সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দাবি প্রচার করা হচ্ছে, ছাত্রী হলে সালওয়ারের ওপর গেঞ্জি পরিধান নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল কর্তৃপক্ষ। এক্ষেত্রে দাবিকৃত বেশ কিছু পোস্টে ক্যাম্পাস টাইমস নামের একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি সংবাদের স্ক্রিনশটও সংযুক্ত করে প্রচার করা হচ্ছে।
উক্ত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
উক্ত দাবিতে সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদন দেখুন : বাংলাদেশ বুলেটিন।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি পরিধান নিষিদ্ধ করে কোনো নোটিশ বা নিয়ম জারি করা হয়নি বরং প্রচারিত সংবাদের স্ক্রিনশটটি ২০১৭ সালের এবং সেসময়ও এরকম নিয়ম জারির বিষয় কর্তৃপক্ষ অস্বীকার করে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবিটি মূলত ক্যাম্পাস টাইমস প্রেস নামের একটি সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে প্রচার করা হচ্ছে। উল্লিখিত প্রতিবেদনটি পর্যবেক্ষণ করলে জানা যায়, উক্ত প্রতিবেদনটি মূলত ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট তারিখে প্রকাশিত হয়েছিল, তবে গতকাল (৩০ আগস্ট) ও আজ (৩১ আগস্ট) প্রতিবেদনটি হালনাগাদ করা হয়।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে সাম্প্রতিক সময়ে এমন কোনো নিয়ম জারির বিষয়ে মূলধারার গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি৷ তবে ২০১৭ সালে একই বিষয়ে বেশ কিছু মূলধারার গণমাধ্যমে সংবাদ প্রতিবেদন প্রকাশ হতে দেখা যায়। ২০১৭ সালের ২৪ আগস্ট “হলের ভেতর ‘সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি’ নয়” শিরোনামে প্রথম আলোতে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হল কর্তৃপক্ষের নোটিশে বলা হয়েছে, হলের ভেতর দিন বা রাত হোক, কখনোই ছাত্রীদের অশালীন পোশাক (সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি) পরা যাবে না। এ পোশাকে হলের কার্যালয়ে কোনো কাজের জন্য ঢোকা যাবে না। কেউ যদি তা করেন, তবে শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে হল কর্তৃপক্ষ বিধিমোতাবেক ব্যবস্থা নেবে।”
উল্লেখ্য, গতকাল (৩০ আগস্ট) “ছাত্রী হলে সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি পরিধান নিষিদ্ধ করল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়” শিরোনামে বাংলাদেশ বুলেটিন নামে একটি অনলাইন সংবাদমাধ্যম সংবাদ প্রকাশ করে। সংবাদ প্রতিবেদনটিতে তারা আলোচিত নোটিশটি সাম্প্রতিক মর্মেই প্রকাশ করে। তাদের প্রকাশিত সংবাদ প্রতিবেদনে তারা আলোচিত নোটিশটির একটি ছবিও সংযুক্ত করে। সংযুক্ত ছবিতে প্রদর্শিত নোটিশের সাথে ২০১৭ সালে প্রকাশিত সংবাদগুলোতে সংযুক্ত নোটিশের মিল পাওয়া যায়।
তাছাড়া, এ বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৭ সালে আলোচিত নোটিশটি নিয়ে ব্যাপক তোলপাড় হলে হল কর্তৃপক্ষ দাবি করে, নোটিশটি হল কর্তৃপক্ষ থেকে দেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে ২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট কালের কণ্ঠে “সালোয়ার-গেঞ্জির নোটিশ হল কর্তৃপক্ষের নয়!” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে ‘অশালীন পোশাক’ পরে ঘোরাফেরা বা হল অফিসে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা সংক্রান্ত একটি নোটিশ নিয়ে তোলপাড় হওয়ার পর হল কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, নোটিশটি তাদের নয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। হলের প্রাধ্যক্ষ অধ্যাপক সাবিতা রেজওয়ানা রহমান দাবি করেন, নোটিশটি হল কর্তৃপক্ষের নয়। তিনি বলেন, ‘বিকেলে অফিস সময়ের পর এ নোটিশ টানানো হয়েছে। এটা হল কর্তৃপক্ষের নয়। আর এটাতে আমাদের কারো স্বাক্ষরও নেই। এ কাজ কে বা কারা করছে, তা এখনো জানা যায়নি। হলটি ক্যাম্পাসের একেবারে বাইরের দিকে আর এটি কেউ অন্য কোনো উদ্দেশ্যেও করতে পারে। তবে এটা খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে।’”
তাছাড়া, নোটিশ টানানোর দায়িত্বে থাকা হলের জ্যেষ্ঠ প্রশাসনিক কর্মকর্তা জান্নাতুল ফেরদৌস সে সময় বলেন, ‘হলের যাবতীয় নোটিশ আমার মাধ্যমেই বোর্ডে যায়। এ নোটিশটি হল কর্তৃপক্ষের নয়। সাধারণত হলের নোটিশগুলো যে ফরমেটে করা হয়, এটি সে রকম নয়। এটা কেউ উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে টানিয়ে থাকতে পারে।’
এছাড়া, এ বিষয়ে ২০১৭ সালের ২৮ আগস্ট জাগোনিউজ২৪ এ “সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি’” শিরোনামে প্রকাশিত আরেকটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, হল কর্তৃপক্ষ, স্বাক্ষর ও সিল ছাড়া উক্ত নোটিশটিকে ‘বিকৃত ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত’ হিসেবে অভিহিত করে দাবি করেছে, এটি তাদের দেওয়া নয়। ঘটনা তদন্তে হল কর্তৃপক্ষ তিন সদস্যের একটি কমিটিও গঠন করেছে। তবে হলের ছাত্রীদের কেউ কেউ বলছেন, হলের সাধারণ নোটিশ বরাবরই এমন সিল-স্বাক্ষর ছাড়া নোটিশ বোর্ডে ঝুলানো হয়। এখন বিতর্কের কারণে তারা নোটিশটি অস্বীকার করছেন। আবার কেউ কেউ বলছেন, হল কর্তৃপক্ষ সিল-স্বাক্ষর ছাড়া একটি নোটিশ দিয়েছিল বটে, যাতে যথাযথ পোশাক পরে হল অফিসে আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু তাতে নির্দিষ্ট কোনো পোশাকের কথা বলা হয়নি। কিন্তু যে নোটিশ নিয়ে তোলপাড়, তাতে লেখা ছিল ‘হলের অভ্যন্তরে দিনের বেলা অথবা রাতের বেলা কখনোই অশালীন পোশাক (সালোয়ার এর ওপর গেঞ্জি) পরে ঘোরা ফেরা অথবা হল অফিসে কোন কাজের জন্য প্রবেশ করা যাবে না। অন্যথায় শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য হল কর্তৃপক্ষ বিধি মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।’
অর্থাৎ, দেখা যাচ্ছে, ২০১৭ সালের নোটিশটিও হল কর্তৃপক্ষ দিয়েছিল কি না তা নিয়ে যথেষ্ট বিতর্ক তৈরি হয়েছিল। সাম্প্রতিক সময়ে মূলত সেই সময়কার সংবাদকেই নতুন করে আবার প্রচার করা হচ্ছে।
সাম্প্রতিক সময়ে কবি সুফিয়া কামাল হল কর্তৃপক্ষ এরকম কোনো নোটিশ দিয়েছে কি না এ বিষয়ে অধিকতর নিশ্চিত হতে রিউমর স্ক্যানার যোগাযোগ করে চ্যানেল২৪ এর ঢাবি প্রতিনিধি বোরহান উদ্দিন এবং আমাদের সময়ের ঢাবি প্রতিনিধি আশিকুল হক রিফাতের সাথে। তারা জানিয়েছেন, সাম্প্রতিক সময়ে ঢাবিতে এরকম কোনো নোটিশের বিষয়ে কোনোকিছু শোনা যায়নি। তবে, ২০১৭ সালে এরকম কিছু শোনা গিয়েছিল, তবে সেটি হল কর্তৃপক্ষ দিয়েছিল কি না সে বিষয়ে নিশ্চিত নন। দেশ রূপান্তরের ঢাবি প্রতিনিধি আমজাদ হোসেনের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি নিশ্চিত করেন সাম্প্রতিক সময়ে এরকম কোনো নোটিশ দেওয়া হয়নি।
সুতরাং, সম্প্রতি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কবি সুফিয়া কামাল হলে সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি পরিধান নিষিদ্ধ করা হয়েছে শীর্ষক দাবিতে প্রচারিত দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- Campustimes Press – ছাত্রী হলে সালওয়ারের ওপর গেঞ্জি পরিধান নিষিদ্ধ করেছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
- Prothom Alo – হলের ভেতর ‘সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি’ নয়
- Kaler Kantho – সালোয়ার-গেঞ্জির নোটিশ হল কর্তৃপক্ষের নয়!
- Jago News24 – ‘সালোয়ারের ওপর গেঞ্জি’
- Statement of Borhan Uddin, DU Correspondent, Channel24
- Statement of Ashikul Haque Rifat, DU Correspondent, Amader Somoy
- Statement of Amjad Hossain, DE Correspondent, Desh Rupantor
- Rumor Scanner’s own analysis