পক্ষপাতিত্বমূলক আম্পায়ারিং ইস্যুতে বিসিবির মামলা করার দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি “বিশ্বকাপে টিম ইন্ডিয়ার পক্ষপাতিত্বমূলক আম্পায়ারিং ইস্যুতে মামলা করলো বিসিবি!!” শীর্ষক শিরোনামের একটি পোস্ট কিছু ভুঁইফোড় অনলাইনের বরাতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এবং এখানে

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, পক্ষপাতিত্বমূলক আম্পায়ারিং ইস্যুতে বিসিবির মামলা করার বিষয়টি সত্য নয় বরং কোনোরকম তথ্যসূত্র ছাড়াই ভুঁইফোড় সংবাদমাধ্যমের মাধ্যমে উক্ত সংবাদ প্রচার করা হচ্ছে।  

অনুসন্ধানে কিছু দেশীয় ভুইফোঁড় সংবাদমাধ্যমে (দেখুন এখানে, এখানে) গত ১৩ নভেম্বর “আইসিসির নতুন চেয়ারম্যান সিংহাসন দখল করতে না করতেই, বিশ্বকাপে টিম ইন্ডিয়ার পক্ষপাতিত্বমূলক আম্পায়ারিং ইস্যুতে মামলা করলো বিসিবি” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।”

প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়, “টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে ভারত-বাংলাদেশ ম্যাচে বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে নিয়ন্ত্রণ সংস্থার (আইসিসি) ফোরামে অভিযোগ দিয়েছে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)।আজ বিশ্বকাপের ফাইনালে ইংল্যান্ড-পাকিস্তান মুখোমুখি হওয়ার আগে মেলবোর্ন শহরে এসেছে আরেক বড় সিদ্ধান্ত। আইসিসির চেয়ারম্যানের মেয়াদ শেষ হয়েছে আগে। নতুন চেয়ারম্যান নির্বাচনসহ কিছু

এজেন্ডা নিয়ে সভায় বসেছে নিয়ন্ত্রক সংস্থা।”

প্রতিবেদনের কিছু লাইন কিওয়ার্ড সার্চ পদ্ধতির মাধ্যমে অনুসন্ধানে মূল ধারায় গণমাধ্যম ‘Somoy Tv’ এর ওয়েবসাইটে গত ১৩ নভেম্বর বাংলাদেশের সঙ্গে বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে আইসিসিতে অভিযোগ শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। ভুইফোঁড় অনলাইনের প্রতিবেদনগুলোর সাথে এই প্রতিবেদনটির হুবহু মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

কিন্তু প্রতিবেদনে “বিসিবি মামলা করেছে” এমন কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।

অর্থাৎ, আইসিসির সভায় বাংলাদেশের সঙ্গে বাজে আম্পায়ারিং নিয়ে অভিযোগ করার বিষয়টিকে “বিসিবি মামলা করেছে” হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।

কী অভিযোগ দিয়েছে বিসিবি?

গত ২ নভেম্বর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ ও ভারত। সেই ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ব্যাট করার সময় অক্ষর প্যাটেলের বলে একটি ফেক ফিল্ডিং হয়েছিল বলে দাবি বাংলাদেশের। সেই সময় আম্পায়ারকে অভিযোগ করেন নাজমুল হোসেন শান্ত, তবে সে অভিযোগ নিয়ে কোনো ভ্রূক্ষেপই করতে দেখা যায়নি মাঠের আম্পায়ারদের। নিয়ম অনুযায়ী এই অভিযোগে পেনাল্টি রান দিলে বাংলাদেশের স্কোরবোর্ডে যোগ হত ৫ রান। এ ছাড়া বাংলাদেশকে ভেজা মাঠে খেলতে বাধ্য করা হয় বলেও অভিযোগ রয়েছে। এই দুই ইস্যুতে ক্রিকেটের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রক সংস্থা আইসিসির কাছে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ জানানোর কথা গণমাধ্যমকে পরদিন জানায় বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ড (বিসিবি)। ১১ থেকে ১৩ নভেম্বর মেলবোর্নে আইসিসির বোর্ড সভা অনুষ্ঠিত হয়। আইসিসি সভার পর আম্পায়ারিং নিয়ে আলোচনা হয়েছে বলে খবর এসেছে গণমাধ্যমে। এ বিষয়ে নির্ধারিত ফোরামে অভিযোগ করেছে বিসিবি। সামনে কোনো ইভেন্টে যেন এমন কোনো সিদ্ধান্তের মুখোমুখি না হতে হয়, সে ব্যাপারেও হয়েছে আলোচনা।

আম্পায়ারিংয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা যায়?

ফেক ফিল্ডিং এবং ভেজা মাঠ এই ইস্যুতে অভিযোগ ছিল বাংলাদেশের। 

ফেক ফিল্ডিংয়ের বিষয়ের অনুসন্ধানে আইসিসি প্রকাশিত ICC PLAYING HANDBOOK 2019-20 এ উল্লিখিত ৪১ নং আইনের ৪১.৫ ধারার ৪১.৫.১ এবং ৪১.৫.২ উপধারা থেকে জানা যায়, কোন ফিল্ডার যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করা, প্রতারণা করা, কিংবা বাধা দেওয়ার চেষ্টা করে তাহলে তা অন্যায্য বলে গণ্য হবে এবং ফিল্ডার এগুলো ইচ্ছাকৃত বা অনিচ্ছাকৃতভাবে করেছেন কিনা সে ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেবেন মাঠে দায়িত্বরত আম্পায়ার। আম্পায়ার যদি মনে করেন ফিল্ডার ব্যাটসম্যানকে বিভ্রান্ত করা, প্রতারণা করা, কিংবা বাধা দেওয়ার চেষ্টা ইচ্ছাকৃতভাবে করেছে তাহলে তার শাস্তিস্বরূপ ব্যাটিং সাইডে অতিরিক্ত পাঁচ রান যোগ হবে। কিন্তু বাংলাদেশের অভিযোগ আমলে নেয়নি আম্পায়াররা। তাই পাঁচ রান থেকেও বঞ্চিত হতে হয়েছে।

আরেকটি অভিযোগ ছিল ভেজা মাঠ বিষয়ে। এ বিষয়ে একই হ্যান্ডবুকের দুই নং আইনের ২.৭ ধারার ২.৭.৪ উপধারায় বলা আছে মাঠের আম্পায়াররা যদি মনে করেন মাঠ খুবই পিচ্ছিল অথবা ভেজা যা কিনা বোলার, ফিল্ডার কিংবা ব্যাটসম্যানের জন্য অনুকূল নয়, তাহলে এই অবস্থায় খেলা অব্যাহত রাখা বিপজ্জনক এবং অযৌক্তিক বলে বিবেচিত হবে। এক্ষেত্রেও তাই আম্পায়ারের সিদ্ধান্তই মানতে হয়েছে বাংলাদেশ দলকে।

হ্যান্ডবুকের কোথাও কোনো অভিযোগেই মামলা করার বিষয়টি আসেনি। বরং দুই নং আইনের ২.৬ ধারায় বলা হয়েছে, আম্পায়ারদ্বয় খেলায় ন্যায্যতা এবং অসাধুতা বিচারের একমাত্র বিচারক (sole judges) হবেন।

কিন্তু আম্পায়াররা কি তাদের করা ভুল শুধরাতে পারেন না? এমন প্রশ্নে, একই হ্যান্ডবুকের ২.১১ এবং ২.১২ ধারায় বলা আছে, কোনো বিষয়ে মতভেদ কিংবা বাদানুবাদ হলে আম্পায়রদ্বয় সে ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন এবং একজন আম্পায়ার তার সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসতে পারেন যদি তিনি মনে করেন তার এই সিদ্ধান্তটি খুব তাড়াতাড়ি নেওয়া হয়েছে এবং তা ২.৬ ধারার বিরূদ্ধে যায় না। এগুলো ছাড়া, একজন আম্পায়ার যে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলবেন সেটিই চূড়ান্ত বলে গণ্য হবে।

অর্থাৎ, মাঠে আম্পায়ারদের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত এবং কোন দলের কাছে তা পক্ষপাতিত্বমূলক মনে হলে সেটা তারা ম্যাচ নিয়ন্ত্রক বা আইসিসিকে জানাতে পারে। কিন্তু এই ব্যাপারে তারা মামলা করার বিধান নেই।

মূলত, গত ২ নভেম্বর টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে গ্রুপ পর্বের ম্যাচে মুখোমুখি হয় বাংলাদেশ ও ভারত। সেই ম্যাচে ভারতের বিপক্ষে ব্যাট করার সময় অক্ষর প্যাটেলের বলে একটি ফেক ফিল্ডিং হয়েছিল বলে দাবি ছিল বাংলাদেশের। পরবর্তীতে আইসিসি সভার নির্ধারিত ফোরামে এ বিষয়ে বিসিবি অভিযোগ করেছে বলে খবর এসেছে গণমাধ্যমে। সামনে কোনো ইভেন্টে যেন এমন কোনো সিদ্ধান্তের মুখোমুখি না হতে হয়, সে ব্যাপারেও কথা হয়েছে। কিন্তু আইসিসির সভায় উক্ত অভিযোগ করার বিষয়টিকে “বিসিবি মামলা করেছে” হিসেবে প্রচার করা হচ্ছে।

প্রসঙ্গত, চলতি বছরের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ঘিরে একাধিক গুজব ছড়িয়ে পড়ার প্রেক্ষিতে প্রায় ১৪ টির অধিক ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার। 

সুতরাং, পক্ষপাতিত্বমূলক আম্পায়ারিং ইস্যুতে বিসিবির মামলা করার দাবিটি মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

 

আরও পড়ুন

spot_img