হাফেজ সালেহ আহমেদ তাকরিম, আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কুরআন প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সফলতার সঙ্গে সাম্প্রতিক সময়ে যার নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িত। সম্প্রতি বিশ্বের ৬৫টি দেশের ৭০ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ২৬ তম দুবাই আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়েছেন তিনি।
তার এই অর্জনের পর বাংলাদেশের সোশ্যাল মিডিয়া বিশেষ করে ইউটিউবে তাকে নিয়ে চটকদার থাম্বনেইলযুক্ত বিভিন্ন আধেয় প্রচার হতে থাকে।
ইউটিউবে প্রচারিত এমন কিছু আধেয় দেখুন
- বিশ্ব জয় করায় তাকরিমকে কোটি টাকার বাড়ি উপহার দিয়ে একি ঘোষণা দিলো প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা (আর্কাইভ)
- ৩০ কোটি টাকার বাড়ি পেল তাকরিম, লন্ডন থেকে দিলেন তারেক রহমান (আর্কাইভ)
রিউমর স্ক্যানার টিম এই প্রতিবেদনে তাকরিমকে ঘিরে বিশ্ব নেতৃত্ব ও বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নিয়ে তৈরী করা ইউটিউবের এসব আধেয়ের স্বরূপ উন্মোচন করেছে।
ভিউ বাড়ানোর উপায় ‘চটকদার থাম্বনেইল’!
আধেয়গুলোর স্বরূপ উন্মোচন করতে গিয়ে দেখা যায়, প্রতিটি আধেয়তেই ব্যবহার করা হয়েছে চটকদার থাম্বনেইল। অধিকাংশ থাম্বনেইলগুলো তৈরি করা হয়েছে আধেয়ের ভিতরে প্রদত্ত তথ্যানুযায়ী।
তবে কিছু কিছু থাম্বনেইলের সঙ্গে আবার মূল আধেয়ের কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। যেমন, Atv news bangla 1 নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে তাকরিমকে নিয়ে একটি আধেয়ের থাম্বনেইলের শিরোনাম ছিল ‘তাকরিমকে বিশ্বের সবচেয়ে দামি গাড়ি উপহার দেওয়ার ঘোষণা জো বাইডেনের।’
আধেয়টির থাম্বনেইলে এমন শিরোনাম ব্যবহার করলেও বিশ্লেষণে দেখা যায়, একই আধেয়ের মূল শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে ‘হাফেজ তাকরিমকে কোটি টাকার পুরস্কারের ঘোষণা। খুশিতে যা বললেন হাফেজ তাকরিম‘ শীর্ষক ভিন্ন তথ্য।
আবার কিছু কিছু থাম্বনেইল বিশ্লেষণে দেখা যায়, থাম্বনেইলে এমন কিছু উপকরণ ব্যবহার করা হয়েছে, যার সঙ্গে মূল আধেয়ের কোনো সম্পর্ক নেই।
যেমন, ‘বিশ্বজয়ী হাফেজ তাকরিমের বাড়িতে গিয়ে ১০ লক্ষ টাকা উপহার দিলেন ডিপজল‘ শীর্ষক আধেয়ের থাম্বনেইল বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই আধেয়টি ডিপজল কেন্দ্রিক নির্মিত হলেও এখানে চিত্রনায়ক শাকিব খান, ইসলামী বক্তা মিজানুর রহমান আজহারীর উপস্থিতি পাওয়া যায়।
একইভাবে আরেকটি আধেয় ‘বিশ্বজয়ী হাফেজ তাকরিমের বাড়িতে গিয়ে ২০ লাখ টাকার উপহার দিলেন হিরো আলম‘ এর থাম্বনেইল বিশ্লেষণে দেখা যায়, সেখানেও ইসলামী বক্তা মিজানুর রহমান আজহারীর পাশাপাশি ডিপজলের উপস্থিতি রয়েছে।
এভাবে থাম্বনেইলে ছবির ব্যবহার দর্শক মনে কৌতূহল বা বিভ্রান্তি তৈরি করতে পারে যে, আধেয়টির সাথে হয়তো উক্ত ব্যক্তিদেরও সংশ্লিষ্টতা রয়েছে। যা একইসাথে দর্শককে আধেয়টি দেখতে প্রলুব্ধ করবে।
সাধারণত যেকোনো ভিডিও আধেয়ের দর্শকেরা প্রথমেই সেই আধেয়ের থাম্বনেইল ও শিরোনামটি দেখে। এর মাধ্যমে তারা ভিডিও আধেয়টি সম্পর্কে ধারণা নেয় এবং সেটি দেখার ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেয়।
ইউটিউবের সাপোর্ট সেন্টারের পরিসংখ্যান বলছে, ইউটিউবের ৯০ শতাংশ সফল ভিডিওয়ের কাস্টমাইজড বা নিজস্ব থাম্বনেইল ছিল।
অর্থাৎ, দর্শককে নিজের ভিডিও আধেয়ের দিকে টানার অন্যতম আকর্ষণীয় এক উপায় হলো কাস্টমাইজড থাম্বনেইল।
তবে এসব থাম্বনেইল তৈরি করতে গিয়ে সেখানে যদি এমন কোনো বিষয়ের উপস্থাপন থাকে যা মূল ভিডিওতে নেই, সেসব থাম্বনেইলকে ইউটিউব কর্তৃপক্ষ বিভ্রান্তিকর থাম্বনেইল হিসেবে আখ্যা দিয়ে এ ধরনের থাম্বনেইল ব্যবহার থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়েছে। যদিও এসব থাম্বনেইলের অহরহ ব্যবহার ইউটিউবে ঢুকলেই দর্শকমাত্র চোখে পড়বে।
তবে এমন থাম্বনেইলের ব্যবহার বিশেষভাবে দেখা যায় খেলাধুলা, রাজনীতি ও বিনোদনের ক্ষেত্রে। এসব থাম্বনেইলগুলো মাঝেমধ্যে এমনভাবে তৈরি করা হয় যে, দর্শক রীতিমতো বাকরুদ্ধ পর্যন্ত হয়ে পড়েন।
যদিও অধিকাংশ দর্শকেই জানেন যে, এই ধরনের থাম্বনেইলগুলো ভুয়া, তবুও তারা কেবল থাম্বনেইলের কারণে ভিডিও আধেয়গুলো দেখে থাকেন।
অর্থাৎ থাম্বনেইলগুলো খুবই নিম্নমানের ও ভুয়া হলেও ইউটিউবের দর্শক টানতে এরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। এই বিষয়টি উপরিউক্ত হাফেজ তাকরিমকে নিয়ে নির্মিত ভিডিও আধেয়গুলোর ভিউ সংখ্যা বিশ্লেষণ করলেও প্রতীয়মান হয়। যা এই প্রতিবেদনের পরের অংশের আলোচনায় থাকবে।
সূত্রহীন বক্তব্য
হাফেজ তাকরিমকে নিয়ে নির্মিত ভিডিও আধেয়গুলো বিশ্লেষণের এই পর্যায়ে রিউমর স্ক্যানার টিম তাকে নিয়ে প্রচারিত ভিডিওগুলোতে যেসব অভিনেতা-অভিনেত্রী কিংবা বিশ্ব নেতৃবৃন্দের বক্তব্য ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো বিশ্লেষণ করে।
বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভিডিওগুলোতে প্রদত্ত তথ্যগুলোর কোনো তথ্যসূত্র নেই। অর্থাৎ অভিনেতা-অভিনেত্রীরা বা রাজনৈতিক নেতৃবর্গ কখন, কোথায় তাকরিমকে নিয়ে এসব মন্তব্য করেছে সেসব সম্পর্কে কোনো তথ্য ভিডিওগুলোতে পাওয়া যায় না। বরং দেখা যায়, ভিডিওগুলোতে ভয়েজ ওভারে (নেপথ্য কণ্ঠ) তথ্যগুলো কেবল উপস্থাপন করে যাওয়া হয়েছে।
এছাড়া বিভিন্ন চ্যানেলে বিভিন্ন ব্যক্তির নামে প্রচারিত বক্তব্যগুলোর মধ্যে সাদৃশ্যও খুঁজে পাওয়া যায়।
যেমন, তাকরিমকে নিয়ে 24 News BD নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ‘বিশ্বজয়ী হাফেজ তাকরিমের বাড়িতে গিয়ে ১০ লক্ষ টাকা উপহার দিলেন ডিপজল‘ শীর্ষক একটি ভিডিওতে অভিনেতা ডিপজলের নামে প্রচারিত বক্তব্যটি হলো, ‘হাফেজ সালেহ আহমেদ তাকরিম আবারও বাংলাদেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে। আরও একটি বিশ্বজয় নিয়ে এসেছে সালেহ আহমেদ তাকরিম। আমি হাফেজ আহমেদ তাকরিমের কুরআন তেলাওয়াত অনেকবার শুনেছি। আমি তাকরিমের তেলাওয়াত শুনে সত্যিই মুগ্ধ হয়েছি। এই বিষয়ে এত সুন্দর কুরআন তেলাওয়াত করে হাফেজ তাকরিম। সত্যিই অবাক করার মতো। আমি ইতোমধ্যে শুনেছি, দুবাইয়ে কুরআন প্রতিযোগিতায় তাকরিম প্রথম স্থান অধিকার করেছে। আমি অনেক খুশি হয়েছি এবং সবসময় তার পাশে আছি।’
ডিপজল আরও বলেন, আমি শুনেছি হাফেজ তাকরিমের পারিবারিক অবস্থা ভালো না। অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছে। আমার পক্ষ থেকে তাকরিমের জন্য ১০ লক্ষ টাকা উপহার হিসেবে দিব এবং এই টাকা তাকরিম তার পরিবারের জন্য ব্যয় করবে। তাকরিমের আরও টাকা লাগলে ভবিষ্যতে আমি তাকে সাহায্য করবো ইনশাআল্লাহ।’
আবার Popular News BD নামের আরেকটি ইউটিউব চ্যানেলে তাকরিমকে বাড়িতে গিয়ে কন্টেন্ট নির্মাতা হিরো আলমের ২০ লাখ টাকার উপহার দেওয়ার দাবিতে ‘বিশ্বজয়ী হাফেজ তাকরিমের বাড়িতে গিয়ে ২০ লাখ টাকার উপহার দিলেন হিরো আলম‘ শীর্ষক ভিডিওতে হিরো আলমের যে বক্তব্যটি তার সঙ্গে ডিপজলের বক্তব্যের হুবহু সাদৃশ্য বিদ্যমান।
একইভাবে সাদৃশ্য পাওয়া যায় তাকরিমকে নিয়ে বলিউড অভিনেতা সালমান খান ও শাহরুখ খানের বক্তব্যেও।
অর্থাৎ, রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় যে, ইউটিউব চ্যানেলগুলো কেবল অভিনেতা-অভিনেত্রীদের নাম এবং তাদের দাবিতে প্রচারিত বক্তব্যগুলোর সামান্য পরিবর্তন করে কোনো ধরনের তথ্যসূত্র উল্লেখ ছাড়াই প্রচার করছে।
উল্লেখ্য, ইতোপূর্বে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে সম্প্রতি হাফেজ সালেহ আহমেদ তাকরিমকে অভিনেতা ডিপজলের পক্ষ থেকে কোটি টাকার বাস উপহার দেওয়ার দাবিতে একাধিক ভিডিও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে সেটি মিথ্যা হিসেবে প্রমাণিত হয়।
এ নিয়ে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধান পড়ুন: অভিনেতা ডিপজল হাফেজ তাকরিমকে বাস উপহার দেননি
ভিউ প্রাপ্তির সফল সমীকরণ
হাফেজ তাকরিমের সাম্প্রতিক সফলতা নিয়ে তৈরী উপরিউক্ত ১১ টি ভিডিও আধেয়ের দর্শক সংখ্যা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ভিডিওগুলোর গড় দর্শক সংখ্যা ৭ লাখ ৮৪ হাজার ৯ শত জন।
দর্শক সংখ্যা বিবেচনায় এই আধেয়গুলোর মধ্যে শীর্ষ তিনে আছে
- বিশ্বজয়ী হাফেজ তাকরিমকে নিয়ে খুশি হয়ে একি বললেন তুরস্কের প্রেসিডেন্ট তাইয়েপ এরদোয়ান, ( ভিউ সংখ্যা: ৩ লাখ ৪১ হাজার)।
- ৩০ কোটি টাকার বাড়ি পেল তাকরিম, লন্ডন থেকে দিলেন তারেক রহমান, (ভিউ সংখ্যা: ১ লাখ ৫১ হাজার দর্শক)।
- হাফেজ তাকরিমকে কত টাকা দিলেন নায়ক জিৎ? জানলে অবাক হবেন আপনিও (ভিউ সংখ্যা: ১ লাখ ১৩ হাজার দর্শক)।
এর মধ্যে প্রথম ও তৃতীয় স্থানে থাকা ভিডিও দুইটি আবার Most Topic নামে একই ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রচারিত।
এই চ্যানেলটি দুইটি ভিডিও থেকে গড়ে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ দর্শক পেলেও চ্যানেলটির সাবস্ক্রিপশন বা গ্রাহক সংখ্যা মাত্র সাড়ে ২২ হাজার।
অর্থাৎ চ্যানেলটি এই গ্রাহক সংখ্যা নিয়েই কিছু চটকদার থাম্বনেইল ও সূত্রহীন ভুয়া বক্তব্য দিয়ে মাত্র দুইটি ভিডিও আধেয় তৈরি করে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ দর্শকের কাছে পৌঁছে যেতে পেরেছে।
অপরদিকে হাফেজ তাকরিমের সাম্প্রতিক সফলতা নিয়ে তৈরী উপরিউক্ত ১১ টি ভিডিও আধেয় নেওয়া হয়েছে ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল থেকে।
ওপেন সোর্সে পাওয়া একাধিক টুল ব্যবহার করে দেখা যায়, এই ছয়টি চ্যানেলের প্রতিটিতেই মানিটাইজেশন বা বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে আয়ের সুযোগ চালু রয়েছে। ফলে ভিউ প্রাপ্তি এবং এর মাধ্যমে আয়ের সুযোগ থাকায় এই চ্যানেলগুলো থেকে এমন চটকদার থাম্বনেইল ও সূত্রহীন ভুয়া বক্তব্য দিয়ে ভিডিও তৈরির বিষয়টিও স্বাভাবিক বলেই প্রতীয়মান হয়।
মূলত, সম্প্রতি বিশ্বের ৬৫টি দেশের ৭০ জন প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে ২৬ তম দুবাই আন্তর্জাতিক কুরআন তিলাওয়াত প্রতিযোগিতায় প্রথম হন বাংলাদেশি হাফেজ সালেহ আহমেদ তাকরিম। তার এই অর্জনের পর দেশীয় বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেলে চটকদার থাম্বনেইল ও বিশ্ব নেতৃত্ব ও বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীর নামে বক্তব্য ব্যবহার করে তাদের পক্ষ থেকে তাকরিমকে বিভিন্ন উপহার দেওয়ার দাবি প্রচার করা হয়। তবে রিউমর স্ক্যানারের বিশ্লেষণে দেখা যায়, চটকদার থাম্বনেইলের আড়ালে বিশ্ব নেতৃত্ব ও বিভিন্ন অভিনেতা-অভিনেত্রীর নামে প্রচারিত এসব বক্তব্যগুলোর কোনো তথ্যসূত্র নেই। অর্থাৎ এ বক্তব্যগুলো পুরোপুরি ভিত্তিহীন। প্রকৃতপক্ষে ইউটিউব চ্যানেলগুলো তাদের আধেয়ের ভিউ বাড়াতে এসব থাম্বনেইলের আড়ালে ভিত্তিহীন উক্ত বক্তব্যগুলো প্রচার করে আসছে।
সুতরাং, ইউটিউবে ভিউয়ের মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের আশায় সাম্প্রতিক সময়ে দুবাইয়ে কুরআন তেলাওয়াত প্রতিযোগিতায় হাফেজ তাকরিমের অর্জনকে ঘিরে বিশ্ব নেতৃত্ব ও বিভিন্ন সেলিব্রিটি কর্তৃক তাকে পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে শীর্ষক চটকদার শিরোনাম এবং বিকৃত থাম্বনেইল ব্যবহার করে প্রচার করা হচ্ছে; যেগুলো সম্পূর্ণ বানোয়াট ও মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- YouTube Help(1): Thumbnail and title tips
- YouTube Help(2): Thumbnails policy
- The Financial Express: YouTube thumbnails: Fake and cringe-worthy, not funny anymore
- Rumor Scanner Own Investigation.