“পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাংক নোট বাংলাদেশের দুই টাকা” শীর্ষক শিরোনামের একটি তথ্য বিগত কয়েক বছর ধরে বাংলাদেশ ব্যাংক, গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে।
কী দাবি করা হচ্ছে?
বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক ২০১২ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারীতে প্রকাশিত মাসিক বাংলাদেশ ব্যাংক পরিক্রমা ম্যাগাজিনে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর নোট বাংলাদেশের দুই টাকার নোট শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দুই টাকার কাগজের নোট বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর কাগুজে নোট হিসেবে মর্যাদা লাভ করেছে।

জাতীয় দৈনিক আমাদের সময় পত্রিকার ওয়েবসাইটে চলতি বছরের ২২ জানুয়ারী বাংলাদেশি ২ টাকার নোট পৃথিবীর সব থেকে সুন্দর ব্যাংক নোটের মর্যাদা পেয়েছে শিরোনামে (আর্কাইভ) একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। কিন্তু প্রতিবেদনটিতে শিরোনাম ছাড়া আর কোনো বিস্তারিত লেখা খুঁজে পাওয়া যায় নি।

একই দাবিতে গেল কয়েক বছরে গণমাধ্যমের কিছু প্রতিবেদন দেখুন- বাংলানিউজ২৪ (আর্কাইভ), যুগান্তর (আর্কাইভ), ডেইলি বাংলাদেশ (আর্কাইভ), The Business Standard (আর্কাইভ)।
দেশের জনপ্রিয় এডুকেশন প্লাটফর্ম Ten Minute School এর ওয়েবসাইটে ২০১৭ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রকাশিত একটি ব্লগে (আর্কাইভ) দাবি করা হয়, “২০১২ সালে রাশিয়ার একটি অনলাইন এন্টারটেইনমেন্ট আউটলেটে পোলের মাধ্যমে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর নোট হিসেবে স্বীকৃতি পায় ২ টাকার এই নোটটি।”

একই দাবিতে ফিচার প্লাটফর্ম রোর বাংলা‘য় ২০১৭ সালের ২৮ অক্টোবর প্রকাশিত আর্টিকেল দেখুন- এখানে (আর্কাইভ)।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
ইউটিউবে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। ভিডিওগুলর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের দুই টাকার নোট পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাংক নোটের স্বীকৃতি পাওয়ার দাবিটি সত্য নয় বরং আর্মেনিয়ান একটি নিউজের নামহীন সূত্রের বরাতে গত কয়েক বছর ধরে উক্ত তথ্যটি প্রচারিত হচ্ছে।
কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, আর্মেনিয়ার সংবাদ মাধ্যম ‘Panarmenian’ এর ওয়েবসাইটে ২০১২ সালের ৭ জানুয়ারী “Bangladesh taka voted most beautiful bank note” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ‘রাশিয়ান অনলাইন এন্টারটেইনমেন্ট আউটলেটের একটি জরিপ অনুসারে, বাংলাদেশের দুই টাকার নোট বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে সুন্দর ব্যাংক নোটের মধ্যে ১ম স্থান লাভ করেছে।’

প্রতিবেদনে তালিকার ২০টি স্থানের কাগজের নোটের তথ্য এসেছে। সংবাদমাধ্যমটি কোন সূত্র থেকে এই তথ্য পেয়েছে সেটি উল্লেখ করা হয়নি প্রতিবেদনে। প্রতিবেদনটিতে জরিপকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে রাশিয়ান অনলাইন এন্টারটেইনমেন্ট আউটলেটের তথ্য দেওয়া হয়েছে। একই সূত্র ব্যবহার করা হয়েছে বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়া গণমাধ্যমের প্রতিবেদন ও ফেসবুক পোস্টগুলোতেও।
বিস্তারিত অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম দেখেছে, নামহীন উক্ত রাশিয়ান সূত্রটির অনলাইনে কোনো অস্তিত্ব নেই। এডভান্স সার্চ পদ্ধতিতেও, ‘Panarmenian’ এর প্রতিবেদনটি যে সময়ে প্রকাশিত হয় অর্থাৎ ২০১২ সালের ৭ জানুয়ারী, তার আগে কোনো সংবাদমাধ্যমেই এ সংক্রান্ত খবর পাওয়া যায়নি।
অর্থাৎ, ‘Panarmenian’ই এ সংক্রান্ত তথ্যের উৎস বলে প্রতীয়মান হয়।
এই তথ্যের উৎস সম্পর্কে নিশ্চিত হতে ‘Panarmenian’ এর সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে রিউমর স্ক্যানার টিম। কিন্তু এই প্রতিবেদন প্রকাশ হওয়ার আগ পর্যন্ত তাদের পক্ষ থেকে কোনো সাড়া মেলেনি।
সেরা ব্যাংক নোট স্বীকৃতির প্রচলন আছে?
১৯৬১ সালে প্রতিষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ব্যাংকিং সংগঠন ‘International Bank Note Society’ ২০০৪ সাল থেকে নিয়মিত প্রতি বছর Bank Note of the Year স্বীকৃতি দিয়ে আসছে। সংগঠনটির ওয়েবসাইটে এ সংক্রান্ত সর্বশেষ তথ্যগুলো বিশ্লেষণ করা দেখা যায়, ২০০৮ সালে বাংলাদেশের ১০০০ টাকার ব্যাংক নোট সেরা ব্যাংক নোটের নমিনেশন পায়। একইভাবে ২০২০ সালে বাংলাদেশের ২০০ টাকার ব্যাংক নোটও সে বছরের ব্যাংক নোট অব দ্য ইয়ারে নমিনেশন পায়।


অর্থাৎ, বাংলাদেশের ব্যাংক নোট পূর্বে একাধিকবার নমিনেশন পেলেও International Bank Note Society কর্তৃক সেরা ব্যাংক নোটের স্বীকৃতি পায়নি।
মূলত, ২০১২ সালে আর্মেনিয়ান একটি সংবাদমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশের দুই টাকার ব্যাংক নোট বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর নোটের স্বীকৃতি পেয়েছে। নামহীন রাশিয়ান একটি আউটলেটের সূত্র ব্যবহার করে প্রকাশিত উক্ত প্রতিবেদনের বরাতে বিগত কয়েক বছর ধরে উক্ত তথ্যটি বাংলাদেশ ব্যাংকসহ দেশের একাধিক সংবাদমাধ্যম ও ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে। কিন্তু আর্মেনিয়ান সংবাদমাধ্যমটি রাশিয়ান অনলাইন এন্টারটেইনমেন্ট আউটলেটের যে সূত্র ব্যবহার করেছে তার কোনো অস্তিত্ব খুঁজে পায়নি রিউমর স্ক্যানার। তাছাড়া, ব্যাংক নোটের সৌন্দর্যের বাৎসরিক স্বীকৃতি প্রদানকারী IBNS-ও বাংলাদেশের কোনো ব্যাংক নোটকে এখনও সেরার স্বীকৃতি দেয়নি৷
উল্লেখ্য, আশির দশকে বাংলাদেশ সরকার দুই টাকার কাগজের নোট চালুর উদ্যোগ নেয়৷ রফি উদ্দিন আহমেদের ডিজাইন করা এই নোট বাজারে আসে ১৯৮৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক নির্ধারিত ডলারের বিনিময় মূল্য বিষয়ে গুজব ছড়িয়ে পড়লে উক্ত বিষয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার।
সুতরাং, বাংলাদেশের দুই টাকার নোটকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর ব্যাংক নোটের স্বীকৃতির দাবিটি বিভ্রান্তিকর।
তথ্যসূত্র
- International Bank Note Society: Bank Note of the Year
- Panarmenian: Bangladesh taka voted most beautiful bank note