ইসরায়েলে তালেবানের সৈন্য পাঠানো সংক্রান্ত ভুয়া দাবি ইন্টারনেটে  

সম্প্রতি, চলমান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সংঘাত ইস্যুতে ইসরায়েলে সৈন্য পাঠাতে প্রস্তুত আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালেবান শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়তে দেখা যায়।  

সৈন্য পাঠানো

উক্ত দাবিতে গণমাধ্যমের ফেসবুক পোস্ট দেখুন ফেস দ্য পিপল। 

একই দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক 

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আফগানিস্তান ইসরায়েলে সৈন্য পাঠাতে প্রস্তুত জানিয়ে তালেবান কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি বরং ভুয়া একটি ভেরিফাইড এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে উক্ত তথ্যটি ছড়িয়ে পড়ার পর বিষয়টিকে ভুয়া বলে নিশ্চিত করেছে তালেবান। 

ফেক ভেরিফাইড এক্স অ্যাকাউন্ট দাবিটির উৎস?

এ বিষয়ে অনুসন্ধানের শুরুতে কিওয়ার্ড সার্চ করে জাতীয় দৈনিক ইনকিলাব পত্রিকার ওয়েবসাইটে গত ০৮ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে উক্ত বিষয়ে একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

প্রতিবেদনে দাবি করা হয়, ইসরাইলকৃত অবরুদ্ধ পবিত্র জেরুজালেম শহরকে দখলমুক্ত করতে ইসরায়েলে সৈন্য পাঠাতে চায় আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালেবান। এ জন্য ইরান, ইরাক ও জর্ডানের কাছে অনুমতি চেয়েছে। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম এক্সপ্রেস শনিবার (৭ অক্টোবর) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে। 

তবে ইনকিলাব জানিয়েছে, তালেবান আসলেই এই তিন দেশের কাছে সৈন্য পাঠানোর জন্য তাদের ভূখণ্ড ব্যবহারের কোনও অনুরোধ জানিয়েছে কি না সেটির সত্যতা যাচাই করা যায়নি।

Screenshot: Inqilab 

এই প্রতিবেদনের সূত্রে পরবর্তীতে এক্সপ্রেস এর ওয়েবসাইটে আলোচিত প্রতিবেদনটি খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদনেও ইনকিলাবের তথ্যগুলোই পাওয়া যাচ্ছে। অর্থাৎ, এক্সপ্রেস নিশ্চিত হতে পারেনি এ বিষয়ে। 

Screenshot: Express

এই বিষয়ে নির্ভরযোগ্য কোনো গণমাধ্যমে সংবাদ না পেয়ে আফগানিস্তান বা তালেবান সূত্র খোঁজ করতে গিয়ে এক্স-এ (সাবেক টুইটার) ‘Taliban Public Relations Department, Commentary’ নামক একটি ভেরিফাইড অ্যাকাউন্টে গত ০৭ অক্টোবর প্রকাশিত একটি টুইটে কিছু তথ্য দেখতে পেয়েছি আমরা। 

টুইটে দাবি করা হয়, সেদিন সন্ধ্যায় (০৭ অক্টোবর) পররাষ্ট্র দপ্তর ইরান, ইরাক এবং জর্ডানে তার সমকক্ষদের সাথে যোগাযোগ করেছে, তাদের পুরুষদের পবিত্র ভূমিতে যাওয়ার পথে তাদের সার্বভৌম ভূখণ্ড অতিক্রম করার অনুমতি চেয়েছে। 

টুইট থেকে পাওয়া তথ্যমতে, তালেবান তাদের প্রতিবেশীদের কাছ থেকে সুসংবাদের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে এবং আশা করছে তারা সেই সুসংবাদ পাবে।

Screenshot: X

পরদিন, অর্থাৎ ০৮ অক্টোবর সকালে একই অ্যাকাউন্ট থেকে করা আরেক টুইটে দাবি করা হয়, ইরানের সাথে তালেবান একটি ঐক্যমত্যে পৌঁছেছে। তবে তালেবানের প্রস্তাবে ইরাক সাড়া দেয়নি, এবং জর্ডান তালেবানদের তাদের দেশে প্রবেশে বাধা দেয় বলে দাবি করা হয় একই টুইটে। 

Screenshot: X

রিউমর স্ক্যানার টিম বিষয়টি নিয়ে আরো অনুসন্ধান করতে গিয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম Forbes এর ওয়েবসাইটে গত ০৭ অক্টোবর প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানতে পারে, আলোচিত এক্স অ্যাকাউন্টটি তালেবান কর্তৃক নিয়ন্ত্রণ করা হয় শীর্ষক কোনো প্রমাণ মেলেনি। 

Screenshot: Forbes

একইদিন ভারতীয় সংবাদমাধ্যম WIO News এর ব্যুরো চিফ আনাস মল্লিক টুইট করে জানান, বিষয়টি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

Screenshot: X

পরবর্তীতে গত ০৯ অক্টোবর রিউমর স্ক্যানার টিমের নজরে আসে, আলোচিত এক্স অ্যাকাউন্টটির নাম বদলে #FreePalestine রাখা হয়েছে। তখনও অ্যাকাউন্টের নামের পাশে ভেরিফাইডের ব্লু টিক দেখা যাচ্ছিল। সেসময় এ বিষয়টি জানিয়ে একটি টুইটও করা হয় অ্যাকাউন্টটি থেকে। 

Screenshot: X

তবে এই প্রতিবেদন প্রকাশের সময় অ্যাকাউন্টটি পূর্বের নামেই (Taliban Public Relations Department, Commentary) ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। কিন্তু এখন আর অ্যাকাউন্টটিতে ভেরিফাইড ব্লু টিক দেখা যাচ্ছে না৷ 

রিউমর স্ক্যানার টিমের কাছে প্রতীয়মান হয়েছে, আলোচিত এক্স অ্যাকাউন্টটির সাথে তালেবান সরকারের সংশ্লিষ্টতা নেই। অ্যাকাউন্টটি ফেক ভেরিফাইড হয়ে পরিচালিত হচ্ছিল।

তালেবান সরকারের অবস্থান কী? 

আলোচিত এক্স অ্যাকাউন্টটির টুইটটির বিষয়ে মার্কিন সংবাদমাধ্যম Voice of America এর ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক  প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, তালেবানের কাতারের দোহায় অবস্থিত রাজনৈতিক কার্যালয়ের প্রধান মোহাম্মদ সুহাইল শাহিন সাংবাদিকদের বলেছেন, আলোচিত তথ্যটি সত্য নয়। 

ভয়েস অফ আমেরিকা এ বিষয়ে জানতে তালেবান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদের সাথে কথা বলেছে। তিনি জানিয়েছেন, তালেবানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। এটাই তালেবানের অবস্থান।  

Screenshot: VoA

আলোচিত বিবৃতিটি গত ০৭ অক্টোবর আফগানিস্তানের পররাষ্ট্র  মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়।

বিবৃতিতে বলা হচ্ছে, গাজা উপত্যকায় চলমান ঘটনার প্রতি কড়া নজর রেখেছে আফগানিস্তানের ইসলামী আমিরাত । এ ধরনের ঘটনার কারণ হচ্ছে ইহুদিবাদী ইসরায়েলিদের দ্বারা নিপীড়িত ফিলিস্তিনি জনগণের অধিকার লঙ্ঘন এবং পবিত্র স্থানগুলোর ঘন ঘন অবমাননা, যা অমর্যাদাপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত। ইসলামী আমিরাত ফিলিস্তিনি জনগণের স্বাধীনতা এবং তাদের আশ্রয়স্থলের প্রতিরক্ষা ও প্রতিরোধকে তাদের বৈধ অধিকার বলে মনে করে। আফগানিস্তানের ইসলামী আমিরাত ফিলিস্তিনের ঐতিহাসিক ভূমিতে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের বৈধ, ঐতিহাসিক ও আইনি অধিকারের প্রতি সমর্থন ঘোষণা করে। আফগানিস্তানের ইসলামী আমিরাত ইসলামী দেশসমূহ, অর্গানাইজেশন অব ইসলামিক কো-অপারেশন, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় এবং বিশেষ করে এই অঞ্চলে প্রভাব বিস্তারকারী দেশসমূহকে ইসরায়েলি দখলদার বাহিনীর দ্বারা নিরীহ ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সহিংসতা বন্ধ করতে এবং ফিলিস্তিন সমস্যা সমাধানের জন্য অনুরোধ জানাচ্ছে। সমাধানের জন্য  হস্তক্ষেপ প্রয়োজন যাতে ফিলিস্তিনিরা তাদের ন্যায্য অধিকার পায়।

Screenshot: Ministry of Foreign Affairs of Afghanistan

তবে এই বিবৃতি এবং পরবর্তীতে প্রকাশিত অন্যান্য বিবৃতিতেও ‘ইসরায়েলে সৈন্য পাঠাতে প্রস্তুত আফগানিস্তান’ শীর্ষক কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

মূলত, চলমান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সংঘাত ইস্যুর মধ্যেই ইসরায়েলে সৈন্য পাঠাতে প্রস্তুত আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালেবান শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, উক্ত দাবিটি সঠিক নয়৷ তালেবান এমন কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি। প্রকৃতপক্ষে, একটি ভুয়া ভেরিফাইড এক্স অ্যাকাউন্টের মাধ্যমে উক্ত দাবিটি ছড়িয়ে পড়েছে। তবে তালেবানের পক্ষ থেকে এমন তথ্যকে ভুয়া বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে।   

প্রসঙ্গত, চলমান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সংঘাত ইস্যুতে একাধিক ভুল তথ্য ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে ইতোমধ্যে একাধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার৷ 

সুতরাং, চলমান ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের সংঘাত ইস্যুতে ইসরায়েলে সৈন্য পাঠাতে প্রস্তুত আফগানিস্তানের ক্ষমতাসীন গোষ্ঠী তালেবান শীর্ষক একটি দাবি ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।  

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img