শিক্ষামন্ত্রী কওমি মাদ্রাসা বন্ধের কোনো ঘোষণা দেননি 

সম্প্রতি, “কওমি মাদ্রাসা চিরতরে বন্ধ, নতুন শিক্ষামন্ত্রী আদেশ” শীর্ষক একটি তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

টিকটকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)। 

ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল কওমি মাদ্রাসা বন্ধের কোনো নির্দেশনা দেননি বরং ভিন্ন প্রেক্ষিতে দেওয়া শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যকে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হয়েছে।

অনুসন্ধানের শুরুতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করে গত ০৩ মার্চ বিডিনিউজ এর ওয়েবসাইটে “কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রমও সরকারের ভাবনায়” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। 

উক্ত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ০৩ মার্চ সন্ধ্যায় ওসমানী মিলনায়তনে ডিসি সম্মেলনে শিক্ষা মন্ত্রণালয় ও প্রাথমিক শিক্ষা মন্ত্রণালয় কার্য অধিবেশন শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, কওমি মাদ্রাসায় একটি বয়স সীমা পর্যন্ত সরকারি শিক্ষাক্রম পড়ানোর ওপর জোর দিচ্ছেন শিক্ষামন্ত্রী মুহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল। এই বিষয়টি নিয়ে বিষয়টি নিয়ে কওমি মাদ্রাসার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বেফাকুল মাদারাসিল আরাবিয়ার (বেফাক) সঙ্গে কাজ করার কথাও বলেছেন তিনি। 

মন্ত্রী বলেছেন, যত্রতত্র অনিবন্ধিত মাদ্রাসা গড়ে উঠায় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে উপস্থিতির কমতির দিকে। একে সবার জন্য বড় চ্যালেঞ্জ উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, “এটি নিরসন করতে হবে।”

কওমি মাদ্রাসার শিক্ষাক্রম নিয়েও সরকার ভাবছে বলেও জানান নওফেল। বলেন, “একটি বয়সসীমা পর্যন্ত সেখানে যাতে জাতীয় শিক্ষাক্রম অনুসরণ করা হয়। নয়তো শিক্ষার্থীরা কাঙ্ক্ষিত যোগ্যতা ও দক্ষতা অর্জন করতে পারবে না। এজন্য বেফাকের সঙ্গে কাজ করব।”

ডিসিরা কী বলেছেন, সে প্রশ্নে শিক্ষামন্ত্রী বলেন, “অনিবন্ধিত মাদ্রাসার বিষয়টি উঠে এসেছে।…জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই প্রতিষ্ঠানগুলো যত্রতত্রভাবে হওয়ার কারণে সরকারের যে প্রাথমিক শিক্ষা, সেখানে শিক্ষার্থী ভর্তি হলেও উপস্থিতির কমিত দেখা যাচ্ছে।”

সরকার কী ভাবছে- সে প্রশ্নে নওফেল বলেন, “যে সময়ে সাধারণ শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালিত হয় সেই সময়ে এ ধরনের প্রতিষ্ঠান (নুরানী মাদ্রাসা) বন্ধ রাখা যায় কি না সে আলোচনা আমরা ভবিষ্যতে করব। অনিবন্ধিত প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতির হার বাড়বে, সরকারের শিক্ষাক্রম অনুসারে পরিচালিত প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতি কমবে সেটি কখনো কাঙ্ক্ষিত নয়। এ বিষয়ে আমরা মাঠ প্রশাসনের সঙ্গে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে কাজ করব।… বেফাক কীভাবে তাদের ছয়টি বোর্ডের মাধ্যমে নিবন্ধন দিচ্ছে, তাদের সঙ্গে আমাদের কাজ করতে হবে।” 

শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের ভিডিও দেখুন- এখানে

সেসময়, শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যের প্রেক্ষিতে  প্রতিবাদ জানিয়েছিল ইসলামিক দল ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ। 

ঐ প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে ০৫ মার্চ শিক্ষামন্ত্রী তার ঐ বক্তব্যের ব্যাখ্যা প্রদান করেন।

দৈনিক যুগান্তরে “কওমি মাদ্রাসা আছে থাকবে: শিক্ষামন্ত্রী” শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়,  ০৩ মার্চ জেলা প্রশাসক সম্মেলনের প্রথম দিন মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা এবং কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগ সম্পর্কিত কার্য-অধিবেশন শেষে কওমি মাদ্রাসা নিয়ে কথা বলেন শিক্ষামন্ত্রী। তার বক্তব্যকে বিকৃত করে একটি রাজনৈতিক দল প্রচার করছে বলে দাবি করেন মন্ত্রী।

তিনি বলেন, কওমি মাদ্রাসা বন্ধের কথা বলিনি। আমরা কওমি মাদ্রাসা বোর্ডগুলোর সঙ্গে কাজ করতে চাই। কওমি মাদ্রাসা বাংলাদেশে আছে এবং ভবিষ্যতেও থাকবে।

তিনি আরও বলেন, একটি জেলা থেকে একটি আলোচনা এসেছিল, অনিবন্ধিত, নাম-পরিচয়হীন নুরানি মাদ্রাসার নামে কিছু প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠছে। সেগুলো নিবন্ধনের প্রক্রিয়া কী? সেই পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলেছিলাম, যেসব নুরানি মাদ্রাসা গড়ে উঠছে, সেগুলোর যথাযথ নিবন্ধন আছে কি না, সেগুলোতে কিভাবে শিক্ষাক্রম পরিচালিত হচ্ছে? অন্যান্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যাতে সাংঘর্ষিক না হয়, সে বিষয়ে আলোচনা করে আমরা সিদ্ধান্ত নেব, কিভাবে তা ইউনিফরমিটির মধ্যে আনা যায়।

বক্তব্য বিকৃত করা হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, ০৪ মার্চ একটি রাজনৈতিক দল এবং রাজনৈতিক নামধারী কিছু সংগঠন থেকে বলা হয়েছে, নুরানি বা কওমি মাদ্রাসার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থী কমে যাচ্ছে এবং সেগুলো নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।  আমি বলছি, এ আলোচনা আসে জেলা প্রশাসকদের কাছ থেকে যে, অনিবন্ধিত অনেক প্রতিষ্ঠান চলছে, সেগুলোর নিয়ন্ত্রক কারা? এ ধরনের মন্তব্য (কওমি মাদ্রাসা বন্ধ) আমি করিনি। তারা এ আলোচনা সৃষ্টি করে গুজব রটাচ্ছে। আমার বক্তব্য ভিডিওসহ আছে। গুজব রটিয়ে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের মধ্যে এক ধরনের উত্তেজনা সৃষ্টির নোংরা অপচেষ্টা করছে তারা।

শিক্ষামন্ত্রী বলেন, তারা আগে আরও অনেক ধরনের মানহানিকর এবং আপত্তিকর কথা বলেছে। এর মধ্যে একটি ছিল যে আমি ইসকন নামের একটি সংগঠনের সদস্য এবং ইসকনের সদস্য হয়ে আমি ভিন্ন সংস্কৃতি শিক্ষাক্রমে ঢোকানোর অপচেষ্টায় লিপ্ত আছি। আমার বক্তব্য হলো, এটি একেবারে আপত্তিকর, মানহানিকর ও ষড়যন্ত্রমূলক কথা।

তিনি বলেন, আমি ইসকনের সদস্য নই। আমি একজন অসাম্প্রদায়িক মানুষ। আমার বাবা বিভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের তীর্থ কেন্দ্রে, পর্যটন কেন্দ্রে পর্যটক হিসেবে আমাকে নিয়ে গিয়েছিলেন। ইসকনের একটি অনুষ্ঠানে যাওয়া মানে এই নয় যে, আমি ইসকনের সদস্য। ইসকনের সদস্য হিসেবে আমাকে প্রচার করা হচ্ছে, আমি এর প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

একই তথ্যে সংবাদ প্রকাশ করেছে মূলধারার গণমাধ্যম প্রথম আলো। 

মূলত, গত ০৩ মার্চ শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেল জেলা প্রশাসক সম্মেলনে কওমি মাদ্রাসার বিষয়ে জেলা প্রশাসকদের মতামতের প্রেক্ষিতে একটি বক্তব্য দেন। বক্তব্যে তিনি ‘অনিবন্ধিত মাদ্রাসা’ নিরসনের কথা বলেন৷ পরবর্তীতে ইসলামিক দল ও সংগঠনের নেতৃবৃন্দ শিক্ষামন্ত্রীর বক্তব্যের প্রতিবাদ জানায়। এরইমধ্যে “কওমি মাদ্রাসা চিরতরে বন্ধ, নতুন শিক্ষামন্ত্রী আদেশ” শীর্ষক একটি তথ্য ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। তবে রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবিটি মিথ্যা। প্রকৃতপক্ষে, শিক্ষামন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী নওফেলের দেওয়া বক্তব্যকে বিকৃতভাবে প্রচার করা হচ্ছে।

সুতরা, কওমি মাদ্রাসা চিরতরে বন্ধ করতে শিক্ষামন্ত্রী আদেশ দিয়েছেন দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img