শুক্রবার, মে 23, 2025

গাজীপুরে হিন্দুদের মধ্যে হওয়া পারিবারিক দ্বন্দ্বের জেরে হামলার ঘটনাকে সাম্প্রদায়িক রং মিশিয়ে প্রচার

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একটি আপত্তিকর কোপানোর ভিডিও প্রচার করে দাবি করা হয়েছে, “গরুর জন্য কচুরীপানা কাটার জন্য বাংলাদেশে এক পরিবারের 3 জন হিন্দুকে 3 জন মুস*লিম কুড়ুল দিয়ে কুপিয়ে নির্মমভাবে হ*ত্যা করলো”।

উল্লেখ্য যে, ভারত থেকে পরিচালিত ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকেও এরূপ দাবি প্রচার করা হয়েছে।

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

তাছাড়া, আলোচিত ভিডিওর সাথে কিছু আহত ব্যক্তিদের ছবি সংযুক্ত করে হামলাকারীরা বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর উগ্রপন্থী দাবিতে এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রচার করা হয়েছে। এরূপ দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, গাজীপুরের কালীগঞ্জে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ওপর মুসলিমদের হামলার আলোচিত দাবিটি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে এটি একটি পারিবারিক দ্বন্দ্ব/বিবাদের জেরে হওয়া হামলার ঘটনা এবং হামলাকারীরাও হিন্দু ধর্মাবলম্বী। তাছাড়া, শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত এই ঘটনায় কেউ নিহত হননি।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির একাধিক কি-ফ্রেম নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে ‘Gautam Chandra Das’ নামের একটি ফেসবুক অ্যাকাউন্ট থেকে গত ৩১ মার্চে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়৷ উক্ত ভিডিওটির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির তুলনা করলে সাদৃশ্য পাওয়া যায়। 

ভিডিওটি সম্পর্কে ক্যাপশনে বলা হয়, “গাজীপুর কালিগঞ্জ ৬ নং ওয়ার্ড চান্দায়া গ্রাম এ গঠনা গরুর জন্য কচুড়িপানা কাটার জন্য একি পরিবারের তিন জন কে কুয়াড় দিয়ে কুপিয়ে জখম।” তবে, প্রচারিত ভিডিওটি উক্ত ঘটনারই কি না সে বিষয়ে কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

উক্ত পোস্ট থেকে প্রাপ্ত তথ্যের সূত্র ধরে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে মূলধারার সংবাদমাধ্যম দেশ রূপান্তরের ওয়েবসাইটে গত ৩১ মার্চ “কালীগঞ্জে জমি নিয়ে দ্বন্দ্বে কুড়ালের কোপে ৪ জন আহত” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত প্রতিবেদনটিতে বলা হয়, “গাজীপুরের কালীগঞ্জ পৌরসভার ৬ নম্বর ওয়ার্ডের চান্দাইয়া গ্রামে সম্পত্তি নিয়ে মামলার জেরে এক চাচতো ভাই আরেক চাচাতো ‌ভাইকে কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে আহত করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। রবিবার (৩০ মার্চ) কালীগঞ্জে জমি সংক্রান্ত পূর্ব শত্রুতার জের ধরে রামচরণ ও তার ছেলে ঝন্টু দাস কুড়াল দিয়ে চাচাতো ভাই নারায়ণ, গিরিবালা ও হারাধন চন্দ্র দাসকে হত্যার উদ্দেশ্য কোপান।

জানা গেছে, রবিবার দুপুরবেলা নারায়ণ তার গরুর খাওয়ার জন্য বাড়ির পাশের পুকুরে কচুরিপানা কাটতে যান। এটা দেখে রামচরণ ও তার ছেলে গালাগালি করেন। এক পর্যায়ে রামচরণের ছেলে লাঠি নিয়ে নারায়ণকে মারতে যান, পাশাপাশি রামচরণ কুড়াল নিয়ে নারায়ণকে এলোপাতাড়ি কোপাতে থাকেন। এ সময় নারায়ণের স্ত্রী-ভাই তাকে বাঁচাতে এগিয়ে যান। রামচরণ প্রথমে নারায়ণকে অনেকগুলো কোপ দেন, পরে নারায়ণের স্ত্রী গিরিবালাকে কোপ দেন। পরবর্তীতে এলাকাবাসী নারায়ণের স্ত্রী ও তার ভাইকে উদ্ধার করে কালীগঞ্জ সদর হাসপাতালে নিয়ে গেলে চিকিৎসক তাদের অবস্থা গুরুতর দেখে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকা পাঠান। পাশাপাশি রামচন্দ্র, রামচরণ ও তার ছেলে কালীগঞ্জ হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।”

অর্থাৎ, আলোচিত ঘটনাটিতে হামলাকারীরাও হিন্দু ধর্মাবলম্বী ছিলেন।

এছাড়া, আলোচিত দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্টে সংযুক্ত ছবি নিয়ে রিভার্স ইমেজ সার্চ করলে সরকারি মিডিয়াভুক্ত ‘জাতীয় পত্রিকা একুশে’ নামের একটি সংবাদমাধ্যমের ওয়েবসাইটে “জমিজমা সংক্রান্ত বিরোধে রামচরনের চাইনিজ কুড়ালের আঘাতে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে নারায়ণ চন্দ্র দাস” শীর্ষক শিরোনামে গত ৩১ মার্চে প্রকাশিত একটি সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়।

Comparison : Rumor Scanner

উক্ত প্রতিবেদনটিতে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত এক্স পোস্টে সংযুক্ত তিনটি ছবির মধ্যে দুইটি ছবির সংযুক্তি পাওয়া যায়। এ বিষয়ে উক্ত প্রতিবেদনটি থেকেও হামলাকারীরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী হওয়ার বিষয়ে একইরকম তথ্য জানা যায়।

গত ৩১ মার্চে বাংলাদেশ পুলিশের ভেরিফাইড ফেসবুক পেজ থেকেও এ বিষয়ে একটি পোস্ট করা হয়েছে। উক্ত পোস্টটিতে বলা হয়েছে, হামলাকারীরা হিন্দু ধর্মাবলম্বী এবং সম্পর্কে চাচাতো ভাই। এবং আহত হিসেবে ৪ জনের নাম উল্লেখ করা হয়। তবে কারোর নিহতের বিষয়ে উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এছাড়াও বলা হয়, “…একটি সুযোগ সন্ধানী পক্ষ বিষয়টিকে সাম্প্রদায়িক তকমা দিয়ে ও অসত্য তথ্য প্রচার করে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটানোর অপপ্রয়াস চালাচ্ছে। গুজব প্রতিরোধে সকলকে সতর্ক থাকার জন্য আহ্বান জানানো হচ্ছে।”

উল্লেখ্য যে, উপরোক্ত কোনো প্রতিবেদনেই কারোর নিহত হওয়ার বিষয়ে উল্লেখ করা হয়নি।

সুতরাং, গাজীপুরের কালীগঞ্জে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পারিবারিক দ্বন্দ্ব/বিবাদের জেরে কোপানোর ঘটনাকে হিন্দু ধর্মাবলম্বীর ওপর মুসলিমদের আক্রমণ দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা বিভ্রান্তিকর।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img