বাজপাখির ৪২ দিনে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার তথ্যটি মিথ্যা 

সম্প্রতি ‘একটা বাজপাখি সাউথ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার সময় তার শরীরে কিছু ইকুইপমেন্ট বসানো হয়, আর এই ছবিতে দেখা যাচ্ছে স্যাটেলাইট থেকে তার যাত্রাপথ।‘ শীর্ষক শিরোনামে একটি ছবি ও তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে। আর্কাইভ  দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানে, এখানেএখানে। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার সময় বাজপাখির যাত্রাপথ দাবিতে প্রচারিত তথ্য ও ছবিটি সঠিক নয় বরং এটি কোনো ধরনের নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। 

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে Reddit (আর্কাইভ),  9gag (আর্কাইভ),  ভারতীয় গণমাধ্যম India Times (আর্কাইভ) সহ বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম টুইটার (আর্কাইভ) ও ফেসবুকে (আর্কাইভ) দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার সময় বাজপাখির যাত্রাপথ দাবিতে প্রচারিত তথ্য ও ছবিটি খুঁজে পাওয়া যায়।

Screenshot: India Times

এসব ওয়েবসাইটে দাবি করা হয়েছে, পাখিটি একটি ফ্যালকন বা বাজপাখি। পাখিটির গায়ে একটি স্যাটেলাইট ট্রেকিং সিস্টেম বসিয়ে দেওয়া হয় এবং এটি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে যাত্রা শুরু করে ৪২ দিন ১০ হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে ফিনল্যান্ডে গিয়ে পৌঁছায়। এসময় পাখিটি প্রতিদিন ২৩০ কিলোমিটার করে পথ অতিক্রম করে।

Screenshot: 9gag

তবে এসব ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, পাখিটির গায়ে কে স্যাটেলাইট ট্রেকিং সিস্টেম বসিয়েছিল, কেন বসিয়েছিল, পাখিটির ভ্রমণ সংক্রান্ত তথ্যগুলো কিভাবে পাওয়া গেছে ইত্যাদি তথ্যগুলোর কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি।

Screenshot: Twitter

কি-ওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতি ব্যবহার করে, নাইজেরিয়ান গণমাধ্যম Mandy News এ গত ১৪ মার্চ ‘Fact Check: No, A Female Falcon Did Not Fly Nearly 10,000 Km In 42 Days From South Africa To Finland’ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: Mandy News 

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার সময় বাজপাখির যাত্রাপথ দাবিতে প্রচারিত ছবিটি অন্তত ২০১৫ সাল থেকেই ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে। 

এর মধ্যে ২০১৫ সালের এই সংক্রান্ত দাবিতে উল্লেখ করা হয় যে, বাজ পাখিটি ঐ বছরের ২০ এপ্রিল দক্ষিণ আফ্রিকার রেটিজ থেকে যাত্রা শুরু করে একই বছরের ২ জুন ফিনল্যান্ডে পৌঁছায়৷ ২০১৫ সালে ইন্টারনেটে প্রচারিত এমন দাবি দেখুন এখানে। তবে উল্লেখিত দাবিতে এই তথ্যের কোনো তথ্যসূত্র পাওয়া যায়নি। এর পরিবর্তে দাবিটি প্রচার করা হয়েছিল তথ্যটি শেয়ারকারী ব্যক্তি ইমেইলে পেয়েছেন উল্লেখ করে।

Screenshot: 4×4Community.co.za

২০২০ সালে ফেসবুকে একই দাবিতে প্রচারিত একটি পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। উক্ত পোস্টে ২০১৫ সালের তথ্যটিই কেবল সাল উল্লেখ ব্যতীত ব্যবহার করা হয়েছে।

Screenshot: WildAware Facebook Page 

২০২১ সালে ইন্টারনেটে প্রচারিত এমন দাবি দেখুন এখানে

Screenshot: Twistedsifter

উক্ত দাবিতে তথ্যসূত্র হিসেবে যে ওয়েবসাইটটি ব্যবহার করা হয়েছে, পরবর্তীতে সেখানে গিয়ে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। এছাড়া ২০২৩ সালে  প্রচারিত এমন দাবি দেখুন এখানে, (আর্কাইভ)। 

Screenshot: Twitter

এছাড়া এসব ওয়েবসাইটে বা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রথমদিকে পাখিটিকে ইউরোপিয়ান হানি বাজার্ড হিসেবে প্রচার করা হলেও পরবর্তীতে এটিকে ফ্যালকন বা বাজপাখি হিসেবে প্রচার করা হয়েছে। রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এই দুইটি আলাদা আলাদা পাখি। অর্থাৎ সময়ে সময়ে প্রচারের সাথে সাথে তথ্যেরও পরিবর্তন ঘটেছে। 

ইউরোপিয়ান হানি বাজার্ড সম্পর্কে পড়ুন এখানে এবং ফেলকন বা বাজপাখি সম্পর্কে পড়ুন এখানে। 

Mandy News এর উপরিউক্ত ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদনটি থেকে আরও জানা যায়, মহিলা বাজপাখিটির প্রায় ১০ হাজার পথ অতিক্রম করে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে ৪২ দিনে উড়ে যাওয়ার ব্যাপারে প্রতিষ্ঠানটি কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ পায়নি। 

Screenshot: Mandy News 

এছাড়া এই প্রতিবেদনটির সূত্রে দক্ষিণ আফ্রিকা ভিত্তিক ওয়েবসাইট SA People এ ২০১৬ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি ‘#DurbanTremor Caused by Formation of a New African Continent?‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot: SA People News

এই প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, সোমালি টেকটনিক প্লেট, যার একটি ফল্ট লাইন -দক্ষিণ আফ্রিকার মধ্য দিয়ে দক্ষিণ দিকে প্রসারিত হয়ে ডারবান দিয়ে বের হয়ে গেছে- তা ধীরে ধীরে ভেঙে যাচ্ছে। এটি এক সময় আফ্রিকাকে  আলাদা করে নতুন একটি মহাদেশ গঠন করবে। 

Screenshot: SA People News

প্রতিবেদনটিতে যুক্ত এই ম্যাপের নিচে উল্লেখ করা হয়, কাকতালীয়ভাবে ফল্টলাইনের এই ম্যাপকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ড পর্যন্ত পাখির গতিপথ বলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।

Screenshot: SA People News

তবে SA People এর এই প্রতিবেদন ছাড়া উল্লেখিত দাবিতে উপরিউক্ত ছবিটিকে আর কোথাও খুঁজে পাওয়া যায়নি। অপরদিকে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার সময় বাজপাখির যাত্রাপথ দাবিতে প্রচারিত ছবিটিরও কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র খুঁজে পাওয়া যায়নি।

রিউমর স্ক্যানার টিমের এ পর্যন্ত সার্বিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার সময় বাজপাখির যাত্রাপথ দাবিতে প্রচারিত ছবি ও তথ্যটি কোনো নির্ভরযোগ্য সূত্র ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে ইন্টারনেটে প্রচার হয়ে আসছে।

মূলত, ইন্টারনেটে দীর্ঘদিন ধরেই একটি বাজপাখির দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে ৪২ দিনে ১০ হাজার কিলোমিটার পথ উড়ে যাওয়ার সময়ের যাত্রাপথ দাবিতে একটি ছবি ও তথ্য প্রচার হয়ে আসছে। এই ছবি ও তথ্য নিয়ে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, এগুলো কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যসূত্র ছাড়াই দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন ওয়েবসাইট ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার হয়ে আসছে। উপরন্তু অনুসন্ধানে আরও দেখা যায়, একই ছবি ইতোপূর্বে দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ড পর্যন্ত সোমালি টেকটনিক প্লেটের একটি ফল্টলাইনের বিচ্যুতি নির্দেশ করতেও ব্যবহার করা হয়েছে। তবে সার্বিক অনুসন্ধানে কোনো দাবির পক্ষেই নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি।

সুতরাং, দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে ফিনল্যান্ডে উড়ে যাওয়ার সময় বাজপাখির যাত্রাপথ দাবিতে যে তথ্য ও ছবি প্রচার করা হচ্ছে, তা সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img