চট্টগ্রামে হাজারী গলিতে মো. ওসমান নামের এক দোকানদার ফেসবুকে ধর্মীয় সংগঠন ইসকন নিষিদ্ধের দাবি সংক্রান্ত একটি পোস্ট শেয়ার করায় গতকাল (০৫ নভেম্বর হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয়ে তার দোকানে হামলা চালায়। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে যৌথ বাহিনী ঘটনাস্থলে পৌঁছালে, ওসমানকে তাঁদের হাতে তুলে দেওয়ার দাবি জানায় এবং ইটপাটকেল ছোড়ে। এক পর্যায়ে বিক্ষুদ্ধ ব্যক্তিদের ছোঁড়া অ্যাসিডে সহকারী কমিশনারসহ সাত পুলিশ সদস্য আহত হন। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে যৌথ বাহিনী অভিযানে নামে। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একজন ব্যক্তির ছবি প্রচার করে দাবি করা হচ্ছে, চট্টগ্রামে পুলিশ ও সেনাবাহিনীর হামলায় এক হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিহত হয়েছেন।
উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
এছাড়াও, কোনো ছবি সংযুক্তি ছাড়াও উক্ত সংঘর্ষে একজন নিহত হওয়ার দাবিটি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রচার হতে দেখা যায়।
উক্ত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
পাশাপাশি, উক্ত সংঘর্ষে ৫ জন সনাতনী নিহত হয়েছেন এমন দাবিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে।
৫ জন নিহতের দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
একই ঘটনায় ৭ জন হিন্দু ধর্মাবলম্বী নিহত হয়েছেন দাবিতে বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রশিবিরের নামে একটি ভুয়া টেলিগ্রাম চ্যানেলেও দাবি প্রচার করা হয়৷ যার স্ক্রিনশট সংযুক্ত করে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়। ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
একই দাবিটি এক্সেও পোস্ট করা হয়। এক্সে উক্ত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
এছাড়াও, ভারত ভিত্তিক একাধিক এক্স অ্যাকাউন্ট থেকেও উক্ত ঘটনায় নিহতের নানা সংখ্যাসহ দাবি প্রচার করা হয়। প্রায় ৪৩ জন নিহত দাবিতে এক্সে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং ৫০ জনেরও অধিক নিহত দাবিতে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, গতকাল (০৫ নভেম্বর) চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে বিক্ষোভ ও সংঘর্ষের ঘটনায় এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি কেউ নিহত হননি। প্রকৃতপক্ষে গেল সেপ্টেম্বর মাসে খাগড়াছড়িতে সংঘর্ষে নিহত ব্যক্তির ছবি দাবিতে প্রচারিত ছবিকে গতকাল চট্টগ্রামে সংঘর্ষে হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি নিহতের ভুয়া দাবি প্রচার করা হচ্ছে। এছাড়া, ৫, ৭, ৪০ ও ৫০ এর অধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বীর মৃত্যুর দাবিগুলো কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ ব্যতীত ভিত্তিহীনভাবে প্রচার করা হচ্ছে।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে অনুসন্ধান করলে গত ২০ সেপ্টেম্বর Hill COVER নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে প্রচারিত একটি পোস্ট পাওয়া যায়। দুইটি ছবি সংযুক্ত করে পোস্টটি প্রচার করা হয় এবং দাবি করা হয়, “খাগড়াছড়ির জামতলির ছেলে পানছড়ি সরকারি কলেজের সদ্য এইচএসসি পরীক্ষার্থী জুনান চাকমা সেনাবাহিনীর গুলিতে নিহত হয়েছে।” উক্ত সংযুক্ত দুইটি ছবির মধ্যে একটি ছবির সাথে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ছবিটির হুবহু মিল পাওয়া যায় যা নিশ্চিত করে ছবিটি গতকালে চট্টগ্রামে ঘটা ঘটনার নয়।
উল্লেখ্য যে, খাগড়াছড়ি জেলার দীঘিনালায় পাহাড়ি ও বাঙালির সংঘর্ষের জের ধরে গত ১৯ সেপ্টেম্বর রাতভর জেলা সদরে গোলাগুলির ঘটনা ঘটেছিল। সেখানকার সংঘর্ষের ঘটনায় তিনজন নিহত হয়েছিলেন। আহত হয়েছিলেন অন্তত ১৫ জন। গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, নিহত ব্যক্তিরা হলেন জুনান চাকমা (২০), ধনঞ্জয় চাকমা (৫০) ও রুবেল চাকমা (৩০)। তবে, গণমাধ্যমে জুনান চাকমার নিহত হওয়ার উক্ত ছবি সংযুক্ত করে কোনো সংবাদ প্রতিবেদন পাওয়া যায়নি। তবে, উক্ত ছবিটি জুনান চাকমারই তা গণমাধ্যম সূত্রে নিশ্চিত হওয়া না গেলেও, এটি নিশ্চিত হওয়া গিয়েছে যে প্রচারিত ছবিটি গতকাল চট্টগ্রামে হওয়া বিক্ষোভে নিহত কারোর নয়।
এদিকে গণমাধ্যম সূত্রে জানা যায়, গতকাল (০৫ নভেম্বর) চট্টগ্রামে হওয়া হামলায় পুলিশসহ আহত হয়েছেন ১২ জন। কিছু প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, হামলায় যৌথ বাহিনীর অন্তত ১০ জন সদস্য আহত হয়েছেন। তবে, কোথাও কোনো নিহত হওয়ার কথা উল্লেখ করা হয়নি।
এ বিষয়ে জানতে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (পিআর) কাজী মোঃ তারেক আজিজের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম৷ তিনি জানান, উক্ত ঘটনায় এখন পর্যন্ত কেউ নিহত হননি।
একই বিষয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের চট্টগ্রাম প্রতিনিধি মিন্টু চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করলে তিনিও জানান, “নিহত (এর তথ্য) আমরা পাই নি। আহত সুনির্দিষ্ট এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। চমেকে (চট্টগ্রাম মেডিক্যাল কলেজ) ৫৬ জন চিকিৎসা নিয়েছে।”
আজকের পত্রিকার চট্টগ্রাম প্রতিনিধি সবুর শুভও জানান, উক্ত ঘটনায় নিহতের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
এখন টিভির চট্টগ্রাম প্রতিনিধি হোসাইন আহমেদ জিহাদের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও গতরাতের ঘটনায় নিহতের কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি বলে রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করেন।
স্থানীয় একজন হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তির সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনিও একই তথ্য জানান।
সুতরাং, গত ০৫ নভেম্বর চট্টগ্রামের হাজারী গলিতে হওয়া সংঘর্ষে ১, ৫, ৭, ৪০ ও ৫০ এর অধিক হিন্দু ধর্মাবলম্বী ব্যক্তি নিহতের ভিন্ন ভিন্ন দাবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে প্রচার করা হচ্ছে: যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Prothom Alo – চট্টগ্রামে ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে সংঘর্ষ, ফাঁকা গুলি, সাত পুলিশ সদস্য আহত
- Hill COVER – Facebook Post
- Prothom Alo – খাগড়াছড়িতে রাতভর গোলাগুলি, নিহত ৩
- Channel I – চট্টগ্রামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওপর হামলা, আহত ১২
- Ittefaq – চট্টগ্রামে যৌথ বাহিনীর ওপর হামলা, গ্রেপ্তার ৮০
- Statement of Kazi Md Tarek Aziz, Additional deputy commissioner (PR), Chittagong Metropolitan Police
- Statement of Mintu Chowdhury, Chittagong Correspondent, Bdnews24.com
- Statement of Sobur Shuvo, Ajker Patrika
- Statement of Hossain Ahmed Zihad, Chittagong Correspondent, Ekhon TV
- Statement of Sunny Das, Local Resident
হালনাগাদ/ Update
৭ নভেম্বর, ২০২৪ : এই প্রতিবেদন প্রকাশ পরবর্তী সময়ে একই ঘটনায় মৃত্যুর ভিন্ন ভিন্ন সংখ্যা সম্বলিত পোস্ট ও ফেসবুক ও এক্স পোস্ট আমাদের নজরে আসার প্রেক্ষিতে উক্ত পোস্টগুলো প্রতিবেদনে দাবি হিসেবে যুক্ত করা হলো।