সম্প্রতি, ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্টে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষাক্রম নিয়ে সুনির্দিষ্ট তিনটি দাবি ছড়িয়ে পড়তে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার টিম।
দাবি ১
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সিলেবাসে যে বইগুলো প্রণীত হয়েছে তার দায়িত্বে ছিলেন ড. মুহম্মদ ইকবাল।
দাবি ২
উক্ত দুই ক্লাসের বই জঘন্য হওয়ার কারণে স্কুলের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে।
দাবি ৩
এখন পর্যন্ত এই দুই ক্লাসের জন্য পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি।
উক্ত দাবিগুলোতে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন সিলেবাসে প্রণীত বইগুলোর দায়িত্বে ছিলেন ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল, বই খারাপ হওয়ার কারণে স্কুলের পরীক্ষা বাতিল এবং এখন পর্যন্ত এই দুই ক্লাসের জন্য পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি শীর্ষক দাবিগুলো সঠিক নয় বরং জাফর ইকবাল সিলেবাস প্রণয়ন কমিটি এবং বিজ্ঞান সম্পর্কিত বইগুলো লেখা কমিটির একজন সদস্য ছিলেন৷ বই খারাপ হওয়ার কারণে নয়, পরীক্ষা বাতিলের বিষয়ে ২০২১ সাল থেকেই আলোচনা শুরু হয়েছে এবং এ বছর বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছে। পরীক্ষার পরিবর্তে চলা সামষ্টিক মূল্যায়ন গতকাল শেষ হয়েছে।
প্রথম দাবির বিষয়ে অনুসন্ধান
ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সিলেবাসে যে বইগুলো প্রণীত হয়েছে তার দায়িত্বে ছিলেন ড. মুহম্মদ ইকবাল ছিলেন কিনা সে বিষয়ে অনুসন্ধানে ষষ্ঠ বইগুলো বিশ্লেষণ করে শুধু ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ে অন্যান্য রচনাকারীদের সাথে এবং এবং ‘বিজ্ঞান অনুশীলন’ বইয়ের অন্যান্য সম্পাদনাকারীদের সাথে ড. মুহম্মদ ইকবালের নাম খুঁজে পাওয়া যায়। একইভাবে ৭ম শ্রেণির বইগুলো বিশ্লেষণ করে শুধু ‘বিজ্ঞান অনুসন্ধানী পাঠ’ বইয়ে অন্যান্য রচনাকারীদের সাথে এবং ‘বিজ্ঞান অনুশীলন’ বইয়ের অন্যান্য সম্পাদনাকারীদের সাথে ড. মুহম্মদ ইকবালের নাম খুঁজে পাওয়া যায়।
পরবর্তীতে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির সিলেবাস প্রণয়নের দায়িত্বে ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল ছিলেন কিনা এ বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবালের সাথে যোগাযোগ করলে তিনি আমাদের জানান, “আমি কমিটির অন্যান্য সদস্যদের সাথে শুধু পদার্থ বিষয়ক সিলেবাস প্রণয়নে যুক্ত ছিলাম।”
অনুসন্ধানে জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) ওয়েবসাইটে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১ এর পিডিএফ সংস্করণ খুঁজে পাওয়া যায়।
উক্ত রূপরেখায় ২০১৯ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুমোদিত জাতীয় শিক্ষাক্রম উন্নয়ন ও পরিমার্জন কোর কমিটির সদস্যদের একটি তালিকা রয়েছে যেখানে সদস্য হিসেবে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবালের নাম রয়েছে। কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে উল্লেখ রয়েছে এনসিটিবির সে সময়ের (২০১৯) চেয়ারম্যান প্রফেসর নারায়ণ চন্দ্র সাহার নাম।

অর্থাৎ, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইগুলো রচনার দায়িত্বে নয়, দুইটি বইয়ের রচনা ও সম্পাদনা দলের একজন সদস্য ছিলেন ড. মুহম্মদ ইকবাল। তাছাড়া, উক্ত শ্রেণিগুলোর সিলেবাস প্রণয়নের দায়িত্বে নয়, কমিটির সদস্য হিসেবে কাজ করেছেন তিনি।
দ্বিতীয় দাবির বিষয়ে অনুসন্ধান
বই খারাপ হওয়ার কারণে স্কুলের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে কিনা এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ২০২১ সালের ১৩ সেপ্টেম্বর অনলাইন সংবাদমাধ্যম ‘বাংলা ট্রিবিউন’ এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সেদিন, (১৩ সেপ্টেম্বর) প্রধানমন্ত্রীর কাছে জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা উপস্থাপনের পর সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির কিছু বিষয়ে শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে ৬০ শতাংশ এবং বাকি ৪০ শতাংশ আসবে সামষ্টিক মূল্যায়ন (বছর শেষে পরীক্ষা) থেকে। বাকি বিষয়গুলো পুরোপুরি শিখনকালীন মূল্যায়ন হবে৷

এ বিষয়ে আরও অনুসন্ধান করে, চলতি বছরের ০৬ জানুয়ারি জাতীয় দৈনিক যুগান্তরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শিক্ষা ব্যবস্থাকে মুখস্থ বিদ্যা আর পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন থেকে বের করে আনতে জানুয়ারি থেকে প্রথম, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে নতুন শিক্ষাক্রম চালু করা হচ্ছে। ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে প্রথাগত পরীক্ষা থাকছে না। সারা বছর ধরে ধারাবাহিকভাবে শিখন কার্যক্রমের মূল্যায়ন করা হবে। কোনো সামস্টিক বা অর্ধবার্ষিক ও বার্ষিক পরীক্ষা নেওয়া হবে না।

পরবর্তীতে গত ১৪ মার্চ জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকার ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের শুরু থেকে নতুন কারিকুলামে পাঠদান চলা ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণি শিক্ষার্থীদের মূল্যায়নে কোনোও প্রচলিত পরীক্ষা বা মডেল টেস্ট নেওয়া যাবে না বলে জানিয়েছে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর মাউশি। ১৩ মার্চ মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর থেকে এক আদেশে এ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

অর্থাৎ, বই খারাপ হওয়ার কারণে স্কুলের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয়৷ ২০২১ সাল থেকে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পরীক্ষা কমিয়ে আনার বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় চলতি বছরের মার্চে পরীক্ষা পদ্ধতি তুলে নেওয়ার চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছে।
তৃতীয় দাবির বিষয়ে অনুসন্ধান
এখন পর্যন্ত পরীক্ষা (ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে) সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা আসে নি শীর্ষক দাবির বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রথম আলো’র ওয়েবসাইটে গত ০৬ জুন প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, নতুন শিক্ষাক্রমের ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের ষান্মাসিক সামষ্টিক মূল্যায়নের নির্দেশিকা প্রকাশ করা হয়েছে। ৭ জুন থেকে ষান্মাসিকের সামষ্টিক মূল্যায়ন শুরু হবে। ১৮ জুন পর্যন্ত সামষ্টিক মূল্যায়ন চলবে।
পরবর্তীতে গত ২৫ মে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এ সংক্রান্ত নোটিশটি খুঁজে পাওয়া যায়।

অর্থাৎ, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে এখন পর্যন্ত পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা আসেনি শীর্ষক দাবিটিও সঠিক নয়৷ গতকালই এ সংক্রান্ত মূল্যায়ন শেষ হয়েছে।
মূলত, সম্প্রতি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া কিছু পোস্টে ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির শিক্ষাক্রম বিষয়ে দাবি করা হয় এই দুই শ্রেণির নতুন সিলেবাসে প্রণীত বইগুলোর দায়িত্বে ছিলেন ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। বই জঘন্য হওয়ার কারণে এই দুই শ্রেণির স্কুলের পরীক্ষা বাতিল করতে হয়েছে। এখন পর্যন্ত এই দুই ক্লাসের জন্য পরীক্ষা সংক্রান্ত কোনো নির্দেশনা আসে নি। কিন্তু রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে জানা যায়, দাবিগুলো সঠিক নয়৷ ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির বইগুলো রচনার দায়িত্বে নয়, দুইটি বইয়ের রচনা ও সম্পাদনা দলের একজন সদস্য ছিলেন ড. মুহম্মদ ইকবাল। তাছাড়া, তিনি সিলেবাস প্রণয়ন সংক্রান্ত কমিটির একজন সদস্য ছিলেন৷ বই খারাপ হওয়ার কারণে নয়, পরীক্ষা বাতিলের বিষয়ে আলোচনা ২০২১ সাল থেকে চলার পর এ বছর বাতিলের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত এসেছে। পরীক্ষার পরিবর্তে এই দুই শ্রেণিতে সামষ্টিক মূল্যায়ন চলছিল, যা গতকালই শেষ হয়েছে।
সুতরাং, ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণির পাঠ্যক্রম বিষয়ে ফেসবুকে সুনির্দিষ্ট তিনটি দাবি ছড়িয়ে পড়েছে, যেগুলো সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড: জাতীয় শিক্ষাক্রম রূপরেখা-২০২১
- Statement from Dr. Muhammed Zafar Iqbal
- বাংলা ট্রিবিউন: নতুন কারিকুলামে যত পরিবর্তন
- প্রথম আলো: ষষ্ঠ ও সপ্তম শ্রেণিতে প্রচলিত কোনো পরীক্ষা নয়