারের ফাইলেরিয়া হাসপাতাল’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ফাইলেরিয়াসিস বা গোদ রোগে আক্রান্ত সাধারণ মানুষের যথাযথ চিকিৎসার স্বপ্ন নিয়ে ১৯৯৫ সালে নীলফামারী জেলার সৈয়দপুরে যাত্রা শুরু হয়েছিল বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল। এই রোগের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক প্রফেসর ডা. মোয়াজ্জেম হোসেন স্বল্প খরচে ফাইলেরিয়ার চিকিৎসা গরিব ও অসহায় মানুষকে রাজধানীর কাছে সাভারে আরও একটি বিশেষায়িত ফাইলেরিয়া হাসপাতাল স্থাপনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন।
প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, ঢাকা জেলার সাভারে ৫০ শয্যার ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি ২০১০-১২ অর্থবছরে আইএসিআইবি’র ৬৭.৭০ শতাংশ জমির ওপর অসম্পূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও এনজিও বিষয়ক ব্যুরো কর্তৃক নিবন্ধিত অলাভজনক, বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানটি সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় ও আইএসিআইবি’র যৌথ অর্থায়নে নির্মিত।
এছাড়া জাতীয় দৈনিক যুগান্তরে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর ‘ফাইলেরিয়া হাসপাতাল নির্মাণে নজিরবিহীন জালিয়াতি’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, দুরারোগ্য গোদ রোগের চিকিৎসার জন্য ৫০ শয্যার ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল নির্মাণে প্রায় ১২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয় সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়।
সরকারের সঙ্গে যৌথ অংশীদারিত্বে হাসপাতালটি নির্মাণের উদ্যোক্তা আইসিএবি (ইন্সটিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইমিউনলজি বাংলাদেশ) নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান। রাজধানীর অদূরে সাভারের জিনজিরা এলাকায় নির্মাণাধীন হাসপাতালটিতে বর্তমানে সীমিত পরিসরে রোগীদের চিকিৎসা কার্যক্রম চলছে। ২০১১-১২ সালে হাসপাতাল নির্মাণের কার্যক্রম শুরু হলেও তা এখনও শেষ হয়নি।
রিউমর স্ক্যানার টিমের এই পর্যন্ত অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে, নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল অ্যান্ড ল্যাবের পাশাপাশি রাজধানীতেই ফাইলেরিয়ার জন্য বিশেষায়িত আরও একটি হাসপাতাল আছে।
পরবর্তীতে বিষয়টি নিয়ে আরও অধিকতর অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম সাভারে অবস্থিত ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগ করে।
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রিউমর স্ক্যানারকে জানান, তাদের হাসপাতালটিও ফাইলেরিয়ার জন্য বিশেষায়িত এবং বর্তমানে হাসপাতালটিতে চিকিৎসাসেবা বা নিয়মিত কার্যক্রম চালু আছে।
এছাড়া রিউমর স্ক্যানার টিম সাভারে অবস্থিত ফাইলেরিয়া অ্যান্ড জেনারেল হাসপাতালটির নির্মাণের উদ্যোক্তা ও নীলফামারীর সৈয়দপুরে অবস্থিত সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে থাকা আইসিএবি (ইন্সটিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইমিউনলজি বাংলাদেশ) এর চেয়ারম্যান ডা. মোয়াজ্জেম হোসেনের সাথে যোগাযোগ করে।
তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, ‘সৈয়দপুর ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি বিশ্বের একমাত্র হবে কিভাবে? এটা মিথ্যা। আমি সৈয়দপুরে এই হাসপাতাল করেছি, সাভারে করেছি।’
মূলত, ২০০২ সালে জাপান সরকারের অর্থায়নে নীলফামারীর সৈয়দপুর উপজেলার কামারপুকুর ইউনিয়নের ধলাগাছ এলাকায় ৭৫ শতক জায়গায় যাত্রা শুরু করে বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল। নানা সমস্যার কারণে গত ৮ মে নীলফামারীর ফাইলেরিয়া হাসপাতালটি বন্ধ হয়ে গেলে বাংলাদেশের বেশ কিছু গণমাধ্যমে এটিকে বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতাল উল্লেখ করে সংবাদ প্রকাশ করতে দেখা যায়। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই হাসপাতালটি প্রতিষ্ঠার দায়িত্বে থাকা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ইনস্টিটিউট অব অ্যালার্জি অ্যান্ড ক্লিনিক্যাল ইম্যুনোলজি অব বাংলাদেশ (আইএসিআইবি) এর উদ্যোগে ও সরকারের সমাজ সেবা অধিদপ্তরের তত্ত্বাবধানে রাজধানী ঢাকার সাভারের জিনজিরায় ২০১২ সালে নির্মিত হয় আরেকটি বিশেষায়িত ফাইলেরিয়া হাসপাতাল।
উল্লেখ্য, প্রায় এক মাস বন্ধ থাকার পর গত ১২ জুন থেকে সৈয়দপুরের ফাইলেরিয়া হাসপাতালটির চিকিৎসাসেবাসহ অন্যান্য কার্যক্রম পুনরায় শুরু হয়।
সুতরাং, গণমাধ্যমে সৈয়দপুরের ফাইলেরিয়া হাসপাতালটিকে বিশ্বের একমাত্র ফাইলেরিয়া হাসপাতাল উল্লেখ করে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Boishakhi TV Online: ফাইলেরিয়া হাসপাতাল নির্মাণে বড় ধরণের জালিয়াতি
- Dhaka Post (1): ভয়াবহ জালিয়াতি : সংকটে সাভারের ফাইলেরিয়া হাসপাতাল
- Dhaka Post (2): ফের চালু হলো বিশ্বের প্রথম ফাইলেরিয়া হাসপাতাল, স্বস্তিতে রোগীরা
- Jugantor: ফাইলেরিয়া হাসপাতাল নির্মাণে নজিরবিহীন জালিয়াতি
- Contact with IACIB Chairman Dr. Muazzem Hossai