সম্প্রতি “ফুটবলের কিংবদন্তি পেলে আর নেই, বিদায় কিংবদন্তি” শীর্ষক শিরোনামের একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচারিত হচ্ছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এরকম কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, কিংবদন্তি ফুটবলার পেলের মারা যাওয়ার দাবিটি সত্য নয় বরং তাঁর স্বাস্থ্যের অবস্থা স্থিতিশীল বলে জানিয়েছে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
যেভাবে অনুসন্ধান
শারীরিক কিছু সমস্যা দেখা দেওয়ার পর গত বছরের (২০২১) সেপ্টেম্বরের শুরুতে নিয়মিত চেকআপের অংশ হিসেবে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল পেলেকে। সেখানেই তাঁর বৃহদান্ত্রে টিউমার ধরা পড়ে এবং অস্ত্রোপচার করা হয়। সে সময় কিছুদিন হাসপাতালেও থাকতে হয়েছিল ব্রাজিলিয়ান এই কিংবদন্তিকে। এরপর থেকে নিয়মিত কেমোথেরাপি চলছিল তাঁর। প্রতি মাসে যেতে হচ্ছিল হাসপাতালেও।
কিন্তু নিয়মিত এই চেকআপই বিভ্রান্তির জন্ম দিয়েছে সময়ে সময়ে। পেলের পরিবারও যে এই বিভ্রান্তিতে বিরক্ত তা বোঝা যাচ্ছিল তাদের মন্তব্যেই। চলতি বছরের (২০২২) জানুয়ারীতে যেমন পেলের মেয়ে কেলি নাসিমেন্তো’র এক ইন্সটাগ্রাম পোস্টের বরাতে সংবাদ সংস্থা রয়টার্স জানায়, “আমি জানি না কোথায় কী হচ্ছে, কিন্তু সবাই আমাদের মেসেজ দিচ্ছে, নিজেদের উদ্বিগ্নতা প্রকাশ করছে৷ কিন্তু কিছুই পরিবর্তন হয়নি। তিনি বাসায় আছেন, ভালো আছেন। তিনি সুপার স্ট্রং।”
সর্বশেষ গত ২৯ নভেম্বর থেকে পেলে হাসপাতালে ভর্তি আছেন বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে খবর আসে
পেলেকে হাসপাতালে নেওয়ার খবর প্রকাশ হওয়ার পর তাঁর মেয়ে কেলি নাসিমেন্তো ইনস্টাগ্রামে জানান, হঠাৎ সিদ্ধান্তে বা গুরুতর কোনো কারণে তার বাবাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। এটা নিয়মিত চিকিৎসার অংশ।
গত ৩ ডিসেম্বর পেলে নিজেও তাঁর ইন্সটাগ্রাম অ্যাকাউন্টে দেওয়া এক পোস্টে জানান, মাসিক চেকআপের অংশ হিসেবে তিনি হাসপাতালে আছেন।
কিন্তু হঠাৎ করেই উদ্বিগ্নতা বাড়ায় ব্রাজিলের দৈনিক পত্রিকা ‘Folha De S.Paulo’র একটি প্রতিবেদন।
পেলের ইন্সটাগ্রাম পোস্টের পর একইদিন (৩ ডিসেম্বর) ‘ফোলহা ডি সাও পাওলো’তে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ক্যান্সারের চিকিৎসায় কেমোথেরাপিতে পেলের শরীর এখন আর সাড়া দিচ্ছে না, তাকে প্যালিয়েটিভ কেয়ার ইউনিটে নেওয়া হয়েছে।
প্যালিয়েটিভ কেয়ার হচ্ছে দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত রোগী ও তাদের পরিবারের জীবনযাত্রার মানোন্নয়ন সেবা। দুরারোগ্য ব্যাধি নির্ণয়, মূল্যায়ন এবং রোগের কারণে যন্ত্রণা বা ব্যথা উপশমের সব পদক্ষেপগুলো এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। তবে এই কেয়ারের মানে এই নয় যে রোগী আর বাঁচবেন না। অনেকক্ষেত্রেই প্যালিয়েটিভ কেয়ারে থাকা রোগী সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরেন।
‘ফোলহা ডি সাও পাওলো’র প্রতিবেদনের বরাতে পরবর্তীতে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমে পেলের শারীরিক অবস্থার জটিলতার বিষয়টি প্রকাশ করে।
দ্রুতই এই সংবাদ ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বব্যাপী। কাতার বিশ্বকাপের ডামাডোলের মধ্যে সারা বিশ্ব পেলেকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়ে। প্রার্থনা এবং শুভকামনাও জানিয়েছেন অনেকে।
এই সংবাদ প্রকাশের পর ৩ ডিসেম্বর সন্ধ্যার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোয় পেলের মৃত্যুর সংবাদ ছড়াতে শুরু করে। দেশে বিদেশে সেলিব্রেটি থেকে শুরু করে ভেরিফাইড অনেক অ্যাকাউন্ট থেকেও এ বিষয়ে পোস্ট প্রকাশ করতে দেখা যায়।
এই সংবাদের উৎস হিসেবে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি ছড়িয়ে পড়া পোস্টগুলোতে।
পেলের মৃত্যু সংবাদের সত্যতা অনুসন্ধানে প্রথমে একাধিক আন্তর্জাতিক (গার্ডিয়ান, মার্কা, বিবিসি) এবং পরবর্তীতে ব্রাজিলভিত্তিক একাধিক সংবাদমাধ্যমে (বিবিসি ব্রাজিল, ‘ফোলহা ডি সাও পাওলো) খুঁজে এ সংক্রান্ত কোনো তথ্য পায়নি রিউমর স্ক্যানার টিম।
তাৎক্ষণিকভাবে ‘ফোলহা ডি সাও পাওলো’ পত্রিকা কর্তৃপক্ষের সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার টিম। তবে তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।
অনুসন্ধানে জানা যায়, পেলে ভর্তি হয়েছিলেন ব্রাজিলের সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হাসপাতালে (Hospital Israelita Albert Einstein)।
পরবর্তীতে হাসপাতালটির সাথে ৪ ডিসেম্বর মধ্যরাতে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। রাত ২ টা ১৫ মিনিটে পাঠানো ফিরতি বার্তায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রিউমর স্ক্যানারকে জানায়, “তিনি এখনও চিকিৎসাধীন আছেন এবং তার স্বাস্থ্যের অবস্থা স্থিতিশীল রয়েছে। গত ২৪ ঘন্টার মধ্যে অবস্থার কোন অবনতি হয় নি এবং শ্বাসযন্ত্রের সংক্রমণ চিকিৎসায় তিনি ভাল প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছেন।”
হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ এ বিষয়ে সর্বশেষ প্রকাশিত মেডিকেল রিপোর্টটিও রিউমর স্ক্যানার টিমকে পাঠায়। সেখানেও একই তথ্য দেখা যায়।
পরবর্তীতে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমেও (রয়টার্স, নিউইয়র্ক টাইমস) একই রিপোর্টের বরাতে প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়৷
একইদিন ভোর চারটার কিছু পরে পেলে নিজেও এই বিষয়ে একটি ইনস্টাগ্রাম পোস্ট করেন। উক্ত মেডিকেল রিপোর্টটি সংযুক্ত করে পেলে জানান, “বন্ধুরা, আমি চাই সবাই শান্ত ও ইতিবাচক থাকুক। আমি অনেক আশাবাদী। আমার নিয়মিত চিকিৎসা চলছে। মেডিকেল ও নার্সিং টিমের সদস্যরা যেভাবে আমার যত্ন নিচ্ছেন, সেজন্য আমি তাঁদের ধন্যবাদ জানাতে চাই।”
মূলত, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর থেকে কোলন ক্যান্সারে ভুগছেন পেলে। গত ১ ডিসেম্বর নিয়মিত চেকআপের জন্য ব্রাজিলের সাও পাওলোর আলবার্ট আইনস্টাইন হসপিটালে পেলেকে ভর্তি করা হয় বলে জানায় তাঁর মেয়ে। তবে ব্রাজিলের সংবাদমাধ্যম জানায়, কেমোথেরাপিতে ভালো সাড়া দিচ্ছে না পেলের শরীর। সর্বশেষ পাওয়া এই তথ্যকে কেন্দ্র করে গতকাল পেলের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়ে। নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে এই সংবাদের সত্যতা না পেয়ে সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে যোগাযোগের প্রেক্ষিতে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ রিউমর স্ক্যানারকে জানায়, পেলের অবস্থা স্থিতিশীল এবং গত ২৪ ঘন্টায় তাঁর অবস্থার অবনতি হয়নি। তাছাড়া, পরবর্তীতে ইনস্টাগ্রামে পোস্টের মাধ্যমে পেলে নিজেও ভালো আছেন বলে জানান।
প্রসঙ্গত, ২০১৪ সালে পেলের ভুল মৃত্যুসংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা সিএনএনের টুইটার অ্যাকাউন্টে। কিছুক্ষণ পরেই অবশ্য নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে খবরটি সরিয়ে ফেলেছিল সিএনএন।
সুতরাং, কিংবদন্তি ফুটবলার পেলের মৃত্যুর দাবিটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Statement from Hospital Israelita Albert Einstein
- Instagram post : Pele
- Reuters : Brazil soccer legend Pele says he remains ‘strong’ amid cancer battle
- New York Times : Pelé and His Doctors Push Back on Reports Speculating About His Health