রবিবার, নভেম্বর 3, 2024

দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে হিন্দু নারী ধর্ষণের দাবিটি গুজব

সম্প্রতি, দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় এক হিন্দু নারীকে ধর্ষণ করা হয়েছে এমন একটি দাবি সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়েছে। 

ফেসবুকে বিভিন্ন পোস্টে ছবি ও পুলিশের গাড়ি পুকুরে ফেলে দেওয়ার একটি ভিডিও প্রচার করে বলা হচ্ছে– “দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় এক হিন্দু স্কুল ছাত্রীকে দলবদ্ধ ধর্ষন! ২৯ এপ্রিল ২০২৪ রোজ সোমবার দুপুর বেলা বাসায় ফেরার পথে রুকুনপুর বাশের হাট এলাকায় ২-৩ জন জিহাদী ট্রাক চালক ও হেলপার ইশানিয়া গ্রামের এক মেয়েকে ধর্ষন করে। একই উপজেলার ঘটনার ধর্ষক ছেলে পলাতক হওয়ায় ছেলের বাবাকে ইশানিয়ার জনতা ইশানিয়া স্কুলে আটকে রাখে। ঘটনায় পুলিশ এসে ধর্ষকের পিতাকে থানায় নিয়ে যেতে চাইলে সাধারণ জনতা বাধা দেয়।”

হিন্দু নারী ধর্ষণের

উক্ত দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ

Voice of Bangladeshi Hindus নামক এক্স হ্যান্ডেলেও একই দাবিটি প্রচার করা হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়– দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে হিন্দু নারী ধর্ষণ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। রিউমর স্ক্যানার বিভিন্ন গণমাধ্যমের সংবাদ, সংশ্লিষ্ট থানার বক্তব্য এবং স্থানীয় একজন সাংবাদিকের সাথে কথা বলে ধর্ষণের বিষয়টি গুজব বলে নিশ্চিত হয়েছে।

প্রকৃতপক্ষে মূল ঘটনা হলো– এক হিন্দু স্কুল শিক্ষিকাকে পথিমধ্যে ট্রাক্টরের হেলপার উত্যক্ত করার ঘটনার জেরে ট্রাক্টরের মালিককে ডেকে এনে ঐ শিক্ষিকার অবিভাবক ও এলাকাবাসী মারধর করে। খবর পেয়ে পুলিশ তাদের উদ্ধার করে হেফাজতে নিতে আসলে এলাকাবাসীর বাঁধার মুখে পড়ে। এ সময় উত্তেজিত জনতা পুলিশের ওপর আক্রমণ করে পুলিশ ভ্যানকে চালকসহ পুকুরে ফেলে দেয়। 

বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধানে উক্ত ঘটনায় বিষয়ে নিউজ২৪বিডির অনলাইন পোর্টালে গত ৩০ এপ্রিল “শিক্ষিকার উত্যক্তকারীকে ধরতে গিয়ে পুলিশ হামলার শিকার” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়,  ‘শিক্ষিকাকে উত্যক্ত করাকে কেন্দ্র করে বোচাগঞ্জে পুলিশের উপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা ঘটেছে। এতে দুইজন আহত হয়েছেন। এ ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে ১১ জনকে থানায় নিয়ে যায় পুলিশ।’

প্রতিবেদনে পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রের বরাতে আরও বলা হয়, ‘সোমবার(২৯ এপ্রিল) সকাল ১০টার দিকে বোচাগঞ্জের ইশানিয়া ইউনিয়নের জনৈক মহিলা কাহারোলের ডাবোর ইউপির একটি মিশন স্কুলের শিক্ষিকাকে পথিমধ্যে ট্রাক্টরের হেলপার উত্যক্ত করে। পরে সোমবার বিকালের দিকে ঐ ট্রাক্টরের মালিক কাহারোল থানার চামদুয়ারি গ্রামের মো. জিয়ারুল ইসলামকে ফোন করে ইশানিয়া গ্রামের স্কুল মাঠে ডেকে এনে আটকে রেখে ঐ শিক্ষিকার অভিভাবক ও এলাকাবাসী মারধর করে। পরে বোচাগঞ্জ পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আটককৃত জিয়ারুল ইসলামকে পুলিশ হেফাজতে নিতে চাইলে উত্তেজিত জনতা পুলিশের উপর হামলা ও পুলিশ ভ্যান ভাঙচুর করলে ড্রাইভার মো. মোস্তাছিন আলম তুহিন আহত হয়। এসময় অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা আহতদের উদ্ধার করে বোচাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে এলে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পুলিশের ড্রাইভার মোস্তাছিনকে দিনাজপুরে প্রেরণ করা হয়।’

বোচাগঞ্জ থানা অফিসার ইনচার্জ মো. আবু বক্কর সিদ্দিক রাসেল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে গণমাধ্যমকে বলেন, ‘৯৯৯ এ খবর পেয়ে সেখানে আমরা যাই। এ সময় উত্তেজিত হয়ে হামলা করলে আমাদের গাড়ীর ড্রাইভার ও গাড়ি ভাঙচুর করে। পরে আহত পুলিশ সদস্যকে উন্নত চিকিৎসা দিতে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। মামলা প্রক্রিয়াধীন। এ ঘটনায় ঘটনাস্থল থেকে ১১জনকে থানায় নিয়ে আসা হয়েছে।’

উক্ত ঘটনায় গ্রেফতার ব্যক্তিরা হলেন– চয়ন চন্দ্র রায় (২৫), মিঠুন চন্দ্র রায় (২৭) অনিক রায় (২০) লিখন রায় (৩০) আপন রায় (২৫) বিলাশ চন্দ্র রায় (৬০) রাজ কুমার (৫৬) জগদীশ রায় (২৬) পংকজ রায় (৩০) মংলু রায় (৪৫) সুর্য রায় (২০) মহেশ রায় (২১)। 

উক্ত বিষয়ে বাংলাদেশ প্রতিদিন, সময় টিভি, ঢাকা মেইল, প্রতিদিনের বাংলাদেশসহ আরও বেশকিছু গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে একই তথ্য পাওয়া যায়। 

আলোচিত পোস্টগুলোতে দেখা যায় সেখানে পুলিশের গাড়ি পুকুরে ফেলে দেওয়ার একটি ভিডিও এবং কিছু ছবি (মূলত ভিডিও থেকে নেয়া স্ক্রিনশট) যুক্ত করে প্রচার করা হয়েছে। এ ছবি ও ভিডিও নিয়ে অনুসন্ধানে নয়ন রায় নামের স্থানীয় এক সাংবাদিকের একটি ফেসবুক পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। 

Screenshot of Nayon Ray’s FB post 

গত ২৯ এপ্রিলের উক্ত পোস্টে নয়ন রায় তিনটি ভিডিও যুক্ত করে বোচাগঞ্জের এই ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ ক্যাপশনে লেখেন৷ তার পোস্ট থেকে ভিডিও এবং অন্য ভিডিওর স্ক্রিনশট নিয়েই মূলত পরবর্তীতে ধর্ষণের ঘটনার গুজবের সাথে যুক্ত করা হয়৷ তবে নয়ন রায়ের পোস্টে ধর্ষণ বিষয়ে কোনো কথা উল্লেখ ছিল না। উক্ত পোস্টে নয়ন রায় লেখেন– 

“দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় শিক্ষিকাকে উক্তত্য করাকে কেন্দ্র করে উত্তজিত জনতাকে শান্ত করতে গিয়ে বোচাগঞ্জে পুলিশের উপর হামলা গাড়ী ভাংচুর আহত ২ জন।

=======================================

দিনাজপুর প্রতিনিধি, নয়ন রায়:  দিনাজপুরের বোচাগঞ্জ উপজেলায় এক শিক্ষিকাকে উত্যক্ত করার বিষয়কে কেন্দ্র করে পুলিশের গাড়িতে হামলা ও ভাঙচুর করে এলাকাবাসী বোচাগঞ্জ থানা সুত্রে জানা গেছে, ২৯ এপ্রিল সোমবার সকাল আনুমিক ১০টার দিকে বোচাগঞ্জ উপজেলার ২নং ইশানিয়া ইউনিয়নের জনৈক মহিলা পাশ্ববর্তী কাহারোল উপজেলার ১নং ডাবোর ইউনিয়নের একটি মিশন স্কুলের শিক্ষিকাকে পথিমধ্যে ট্রাক্টরের হেলপার উক্তত্য করাকে কেন্দ্র করে বিকালের দিকে ঐ ট্রাক্টরের মালিক পাশবর্তী কাহারোল থানার চামদুয়ারি গ্রামের মোঃ জিয়ারুল ইসলামকে মোবাইল করে ইশানিয়া গ্রামের স্কুল মাঠে ডেকে এনে আটকে রাখে ঐ শিক্ষিকার অভিভাবক ও এলাকাবাসী এলোপাথারি মারধোর করে। বোচাগঞ্জ থানা পুলিশ খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে আটককৃত জিয়ারুল ইসলামকে পুলিশ হেফাজতে নিতে চাইলে এলাকাবাসী জনতা দলবদ্ধ হয় পুলিশের উপর হামলা ও পুলিশ ভ্যান ভাংচুর করে, ড্রাইভার মোঃ মোস্তাছিন আলম তুহিনকে গাড়ী সহ পাশ^বর্তী পুকুরে ফেলে দেয়, এতে পুলিশ ড্রাইভার ও ট্রাক্টর মালিক জিয়ারুল ইসলাম গুরুত্বর আহত হয়। এসময় অন্যান্য পুলিশ সদস্যরা আহতদের উদ্ধার করে বোচাগঞ্জ স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে এলে প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে পুলিশের ড্রাইভার মোস্তাছিনকে দিনাজপুরে প্রেরণ করা হয়। বোচাগঞ্জ থানা অফিসার ইনচার্জ,মোঃ আবু বক্কর সিদ্দিক রাসেল ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, অপরাধীদের আইনের আওতায় আনা হবে। আহত পুলিশ সদস্যকে উন্নত চিকিৎসা দিতে সার্বিক ব্যবস্থা গ্রহন করছেন বোচাগঞ্জ থানা। ২ নং ইশানিয়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান উৎপল রায় বুলু ঘটনাস্থলে উপস্থিতি হয়ে উভয়পক্ষকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেন। এই ঘটনায় বর্তমানে ইশানিয়া গ্রামে উত্তেজনা বিরাজ করছে।”

রিউমর স্ক্যানারের পক্ষ থেকে স্থানীয় সাংবাদিক নয়ন রায়ের সাথে যোগাযোগ করে তার ভিডিও যুক্ত করে বিভিন্ন পোস্টে ধর্ষণের দাবি করার বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ভিডিওটি আমার ধারণ করা। ঘটনাস্থলে একমাত্র সাংবাদিক হিসেবে আমি উপস্থিত ছিলাম। এখানে ধর্ষণের কোনো ঘটনা ঘটেনি। এটা গুজব। ইভটিজিং এর ঘটনা ঘটেছে । ইভটিজিং করার ঘটনা থেকে বিষয়টা এতদূর গড়িয়েছে।” 

পরবর্তীতে বোচাগঞ্জ থানায় যোগাযোগ করে জানতে চাওয়া হলে তারাও ধর্ষণের বিষয়টিকে গুজব বলে নিশ্চিত করে একই বর্ণনা জানিয়েছেন। 

মূলত, গত ২৯ এপ্রিল দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে  পথিমধ্যে এক স্কুল শিক্ষিকাকে (হিন্দু) ট্রাক্টরের হেলপারের (মুসলিম) উত্যক্ত করার ঘটনার জেরে ট্রাক্টরের মালিককে ডেকে এনে আটক করে মারধর করা হয়। খবর পেয়ে উদ্ধার করতে আসলে এলাকাবাসীর বাধাঁর মুখে পড়ে পুলিশ। এ সময় উত্তেজিত হিন্দু জনতা পুলিশের গাড়ী ভাঙচুর করে এবং চালকসহ পুলিশভ্যানটিকে পুকুরে ফেলে দেয়। উত্তেজিত জনতার পুলিশভ্যান পুকুরে ফেলে দেওয়ার ঘটনার ভিডিওচিত্রের সাথে পরবর্তীতে হিন্দু নারীকে ধর্ষণের ভুয়া দাবি যুক্ত করে সামাজিক মাধ্যমে প্রচার করা হয়।

সুতরাং, দিনাজপুরের বোচাগঞ্জে হিন্দু নারী ধর্ষিত হওয়ার দাবিটি মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র 

  • Media reports
  • Statement of a local journalist 
  • Statement of Bochaganj Thana

আরও পড়ুন

spot_img