তিন স্ত্রী রেখেও অন্যের বউ নিয়ে ইমামের পালানোর পুরনো ঘটনায় ভুল ছবি প্রচার

সম্প্রতি, “তিন স্ত্রী রেখেও মসজিদ কমিটির সভাপতির বউ নিয়ে পালালেন ইমাম সাহেব” শীর্ষক শিরোনামের একটি পোস্টে এক পুরুষ ও নারীর একটি ছবি সংযুক্ত করে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

সাম্প্রতিক সময়ে ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।

একই দাবিতে ২০২১ সালে একটি অনলাইন পোর্টালের প্রতিবেদন দেখুন ক্রাইম নিউজ

Screenshot source: crime news bd

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, তিন স্ত্রী রেখেও অন্যের বউ নিয়ে ইমামের পালানোর ঘটনাটি সাম্প্রতিক সময়ের নয় এবং উক্ত তথ্যের সাথে সাবেক একজন মেয়র প্রার্থীর ছবিকে ইমামের ছবি দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।

গুজবের সূত্রপাত

ফেসবুক মনিটরিং টুলস ব্যবহার করে দেখা যায়, আলোচিত বিষয়ে সাম্প্রতিক সময়ের মধ্যে গত ১৩ ডিসেম্বরে (২০২২) প্রথম পোস্ট প্রকাশ করা হয়। একাধিক ভূঁইফোড় পোর্টালের মাধ্যমে সেদিন আলোচিত ছবি ও তথ্যগুলো ব্যবহার করে একাধিক পোস্ট (দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে) প্রকাশিত হয়। 

তবে উক্ত ভূঁইফোড় পোর্টালগুলোর লিংকে ক্লিক (দেখুন এখানে এবং এখানে) করে আলোচিত খবরটি খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

অনুসন্ধান যেভাবে

আলোচিত ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে, অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘Jagonews24’ এর ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ১২ জানুয়ারী “অন্যের স্ত্রীকে ভাগিয়ে বিয়ে করলেন জাপার মেয়র প্রার্থী” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে আলোচিত ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার ঘটনায় জাতীয় পার্টির (জাপা) খুলনা সিটি কর্পোরেশনের মেয়র প্রার্থী হিসেবে পরিচিত এস এম মুশফিকুর রহমানের (সজল) বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে। আগের বছর অর্থাৎ ২০১৭ সালের ৮ অক্টোবর গোলাম সরোয়ার বাপ্পী নামের একজন তার স্ত্রী হুমায়রা আহমেদ জিনিয়াকে ভাগিয়ে নেয়ার অভিযোগে মুশফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা করেন।

মামলার এজাহারের বরাতে প্রতিবেদনে বলা হয়, আসামি মুশফিকুর রহমান বাদীর স্ত্রী জিনিয়ার পূর্বপরিচিত। এ জন্য মুশফিক প্রায় তাদের বাসায় যাতায়াত করতো। এ সুযোগে মুশফিকুর রহমান তার স্ত্রীর সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তোলে। তারই ধারাবাহিকতায় গত ১৭ আগস্ট বিকেল ৩টায় তার স্ত্রী শ্বশুরবাড়ি যাওয়ার কথা বলে মুশফিকের হাত ধরে চলে যায়।

Screenshot source: Jagonews24

এ বিষয়ে সে সময় আরও দুইটি গণমাধ্যমে (বাংলাদেশ জার্নাল, পূর্ব পশ্চিম বিডি) সংবাদ প্রকাশিত হয়। দুইটি প্রতিবেদনই জাগোনিউজের প্রতিবেদনটিই হুবহু প্রকাশ করেছে। 

প্রতিবেদনগুলোতে মুশফিকুর রহমান মসজিদের ইমাম ছিলেন এবং মসজিদ কমিটির সভাপতির স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছেন শীর্ষক কোনো তথ্য উল্লেখ করা হয়নি। 

পরবর্তীতে অনুসন্ধানে জাতীয় দৈনিক যুগান্তর এর ওয়েবসাইটে ২০১৮ সালের ১১ এপ্রিল প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সে বছরের ১৫ মে খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনকে সামনে রেখে জাতীয় পার্টির প্রার্থী ঘোষণা করা হয়েছে। মেয়র পদের প্রার্থী হিসেবে এস.এম. মুশফিকুর রহমানের নাম ঘোষণা করা হয়েছে। 

তবে ৩০ এপ্রিল বিডিনিউজ২৪ এক প্রতিবেদনে উক্ত প্রার্থীর নাম এসএম শফিকুর রহমান উল্লেখ করা হয়েছে। প্রতিবেদনে প্রকাশিত নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা সম্পর্কিত একটি ব্যানারেও একই নাম উল্লেখ পাওয়া যায়। 

Screenshot source: bdnews24

উক্ত ব্যক্তির আসল নাম এসএম শফিকুর রহমান নাকি এস এম মুশফিকুর রহমানের (সজল) সে বিষয়ে অনুসন্ধানে খুলনার স্থানীয় অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘প্রথম সময়’ এর সম্পাদক শাহীন রহমান এর ২০১৮ সালের ১৮ মে প্রকাশিত একটি ফেসবুক পোস্ট থেকে জানা যায়, এস এম শফিকুর রহমান, কিংবা মুশফিকুর রহমান নাম হলেও মুশফেক নামেই সমধিক পরিচিত। খুলনা সিটি কর্পোরেশনে এবার জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী ছিলেন। ভোট পেয়েছেন মাত্র এক হাজার ৭২। নানা কারণে মুশফিক খুলনা শহরে আলোচিত একটি নাম ! ভোটের পর জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মাদ এরশাদ দল থেকে বহিস্কার করেছেন মুশফেককে !”

Screenshot source: Facebook

অর্থাৎ, আলোচিত ছবির উক্ত ব্যক্তি কোনো ইমাম নয় এবং তিনি কোনো মসজিদ কমিটির সভাপতির স্ত্রীকেও নিয়ে পালিয়ে যাননি। উক্ত ব্যক্তির নাম এসএম শফিকুর রহমান ওরফে এস এম মুশফিকুর রহমানের (সজল), যিনি ২০১৮ সালে খুলনা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল জাতীয় পার্টির মেয়র প্রার্থী ছিলেন।

আলোচিত ঘটনার সূত্রপাত

আলোচিত ঘটনার সূত্রপাত অনুসন্ধানে কিওয়ার্ড সার্চ করে ‘Jagonews24’ এর ওয়েবসাইটে ২০২১ সালের ২১ এপ্রিল “তিন স্ত্রী রেখে অন্যের বউ নিয়ে পালালেন সাবেক ইমাম” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, রাজশাহীর বাগমারা উপজেলার হামিরকুৎসা গ্রামের বাসিন্দা আব্দুর রাজ্জাক বাচ্চু (৬০)। মোট বিয়ে করেছেন তিনটি। এরপরও অন্যের স্ত্রী নিয়ে পালিয়েছেন তিনি। বাচ্চু উপজেলার গোয়ালকান্দি ইউনিয়নের বাগিচাপাড়া এলাকায় মসজিদের সাবেক ইমাম। পাশাপাশি তিনি কবিরাজির কাজও করতেন। ওই নারীর স্বামী প্যারালাইসিস রোগী ছিলেন। কবিরাজি চিকিৎসার জন্য নিয়মিত তার বাসায় যেতেন। একইসঙ্গে তিনি ওই নারীকে নিয়মিত কুরআন শিক্ষাও দিতেন। কিছুদিন পরই তার ছেলেদের সন্দেহ হওয়ায় তাকে বাসায় আসতে নিষেধ করেন। এরপরও বাচ্চু বাড়ির আশপাশে ঘোরাঘুরি করতেন। ১১ এপ্রিল ওই নারী তার বাবার বাড়ি বেড়াতে যাবেন বলে ঘর থেকে বের হন। কিন্তু পরে আর বাড়ি ফিরেননি। অনেক খোঁজাখুঁজির পর জানা গেছে বাচ্চু হুজুর তাকে ভাগিয়ে নিয়ে গেছেন।

প্রতিবেদনে বাচ্চুর একটি ছবিও যুক্ত করা হয়েছে। এই ছবির সাথে আলোচিত ছবির ব্যক্তির মিল পাওয়া যায়নি। 

Screenshot source: Jagonews24

এ বিষয়ে সে সময় জাতীয় দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায়ও প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়।

অর্থাৎ, আলোচিত ঘটনাটি ২০২১ সালের রাজশাহীর এক সাবেক ইমামের। তবে তিনি মসজিদ কমিটির সভাপতির স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছেন এমন তথ্য উল্লেখ নেই এ সংক্রান্ত প্রতিবেদনে বরং উক্ত নারীর স্বামী প্যারালাইসিস রোগী ছিলেন।

মূলত, ২০২১ সালে রাজশাহীতে তিন স্ত্রী রেখে একজন প্যারালাইসিস রোগীর স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়ে যান সাবেক ইমাম আব্দুর রাজ্জাক বাচ্চু। এই ঘটনাকে সম্প্রতি এক পুরুষ ও নারীর যুগল ছবি ব্যবহার করে উক্ত ব্যক্তি মসজিদ কমিটির সভাপতির স্ত্রীকে নিয়ে পালিয়েছেন দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। তবে প্রচারিত ছবিটি উক্ত ইমামের নয় এবং উক্ত নারীর স্বামী মসজিদ কমিটির সভাপতিও নয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, ২০১৮ সালে খুলনায় জাপার মেয়র প্রার্থী এসএম শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অন্যের স্ত্রীকে নিয়ে পালানোর অভিযোগের বিষয়ে গণমাধ্যমে প্রচারিত প্রতিবেদনে আলোচিত ছবিটি প্রচার করা হয়। সেই ছবিটি ২০২১ সালের ভিন্ন একটি ঘটনার সাথে জুড়ে দিয়ে ফেসবুকে একই ঘটনা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। 

সুতরাং, ২০২১ সালের একটি ঘটনার সাথে ২০১৮ সালের ভিন্ন আরেকটি ঘটনায় জড়িত ব্যক্তির ছবি জুড়ে দিয়ে ফেসবুকে একই ঘটনা দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img