সম্প্রতি “হিজাব বাধ্যতামূলক করা হলো ইরানে!” শীর্ষক শিরোনামের একটি পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
যা দাবি করা হচ্ছে
ফেসবুকে গত ২৬ সেপ্টেম্বর Jannatul Mawa Jannat নামক অ্যাকাউন্ট থেকে “নারীদের আমল ঘর ও দ্বীনি প্রশ্নোত্তর” নামক গ্রুপে প্রকাশিত একটি পোস্টে (আর্কাইভ) দাবি করা হয়, “হিজাব বাধ্যতামূলক করা হলো ইরানে।
একই দাবিতে প্রচারিত এমন কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ইরানে সাম্প্রতিক সময়ে হিজাব বাধ্যতামূলক করার তথ্যটি সঠিক নয় বরং ১৯৭৯ সাল থেকেই দেশটিতে নারীদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক।
কিওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে, ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম BBC এর ওয়েবসাইটে গত ২১ সেপ্টেম্বর Iran unrest: Women burn headscarves at anti-hijab protests শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, “১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের পর, ইরানের কর্তৃপক্ষ একটি বাধ্যতামূলক পোষাক কোড জারি করে যাতে সকল নারীদের মাথায় স্কার্ফ এবং ঢিলেঢালা পোশাক পরতে হয় যা জনসমক্ষে তাদের ছদ্মবেশ ধারণ করে।”
অনুসন্ধানে আমেরিকান সংবাদ সংস্থা AP News এর ওয়েবসাইটে ২৮ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৭৯ সালের ৭ মার্চ প্রধান নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেনি ঘোষণা করেন, সকল নারীকে অবশ্যই হিজাব পরতে হবে।
আন্তর্জাতিক সংবাদ সংস্থা Reuters এর ওয়েবসাইটে ২০১৯ সালের ২৫ জানুয়ারী প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯৭৯ সালের বিপ্লবের পরে আরোপিত ইরানের ইসলামী আইনের অধীনে, মহিলারা তাদের চুল ঢেকে রাখতে এবং লম্বা, ঢিলেঢালা পোশাক পরতে বাধ্য। এই বিধান লঙ্ঘনকারীদের প্রকাশ্যে উপদেশ দেওয়া হয়, জরিমানা করা হয় বা গ্রেপ্তার করা হয়।
বিবিসি বাংলা জানিয়েছে, ডিক্রি জারি করার পরও, নারীর “সঠিক” পোশাক কী হওয়া উচিত সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে কর্তৃপক্ষের বেশ কিছু সময় লেগেছিল। এরপর ১৯৮১ সালে নারী ও কিশোরীদের ইসলামি রীতি অনুযায়ী আব্রু রক্ষা করার উপযোগী পোশাক পরা আইনত বাধ্যতামূলক করা হল। এর অর্থ হল নারীদের চাদর পরতে হবে অর্থাৎ তাদের পা অবধি পুরো শরীর ঢাকা ঢিলা পোশাক পরতে হবে এবং তার সাথে পারলে নিচে ছোট একটা স্কার্ফ পরতে হবে। অথবা পুরোদস্তুর হিজাব এবং তার সাথে লম্বা হাতা ওভারকোট দিয়ে শরীর ঢাকতে হবে।
অর্থাৎ, ইরানে প্রায় চার দশক আগে ১৯৭৯ সালে নারীদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়।
কী ঘটেছিল ১৯৭৯ সালে?
১৯৭৭ সালের আগে তেহরান বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করতেন সে দেশের বহু নারী। সে সময় বহু নারী হিজাব যেমন পরতেন ঠিক তেমনি অনেক নারীকেই দেখা যেত ওয়েস্টার্ন ফ্যাশনে ঝুঁকতে। সেলুনে নিয়মিত নারীদের যাতায়াত ছিল, ছিল পোশাক পরার নিজস্ব স্বাধীনতাও।
কিন্তু এই চিত্র পাল্টাতে শুরু করে ১৯৭৯ সালের শুরুর দিকে, রাজতন্ত্র-বিরোধী বিপ্লবের সময় থেকে। পহলভি রাজবংশের শাসক শাহ মহম্মদ রেজা পহলভিকে সরিয়ে আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনির নেতৃত্বে সে বছর ক্ষমতায় আসে ইসলামিক রিপাবলিক সরকার। রাজপরিবারের উৎখাতের সঙ্গে সঙ্গেই পাল্টে যায় ইরানের সামাজিক পরিস্থিতি এবং রীতিনীতি। ইরান থেকে রাজপরিবারকে উৎখাত করার এই বিপ্লবকে সমর্থন জুগিয়েছিল বিভিন্ন বামপন্থী ও ইসলামপন্থী সংগঠনও। ইতিহাসের পাতায় এই ঘটনা ইরানি বিপ্লব বা ইসলামিক বিপ্লব নামে পরিচিত। ক্ষমতায় আসার পরই ইরানের সে সময়কার সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ রুহুল্লাহ খোমেইনি ১৯৭৯ সালের ৭ই মার্চ ডিক্রি বা নির্দেশনামা জারি করেন যে, সব নারীকে তাদের কর্মক্ষেত্রে বাধ্যতামূলকভাবে হিজাব পরতে হবে এবং নারীরা মাথা না ঢাকলে তার বিচারে সেইসব নারী ”নগ্ন” বলে গণ্য হবেন।
১৯৮৩ সালে প্রণীত একটি নতুন আইনে ইরানে হিজাব না পরার শাস্তি হিসেবে ৭৪ বেত্রাঘাতের নীতি ধার্য করা হয়। ১৯৯৫ সালে অনাবৃত মহিলাদের শাস্তি হিসেবে ৬০ দিন কারাবাসের বিধান জারি হয়।
সম্প্রতি হিজাব আইন নিয়ে আলোচনা কেন?
১৯৭৯ সালে হিজাব পরার বাধ্যবাধকতা জারির পরদিন অর্থাৎ ৮ মার্চ রাজধানী তেহরানের রাস্তায় হিজাব বিরোধী বিক্ষোভে শামিল হতে দেখা যায় শিক্ষার্থী, ডাক্তার, আইনজীবীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষদের। এরপর থেকে অনেকবারই হিজাব বিরোধী বিক্ষোভ দেখেছে ইরান।
গত ১৫ই আগস্ট ইরানের বর্তমান প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসি কর্তৃক স্বাক্ষরিত একটি নির্দেশে বলা হয়, নারীরা কী ধরনের পোশাক পরে প্রকাশ্যে বেরুচ্ছে তা পর্যবেক্ষণের জন্য ক্যামেরা বসানো হবে। আইন লংঘনকারী এসব নারীকে হয় জরিমানা করা হবে, নয়ত তাদের “কাউন্সেলিং”এর জন্য পরামর্শ দেওয়া হবে। আর কোন ইরানি নারী অনলাইনে হিজাব পরা সম্পর্কে কোনরকম প্রশ্ন তুললে বা হিজাবের বিরুদ্ধে কোন কন্টেন্ট পোস্ট করলে তাকে বাধ্যতামূলকভাবে কারাদণ্ড দেয়া হবে।
অতি সম্প্রতি ইরানে হিজাব আইন নিয়ে আবার আলোচনা শুরুর প্রেক্ষাপট এক তরুণীর মৃত্যু। ২২ বছর বয়সী ইরানি তরুণী মাশা আমিনিকে গত ১৩ই সেপ্টেম্বর আটক করে সে দেশের মোরাল পুলিশ। যখন আমিনিকে গ্রেপ্তার করে, তখন হিজাবের তলা দিয়ে তার কিছু চুল দেখা যাচ্ছিল বলে অভিযোগ করা হয়। একটি আটক কেন্দ্রে তাকে নিয়ে যাবার অল্পক্ষণ পরই আমিনি অজ্ঞান হয়ে যান এবং কোমায় চলে যান। তিন দিন পর তিনি হাসপাতালে মারা যান। এরপরই দেশটিতে পুনরায় হিজাব ইস্যুটি আলোচনায় আসে। মাশা আমিনির মৃত্যুর পরের দিনগুলোতে নারীদের দেশটির বিভিন্ন স্থানে পথে নেমে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে।
মূলত, ১৯৭৯ সালে ইরানে ইসলামী বিপ্লবের পর নারীদের হিজাব পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। সে সময় থেকে হিজাব আইনের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে বিক্ষোভ করেছেন ইরানি নারীরা। গত মাসে হিজাব পরা নিয়ে ফের কঠোর হওয়ার কথা জানায় ইরান সরকার। সম্প্রতি হিজাব ঠিকভাবে না পরার অভিযোগে মোরাল পুলিশের হাতে আটক এক তরুণীর মৃত্যুর পর হিজাব আইন নিয়ে নতুন করে বিক্ষোভ ও আলোচনা শুরু হয়। এর প্রেক্ষিতে ইরানে হিজাব বাধ্যতামূলক করা হয়েছে দাবিতে ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে অথচ দেশটিতে চার দশক আগে থেকেই হিজাব বাধ্যতামূলক।
উল্লেখ্য, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্ক সফররত ইরানের প্রেসিডেন্ট ইব্রাহিম রাইসির সাক্ষাৎকার নেওয়ার কথা ছিল সিএনএনের সাংবাদিক ক্রিস্টিন আমানপোরের। রাইসির শর্ত ছিল, সাক্ষাৎকারের সময় আমানপোরকে হিজাব পরতে হবে। কিন্ত তাতে আপত্তি জানান আমানপোর। এরপর সাক্ষাৎকারটি বাতিল হয়ে যায়।
প্রসঙ্গত, মোরাল পুলিশের হেফাজতে মাহসা আমিনির মৃত্যুর জের ধরে ইরানে হিজাব বিরোধী আন্দোলনে এ পর্যন্ত ৭৬ জনের (২৮ সেপ্টেম্বর) মৃত্যু হয়েছে।
সুতরাং, ইরানে সাম্প্রতিক সময়ে হিজাব বাধ্যতামূলক করার দাবিটি বিভ্রান্তিকর।