সম্প্রতি ‘নারীর উন্নয়নে সবথেকে বড় বাধা পুরুষজাতী, পুরুষজাতী কুকুরের ন্যায়’ শীর্ষক একটি তথ্যকে বেগম রোকেয়ার মন্তব্য দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে।
ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, পুরুষ জাতিকে কুকুরের সাথে তুলনা করার উক্তিটি বেগম রোকেয়ার নিজের লেখা নয় বরং তিনি(বেগম রোকেয়া) উক্তিটি ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক মেরি করিলের ইংরেজি উপন্যাস The Murder of Delicia এর অনুবাদ অবলম্বনে তার রচিত ডেলিশিয়া হত্যা উপন্যাসে উল্লেখ করেছেন।
ওপেন সোর্স অনুসন্ধানের মাধ্যমে বেগম রোকেয়ার বই মতিচূড় (দ্বিতীয় খণ্ড) এর ‘ডেলিশিয়া হত্যা‘ উপন্যাসের ১৩৫ পৃষ্ঠায় অনুরূপ একটি লাইন খুঁজে পাওয়া যায়।
লাইনটিতে বেগম রোকেয়া লিখেন, ‘ডেলিশিয়ার জন্য অকপট হৃদয়ে শোক করিল কে?-স্পার্টান। কুকুর স্পার্টানের বাকশক্তি থাকিলে সে বলিত- ‘যদি সত্য, বিশ্বস্ততা এবং বিশুদ্ধভক্তি সদগুণ হয়, তবে কুকুর পুরুষাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যদি স্বার্থপরতা, ধূর্ততা ও কপটাচারকে সৎগুণ বলা যায় তবে পুরুষজাতি অবশ্য কুকুরের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।’
পরবর্তী অনুসন্ধানে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক মেরি করিলের উপন্যাস The Murder of Delicia এর ২৭৩ নাম্বার পৃষ্ঠাতেও একই মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়।
সেখানে মেরি করিল লিখেন
অর্থাৎ ‘কুকুরের মধ্যে সততা একটি সাধারণ গুণ, কিন্তু পুরুষদের মধ্যে এটি ব্যতিক্রমী। কুকুর ভালোবাসে এবং বিশ্বস্ত; বিপরীতে পুরুষ ইচ্ছা, এবং অধিকার সহ অবিশ্বাসী! তবুও মানুষ, কুকুরের চেয়ে সৃষ্টির মাপকাঠিতে উচ্চতর। আমি এটা বুঝতে পারি না যদি সত্য, বিশ্বস্ততা এবং ভক্তি গুণ হয়, তাহলে কুকুর পুরুষের চেয়ে শ্রেষ্ঠ; স্বার্থপরতা, ধূর্ততা এবং ভণ্ডামি যদি গুণ হয়, তবে পুরুষরা অবশ্যই কুকুরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ!’
অর্থাৎ মেরি করিলই তার লেখায় পুরুষ ও কুকুরের মধ্যে তুলনা করেছেন এবং বেগম রোকেয়া সেটির অনুবাদ করেছেন মাত্র। সুতরাং সার্বিক বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয়, বেগম রোকেয়া নিজে সরাসরি পুরুষ জাতিকে কুকুরের সাথে তুলনা করেননি।
অপরদিকে কুকুরের সাথে পুরুষ জাতির তুলনায় বেগম রোকেয়ার উক্তি দাবিতে প্রচারিত তথ্যটির প্রথম অংশ ‘নারীর উন্নয়নে থেকে বড় বাধা পুরুষ জাতি’ এমন কোনো উদ্ধৃতি ‘ডেলিশিয়া হত্যা’ উপন্যাসটিতে খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে রোকেয়ার লেখা মতিচূর (প্রথম খণ্ড) গ্রন্থের স্ত্রী জাতির অবনতি প্রবন্ধে নারীদের পিছিয়ে পড়ার কারণ হিসেবে তার একটি মন্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়।
সেখানে তিনি লিখেন, ‘পুরুষজাতি বলেন যে, তাঁহারা আমাদিগকে ‘বুকের ভিতর বুক পাতিয়া বুক দিয়া ঢাকিয়া রাখিয়াছেন, এবং এরূপ সোহাগ আমরা সংসারে পাইব না বলিয়া ভয় প্রদর্শন করিয়া থাকেন। আমরা তাই সোহাগে গলিয়া-ঢলিয়া বহিয়া যাইতেছি! ফলত তাঁহারা যে অনুগ্রহ করিতেছেন, তাহাতেই আমাদের সর্বনাশ হইতেছে।’ অর্থাৎ তিনি বলেছেন, নারীদের সর্বনাশের কারণ হচ্ছে তাদের প্রতি পুরুষদের অতিমাত্রায় ভালোবাসা ও অনুগ্রহ।
বেগম রোকেয়া তাঁর লেখায় নারীর অলংকারকেও কুকুরের গলাবন্ধনী সহ অন্যান্য প্রাণীর সাথে তুলনা করেছিলেন
বিশ্লেষণে দেখা যাচ্ছে, বেগম রোকেয়ার লেখায় পুরুষ ও কুকুরের মধ্যে যে তুলনা সেটি একটি অনুবাদমূলক লেখা। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বেগম রোকেয়া তার নিজের কাজ ‘স্ত্রী জাতির অবনতি‘ নামক একটি প্রবন্ধে নারীদের অবনতির জন্য তাদের অলঙ্কারপ্রিয়তাকে উল্লেখ করেন এবং অলঙ্কারকে কুকুরের গলা বন্ধনী, ঘোড়া, হাতির লোহার শিকল ও গরুর নাকের দড়ির সঙ্গে তুলনা করেছেন।
প্রবন্ধটিতে তিনি বলেন, ‘কুকুরের গলে যে গলাবন্ধ (dog collar) দেখি, উহারই অনুকরণে বোধ হয় আমাদের জড়োয়া চিক নির্মিত হইয়াছে! অশ্ব হস্তী প্রভৃতি পশু লৌহশৃঙ্খলে আবদ্ধ থাকে, সেইরূপ আমরা স্বর্ণশৃঙ্খলে কণ্ঠ শোভিত করিয়া মনে করি ‘হার পারিয়াছি’। গো-স্বামী বলদের নাসিকা বিদ্ধ করিয়া ‘নাকাদড়ি পরায়, এদেশে আমাদের স্বামী আমাদের নাকে ‘নোলক’ পরাইয়াছেন!!’
একই প্রবন্ধের শুরুতেই তিনি ভিক্ষুকদের সাথে নারীকে তুলনা করেছেন।
প্রবন্ধটির শুরুতেই বেগম রোকেয়া বলেন, ‘স্ত্রীজাতি সুবিধা না-পাইয়া সংসারের সকল প্রকার কার্য হইতে অবসর লইয়াছে এবং ইহাদিগকে অক্ষম ও অকর্মণ্য দেখিয়া পুরুষজাতি ইহাদের সাহায্য আরম্ভ করিল। ক্রমে পুরুষ পক্ষ হইতে যতই বেশি সাহায্য পাওয়া যাইতে লাগিল, স্ত্রী-পক্ষ ততই অধিকতর অকর্মণ্য হইতে লাগিল। এদেশের ভিক্ষুকদের সহিত আমাদের বেশ তুলনা হইতে পারে।’
বেগম রোকেয়া পুরুষকে যেভাবে দেখেছেন
বেগম রোকেয়ার বিভিন্ন লেখায় পুরুষ ও নারীকে নিয়ে মিশ্র বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়। যেমন, নারী-পুরুষের সমান অধিকার বিষয়ে ও ভারতবাসীর অগ্রসর হতে না পারার কারণ হিসেবে তিনি তার ‘অর্ধাঙ্গী‘ প্রবন্ধে লিখেন, ‘দ্বিচক্র শকটের গতি দেখাই। যে-শকটের এক চক্র বড় (পতি) এবং এক চক্র ছোট (পত্নী) হয়, সে-শকট অধিক দূরে অগ্রসর হইতে পারে না;—সে কেবল একই স্থানে (গৃহকোণেই) ঘুরিতে থাকিবে। তাই ভারতবাসী উন্নতির পথে অগ্রসর হইতে পারিতেছেন না। সমাজের_বোধব্যবস্থা আমাদিগকে তাঁহাদের অবস্থা হইতে সম্পূর্ণ পৃথক রাখিয়াছে; তাঁহাদের সুখ-দুঃখ এক প্রকার, আমাদের সুখ-দুঃখ অন্য প্রকার।
স্ত্রীজাতির অবনতি প্রবন্ধে তিনি লিখেন, ‘আমরা সমাজের অর্ধাঙ্গ, আমরা পড়িয়া থাকিলে সমাজ উঠিবে কীরূপ? কোনো ব্যক্তি এক পা বাঁধিয়া রাখিলে সে খোঁড়াইয়া খোঁড়াইয়া কতদূর চলিবে? পুরুষের স্বার্থ এবং আমাদের স্বার্থ ভিন্ন নহে। তাহাদের জীবনের উদ্দেশ্য বা লক্ষ্য যাহা আমাদের লক্ষ্য তাহাই।’
তবে নিরীহ বাঙালি প্রবন্ধে বেগম রোকেয়া বাঙালি পুরুষকে পরিহাস করে বলেছেন, ‘যদি ভারতবর্ষকে একখানা উপন্যাস মনে করেন, তবে বাঙালি তাহার নায়িকা! ভারতের পুরুষসমাজে বাঙালি পুরুষিকা!! অতএব আমরা মূর্তিমান কাব্য।’ এর ব্যাখ্যায় পাদটীকায় তিনি লিখেন, ”নায়িকা” বলিয়া আমি ব্যাকরণের নিয়মভঙ্গ করি নাই। কারণ, অনেক বাঙালি পুরুষকে বেচারি বলে। উর্দু ভাষায় পুরুষকে ‘বেচারা ও স্ত্রীলোককে ‘বেচারি’ বলে। যদি আমরা ‘বেচারি’ হইতে পারি, তবে ‘পদ্মিনী’, ‘নায়িকা ও পুরুষিকা’ হইলে দোষ কী?’
একই প্রবন্ধে পুরুষ তথা বরকে লুন্ঠনকারী ও শ্বশুরকে old fool উল্লেখ করে বেগম রোকেয়া বলেন, ‘আমাদের অন্যতম ব্যবসায়—পাস বিক্রয়। এই পাস বিক্রেতার নাম ‘বর’ এবং ক্রেতাকে ‘শ্বশুর’ বলে । এক-একটি পাসের মূল্য কত জানো? ‘অর্ধেক রাজত্ব ও এক রাজকুমারী’। এম. এ. পাস অমূল্যরত্ন, ইহা যে-সে ক্রেতার ক্রেয় নহে। নিতান্ত শস্তা দরে বিক্রয় হইলে, মূল্য- এক রাজকুমারী এবং সমুদয় রাজত্ব। আমরা অলস, তরলমতি, শ্রমকাতর, কোমলাঙ্গ বাঙালি কিনা, তাই ভাবিয়া দেখিয়াছি সশরীরে পরিশ্রম করিয়া মুদ্রালাভ করা অপেক্ষা old fool শ্বশুরের যথার্সবস্ব লুণ্ঠন করা সহজ।’
অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, বেগম রোকেয়া একইসাথে নারী-পুরুষকে তার লেখায় যেমনভাবে মর্যাদা দিয়েছেন তেমনি আবার পুরুষকে নিয়ে কটাক্ষও করেছেন। তবে ‘নারীর উন্নয়নে থেকে বড় বাধা পুরুষ জাতি’ বেগম রোকেয়ার সরাসরি এমন কোনো উক্তি এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি।
মূলত, বেগম রোকেয়া ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক মেরি করিলের ইংরেজি উপন্যাস The Murder of Delicia এর অনুবাদ করেছিলেন। এই উপন্যাসেরই শেষ দিকের একটি অংশে বলা হয়েছে, ‘Dogs love and are faithful; men desire, and with possession are faithless! Yet men, so they say, are higher in the scale of creation than dogs. I do not understand this. If truth, fidelity, and devotion are virtues, then dogs are superior to men; if selfishness, cunning, and hypocrisy are virtues, then men are certainly superior to dogs!’ বেগম রোকেয়া তার ‘ডেলিশিয়া হত্যা’ উপন্যাসে এই লাইনগুলোর অনুবাদ করে লিখেন, ‘কুকুর স্পার্টানের বাকশক্তি থাকিলে সে বলিত- ‘যদি সত্য, বিশ্বস্ততা এবং বিশুদ্ধভক্তি সদগুণ হয়, তবে কুকুর পুরুষাপেক্ষা শ্রেষ্ঠ, যদি স্বার্থপরতা, ধূর্ততা ও কপটাচারকে সৎগুণ বলা যায় তবে পুরুষজাতি অবশ্য কুকুরের তুলনায় শ্রেষ্ঠ।’ তার অনুবাদের এই অংশটিকেই সম্প্রতি বিস্তারিত উল্লেখ না করে কেবল তার ছবি বা নাম ব্যবহার করে এমনভাবে প্রচার করা হচ্ছে যেন উক্তিটি তার নিজের করা। এছাড়া এই উক্তিটির সঙ্গে ‘নারীর উন্নয়নে সবচেয়ে বড় বাধা পুরুষ জাতি’ শীর্ষক আরও একটি অংশও জুড়ে দেওয়া হলেও বিস্তারিত অনুসন্ধানে এই প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত বেগম রোকেয়ার উক্ত উক্তিটির কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। তবে পরবর্তীতে বেগম রোকেয়ার এমন কোনো উক্তি সম্পর্কে জানা গেলে প্রতিবেদনে সেটি হালনাগাদ করে নেওয়া হবে।
সুতরাং, পুরুষ জাতিকে কুকুরের সাথে তুলনা নিয়ে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক মেরি করিলের ইংরেজি উপন্যাস The Murder of Delicia থেকে অনুবাদ করে লেখা মন্তব্যকে বেগম রোকেয়ার মন্তব্য দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা বিভ্রান্তিকর।