রাজধানীর উত্তরার দিয়াবাড়ীতে মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজে বিমান বাহিনীর একটি যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় আগুনের লেলিহান শিখার মধ্যে থেকে ছোট ছোট শিক্ষার্থীদের উদ্ধার করতে গিয়ে মারাত্মকভাবে দগ্ধ হন প্রতিষ্ঠানটির বাংলা বিভাগের শিক্ষিকা মেহেরীন চৌধুরী। পরে তাকে জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নেওয়া হলে আইসিইউতে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তার মৃত্যু হয়। এই প্রেক্ষাপটে, শিক্ষিকা মেহেরীন চৌধুরীর ‘শেষ বক্তব্য’ দাবিতে অন্তত দুটি ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
প্রথম ভিডিওতে মেহেরীন চৌধুরীর মতো দেখতে এক ব্যক্তিকে মাইক্রোফোন হাতে বলতে শোনা যায়, “আমি মেহরিন চৌধুরী আপনাদের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছি, যদি আপনাদের সন্তানদের কিছু হয় তবে আপনাদের আমার ওপর দিয়ে যেতে হবে। আপনার সন্তানদের রক্ষার দায়িত্বও আমাদের। বিপদে-আপদে তাদের পাশে সবসময় থাকব।”

এই ভিডিওসহ ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন: এখানে, এখানে, এখানে, এখানে।
ইন্সটাগ্রামে প্রচারিত একই দাবি দেখুন: এখানে, এখানে।
ইউটিউবে প্রচারিত দাবি দেখুন: এখানে, এখানে, এখানে।
টিকটকে প্রচারিত দাবি দেখুন: এখানে।
থ্রেডসে প্রচারিত দাবি দেখুন: এখানে।
দ্বিতীয় ভিডিওতেও মেহেরীন চৌধুরীর মতো এক ব্যক্তিকে বলতে শোনা যায়, “আমি মাহরিন, মাইলস্টোন স্কুলের শিক্ষার্থীদের বিপদে-আপদে তাদের সাথে সবসময় থাকবো। তারা আমাদের সন্তান। তাদের শুধু লেখাপড়া না, তাদের রক্ষার দায়িত্বও কিন্তু আমাদের। অঙ্গীকার করছি, তাদের খেয়াল রাখব।”

এই ভিডিওসহ ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন: এখানে।
ইউটিউবে প্রচারিত একই দাবি দেখুন: এখানে, এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত ভিডিওগুলো মাইলস্টোন স্কুলের নিহত শিক্ষিকা মেহেরীন চৌধুরীর শেষ বক্তব্যের নয়। বরং, এসব ভিডিও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) প্রযুক্তি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছে।
প্রথম ভিডিও যাচাই
আলোচিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করে একাধিক এআই-জনিত অসংগতি লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার টিম। কথিত মেহেরীন চৌধুরীর মুখভঙ্গি অপ্রাকৃতিক ও অস্বাভাবিক মনে হয়। কথা বলার সময় ঠোঁট ও চোয়ালের নড়াচড়ায় অস্বাভাবিকতা দেখায়। চোখের পলক ফেলা অপ্রাকৃতিক, যেখানে একটি ফ্রেমে এক চোখ বন্ধ থাকলেও অন্য চোখ খোলা থেকে যায়। এছাড়া, আঙ্গুলের গঠনও অস্বাভাবিক, একটি ফ্রেমে আঙ্গুল অসম্পূর্ণ দেখায়। আঙ্গুলে পরা আংটির ডিজাইন ভিডিওর মধ্যে একাধিকবার পরিবর্তিত হয়। তাছাড়া, মুখের টেক্সচারও অস্বাভাবিকভাবে মসৃণ এবং বয়সের স্বাভাবিক কোনো ছাপ নেই, তবে একটি ফ্রেমে চোয়ালে বয়সের ছাপ স্পষ্ট হয়। হাতের আঙুলের ক্ষেত্রেও কিছু ফ্রেমে একদম মসৃণ থাকে, আবার কিছু ফ্রেমে বয়সের ছাপ লক্ষ করা যায়।

বিষয়টি নিয়ে আরও অনুসন্ধানে ‘Rashed Khan’ নামের একটি ফেসবুক প্রোফাইলে ২২ জুলাই মেহেরীন চৌধুরীর বক্তব্য দেওয়ার একটি ভিডিও পাওয়া যায়। এই ভিডিওতেও তাকে মাইক্রোফোন হাতে বক্তব্য দিতে দেখা যায়, আর পেছনের ব্যক্তির অবস্থানও আলোচিত ভিডিওর সঙ্গে মিলে যায়। তবে দুটি ভিডিওর মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্যও দেখা যায়। যেমন- মেহেরীন চৌধুরীর পোশাকের নকশা এক হলেও রঙ ভিন্ন, আলোচিত ভিডিওটি তুলনামূলকভাবে আরও স্পষ্ট এবং কণ্ঠস্বরেও পার্থক্য রয়েছে। এছাড়া, রাশেদ খানের ভিডিওতে তাকে আলোচিত ভিডিওর মতো বক্তব্য দিতে শোনা যায়নি। এসব বিশ্লেষণে নিশ্চিত হওয়া যায়, মূল ভিডিওটি ব্যবহার করেই এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।
দ্বিতীয় ভিডিও যাচাই
এই ভিডিওতেও পূর্বেরটির মতো একাধিক এআই-জনিত অসংগতি ধরা পড়ে। বক্তব্যের শুরুতেই কথিত মেহেরীন চৌধুরী নিজের নাম ভুলভাবে ‘মাহরিন’ বলে উল্লেখ করেন। ত্বক অস্বাভাবিকভাবে মসৃণ ও চেহারায় বয়সের কোনো স্বাভাবিক ছাপ নেই। একটি ফ্রেমে দেখা যায়, এক চোখ বন্ধ থাকলেও অন্য চোখ খোলা রয়েছে। এছাড়া, কণ্ঠস্বরেও প্রকৃত মেহেরীন চৌধুরীর সঙ্গে পার্থক্য লক্ষ্য করা যায়।

আরও অনুসন্ধানে, ২১ জুলাই ‘ALL IN ONE (Jaldhaka)’ নামের একটি ফেসবুক গ্রুপে ‘Firoz Jaldhaka’ নামের প্রোফাইল থেকে মেহেরীন চৌধুরীর একটি ছবি পাওয়া যায়। একই ছবি মূলধারার দৈনিক বাংলাদেশ প্রতিদিনের একটি ভিডিও প্রতিবেদনে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়। আলোচিত ভিডিওতে ব্যবহৃত মুখচ্ছবিটির সঙ্গে এই ছবির হুবহু মিল রয়েছে। বিশ্লেষণে নিশ্চিত হওয়া যায়, এই ছবিটি ব্যবহার করেই এআই প্রযুক্তির মাধ্যমে দ্বিতীয় ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

বিষয়টি আরও নিশ্চিত হতে উভয় ভিডিওই ডিপফেক শনাক্তকারী ‘ডিপফেক-ও-মিটার’ টুলের ‘AVSRDD (2025)’ মডেলের মাধ্যমে পরীক্ষা করা হয়। মডেলটির বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিডিওগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি হওয়ার সম্ভাবনা ৯৯ শতাংশ।
এসব বিষয় ছাড়াও, গণমাধ্যম বা কোনো বিশ্বস্ত সূত্রে মেহেরীন চৌধুরীর এমন কোনো বক্তব্যের অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি।
সুতরাং, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) দিয়ে তৈরি দুটি ভিডিওকে উত্তরার মাইলস্টোনে যুদ্ধবিমান বিধ্বস্তের ঘটনায় নিহত শিক্ষিকা মেহেরীন চৌধুরীর শেষ বক্তব্য দাবিতে প্রচার করা হয়েছে, যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Rumor Scanner’s analysis.
- Rashed Khan: Facebook Post
- Firoz Jaldhaka: Facebook Post
- Bangladesh Pratidin: YouTube Video
- Deepfake-o-meter.