জয়ের টাকা ও মোদির কথায় গুজব ছড়িয়েছি শীর্ষক ময়ূখের স্বীকারোক্তির এই ভিডিওটি ডিপফেক

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম রিপাবলিক বাংলার সঞ্চালক ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের রিপাবলিক বাংলার টিভি চ্যানেলে স্বীকারোক্তি সদৃশ একটি ভিডিও প্রচার করে ক্যাপশনে দাবি করা হয়েছে, “সজীব ওয়াজেদ জয়ের টাকা পেয়ে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে মিথ্যা ছড়িয়েছি: ময়ুখ রঞ্জন ঘোষ”।

ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের কথিত স্বীকারোক্তির উক্ত ভিডিওটিতে তাকে বলতে শোনা যায়, তিনি এতদিন বাংলাদেশের চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার নিয়ে যা যা বলেছেন সব মিথ্যা। বাংলাদেশ নিয়ে তিনি ইচ্ছেকৃতভাবে গুজব ছড়িয়েছেন যা সাংবাদিকতার জন্যেও লজ্জার। সত্যি বলতে কি বাংলাদেশের হিন্দুরা যে সম্মান ও অধিকার পায় তা ভারতের মুসলিমরা স্বপ্নেও পায় না। এছাড়াও তাকে বলতে শোনা যায় তিনি এসব মিথ্যা তথ্য বাংলাদেশের সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয়ের টাকা পেয়ে এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী মোদির নির্দেশে প্রচার করেছেন।

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, সজীব ওয়াজেদ জয়ের টাকা পেয়ে ও নরেন্দ্র মোদির নির্দেশে বাংলাদেশ বিষয়ে গুজব ছড়িয়েছেন জানিয়ে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের স্বীকারোক্তির এই ভিডিওটি আসল নয় বরং, ডিপফেক প্রযুক্তির সহায়তায় রিপাবলিক বাংলায় ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের একটি ভিডিওতে ভুয়া অডিও সংযুক্ত করে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করে প্রচার করা হয়েছে।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টগুলো পর্যবেক্ষণ করলে তাতে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ এরূপ স্বীকারোক্তি কোন প্রেক্ষাপটে, কখন দিয়েছেন সে বিষয়ে কোনো বিস্তারিত তথ্যের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। এছাড়া, এ বিষয়ে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে আলোচিত দাবিটির সপক্ষে কোনো নির্ভরযোগ্য তথ্যপ্রমাণও মেলেনি।

তবে, অনুসন্ধানে রিপাবলিক বাংলার ইউটিউব চ্যানেলে “বাংলায় সংখ্যালঘু সংখ্যাগুরু হবে। এপারেও গ্রেটার বাংলাদেশ?” শীর্ষক শিরোনামে ২০২৪ সালের ১৪ ডিসেম্বরে প্রচারিত ময়ূখ রঞ্জন ঘোষ উপস্থাপিত একটি ভিডিও প্রতিবেদন পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনে ময়ূখের পরিধেয় পোশাক, টাই, পারিপার্শ্বিক অবস্থার সাথে প্রচারিত ভিডিওটির তুলনা করলে ৪ মিনিট ও ৬ মিনিট পরবর্তী দৃশ্যের সাথে সাদৃশ্য পাওয়া যায় এবং লক্ষ্য করা যায় এই দুই অংশের দৃশ্য আলোচিত দাবিতে প্রচারিত স্বীকারোক্তির ভিডিওতে ব্যবহার করা হয়েছে। এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, প্রচারিত ভিডিওটির দৃশ্য মূলত উক্ত ভিডিও প্রতিবেদনের দুইটি অংশ থেকেই নেওয়া হয়েছে। 

Comparison : Rumor Scanner

কিন্তু, ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের উক্ত আসল প্রতিবেদনে আলোচিত দাবির অনুরূপ কোনো কথাই ময়ূখকে বলতে শোনা যায়নি। উক্ত ভিডিওতে ময়ূখ বরং ভারতের ‘পুরমন্ত্রী ও মেয়র ফিরহাদ হাকিম’ এর সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বিষয়ে একটি বক্তব্য এবং বাংলাদেশের মাওলানা নূর হোসেনের বক্তব্য দাবিতে একটি বক্তব্য বিশ্লেষণ করেছেন। বিশ্লেষণে তিনি ভারতে হিন্দুরা বিপদে আছে দাবি করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদের অবস্থানের সমালোচনা করেন। তাছাড়া, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি পর্যবেক্ষণ করলে তাতে সংযুক্ত অডিও এর সাথে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের অঙ্গভঙ্গির কিছুটা অসামঞ্জস্যতা লক্ষ্য করা যায় যেটি মূল ভিডিওতে পরিলক্ষিত হয়নি।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে প্রচারিত উক্ত ভিডিওটির সম্ভাব্য মূল ভিডিও আরটিনিউজ২৪ বিডি নামক একটি ইউটিউব চ্যানেলে পাওয়া যায়। উক্ত ভিডিওটির বর্ণনা অংশ পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, প্রচারিত ভিডিও কনটেন্টটি পরিবর্তিত বা কৃত্রিম এবং এর শব্দ বা ভিজ্যুয়াল উল্লেখযোগ্যভাবে সম্পাদিত বা ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় তৈরি করা হয়েছে বলে লেবেল করা হয়েছে। 

Screenshot: YouTube

এই চ্যানেলের অধীনে থাকা ফেসবুক পেজেও আলোচিত ভিডিওটি পোস্ট করেছে। তবে সেখানে এরূপ কোনো লেবেল বা সতর্কতা দেওয়া হয়নি বরং, আসল দাবিতেই পোস্ট করা হয়েছে।

এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে, মূলত ভারতের ‘পুরমন্ত্রী ও মেয়র ফিরহাদ হাকিম’ এর সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরু বিষয়ে একটি বক্তব্য ও মাওলানা নূর হোসেনের বক্তব্য বিশ্লেষণ করে ভারতে হিন্দুরা বিপদে আছে দাবি করে ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ হিন্দুদের অবস্থানকে ময়ূখের সমালোচনা করার ভিডিওটির দৃশ্য নিয়ে তাতে ডিপফেক প্রযুক্তির সহায়তায় ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের ভুয়া অডিও সংযুক্ত করে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। 

এই ইউটিউব চ্যানেল পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, তারা নিয়মিতভাবে এআই এবং বিভিন্ন প্রযুক্তি দিয়ে তৈরি এমন ভুয়া কনটেন্ট প্রচার করে থাকে। উক্ত ফেসবুক পেজটি থেকে এর আগে এরকম একাধিক এআই দিয়ে তৈরি ভিডিও আসল দাবিতে প্রচার করা হলে সে বিষয়ে ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানার।

উল্লেখ্য যে, ডিপফেক হল বাস্তবসম্মত দেখতে কিন্তু নকল বা কিছুটা পরিবর্তিত কন্টেন্ট যা ভিডিও বা অডিওর উপাদান সম্পাদনা করে তৈরি করা হয়। ডিপফেক ভিডিওতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (AI) প্রযুক্তি ব্যবহার করে একজন ব্যক্তির মুখের অবয়ব বা ভয়েসকে অন্য কারোর সাথে বা নিজেরই ভুয়া ভিন্ন ঘটনার ক্ষেত্রে বিশ্বাসযোগ্যভাবে প্রতিস্থাপন করা হয়। এই প্রযুক্তির সহায়তায় একজন ব্যক্তির এমন কিছু ভিডিও বা অডিও কন্টেন্ট তৈরি করা সম্ভব যা তিনি নিজে বলেননি বা করেননি।

সুতরাং, সজীব ওয়াজেদ জয়ের টাকা পেয়ে ও নরেন্দ্র মোদির নির্দেশে বাংলাদেশ বিষয়ে গুজব ছড়িয়েছেন জানিয়ে ময়ূখ রঞ্জন ঘোষের স্বীকারোক্তিমূলক ভিডিওটি ভুয়া ও বানোয়াট। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img