সম্প্রতি “ইন্না-লিল্লাহ, নিউজটা দেখে চমকে উঠলাম মোট ১২ টি দেশের মধ্যে শ্রীলংকার পরে ৮ নাম্বার স্থানেই বাংলাদেশ দেউলিয়া হতে চলেছে…. হে আল্লাহ আপনি আমাদের মাফ করুন” শীর্ষক শিরোনামে একটি তথ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।

ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে ও এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে, এখানে এখানে ও এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ১২ টি দেশের মধ্যে শ্রীলংকার পরে ৮ নাম্বার স্থানে বাংলাদেশ দেউলিয়া হয়ে যাওয়ার দাবিটি সঠিক নয় বরং দেশীয় মূলধারার গণমাধ্যম আরটিভিতে প্রচারিত একটি ভিডিও প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম রয়টার্স এর একটি পরিসংখ্যানকে অসম্পূর্ণ ও অস্পষ্টভাবে উপস্থাপনের প্রেক্ষিতে উক্ত তথ্যটি ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়েছে।
বিভ্রান্তির সূত্রপাত
কী-ওয়ার্ড অনুসন্ধানের মাধ্যমে চলতি মাসের ১৬ তারিখ বার্তা সংস্থা রয়টার্সের ওয়েবসাইটে “The big default? The dozen countries in the danger zone” শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, লেবানন, শ্রীলঙ্কা, রাশিয়া, সুরিনাম এবং জাম্বিয়া ইতিমধ্যেই দেউলিয়া। বেলারুশ দেউলিয়া হওয়ার দ্বারপ্রান্তে। এর বাইরে কমপক্ষে আরও ডজনখানেক দেশ ঝুঁকিতে রয়েছে। কারণ, ক্রমবর্ধমান ঋণের খরচ, মুদ্রাস্ফীতি এবং ঋণ সবই অর্থনৈতিক পতনের আশঙ্কা তৈরি করে।
এই ঝুঁকির তালিকায় প্রথমেই আছে আর্জেন্টিনা। দেশটির বৈদেশিক ঋণ প্রায় ১৫০ বিলিয়ন ডলার। তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় স্থানে আছে মিসর ও ইকুয়েডর। দেশ দুটির ঋণ যথাক্রমে ৪৫ বিলিয়ন ও ৪০ বিলিয়ন ডলার। তালিকায় থাকা অন্যান্য দেশগুলোর মধ্যে রয়েছে লেবানন, সুরিনাম, জাম্বিয়া, ইউক্রেন, তিউনিসিয়া, ঘানা, মোজাম্বিক, তাজিকিস্তান, কেনিয়া, ইথিওপিয়া, এল সালভাদর, পাকিস্তান, বেলারুশ ও নাইজেরিয়ার মতো দেশগুলো। এখানে কোথাও বাংলাদেশের নাম নেই।
প্রতিবেদনটিতে দেশগুলোর আর্থিক অবস্থা ও সংকটের ব্যাখ্যায় বেশ কিছু গ্রাফিকসের ব্যবহারও করা হয়।
যেমন, উন্নয়নশীল বিশ্বের রেকর্ড সংখ্যক দেশে অতিরিক্ত ঋণপত্রের ব্যবহার দেখাতে নিম্নের গ্রাফিক্সটি ব্যবহার করা হয়েছে। যেখানে দেখা যায়, ঝুঁকিতে থাকা প্রতিটি দেশে ঋণপত্রের ব্যবহার ১ হাজার ভিত্তি পয়েন্টের বেশি ছাড়িয়ে গেছে। এই গ্রাফিক্সে বাংলাদেশের নাম নেই।

মিশরের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতন দেখাতে এই গ্রাফিক্সটি ব্যবহার করা হয়েছে।

কেনিয়ার সরকারি ঋণপত্রের পতন দেখাতে এই গ্রাফিক্সটি ব্যবহার করা হয়েছে।

অনুরূপভাবে, কিছু দেশের রাজস্ব আদায়ের কতটুকু ঋণের সুদ দিতে ব্যয় করা হয় সেটা দেখাতে রয়টার্স তাদের প্রতিবেদনে নিম্নোক্ত গ্রাফিক্সটি ব্যবহার করে। যার মধ্যে বাংলাদেশের নামও রয়েছে। এ তালিকা থেকে জানা যায়, বাংলাদেশ রাজস্ব আদায়ের ২১ শতাংশ ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ব্যয় করে।

এদিকে গত ১৭ জুন বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল আরটিভি রয়টার্সের এই প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে “জেনে নিন বিশ্বের যে ১২ টি দেশ দেউলিয়া হতে পারে” (আর্কাইভ দেখুন: এখানে) শীর্ষক শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রচার করে।

প্রতিবেদনটিতে তারা বার্তা সংস্থা রয়টার্সকে উদ্ধৃত করে জানায়, “ক্রমবর্ধমান ঋণ ও মুদ্রাস্ফীতিতে জর্জরিত ডজনখানেক দেশ। যাদের পরিনতি অদূর ভবিষ্যতে শ্রীলঙ্কার মতো হতে পারে।
অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের করা গবেষণার ভিত্তিতে প্রকাশিত ঐ প্রতিবেদনে ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে ডেঞ্জার জোন হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ পাকিস্তান রয়েছে এই তালিকায়।”
প্রতিবেদনটিতে তারা রয়টার্সের কিছু গ্রাফিক্স ব্যবহার করে। এর মধ্যে কিছু দেশের রাজস্ব আদায়ের কতটুকু ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ব্যয় করা হয়, রয়টার্সের করা সেই গ্রাফিক্সটিও ব্যবহার করে।

কিন্তু প্রতিবেদনটিতে এর কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা গণমাধ্যমটি থেকে দেওয়া হয়নি। এছাড়া বাংলাদেশের নাম এখানে কেন রয়েছে সেটাও উল্লেখ করা হয়নি।
ফলে এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ১২ টি দেশের মধ্যে শ্রীলংকার পরে আট নাম্বারেই বাংলাদেশ দেউলিয়া হতে চলেছে- এমন একটি বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে।
এদিকে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি নিউজ আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল–আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে উদ্ধৃত করে জানিয়েছে, শ্রীলঙ্কা ছাড়াও এশিয়ার কয়েকটি দেশ শ্রীলঙ্কার মতক একই রকম সংকটে পড়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। এই দেশগুলোর মধ্যে রয়টার্সের প্রতিবেদনে উল্লেখিত পাকিস্তান ছাড়াও নাম রয়েছে লাওস, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশের।
ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভাকে উদ্ধৃত করে গণমাধ্যমটি আরও জানায়, বর্তমান পরিস্থিতিতে যেসব দেশের ঋণের পরিমাণ বেশি এবং নীতিনির্ধারণী সক্ষমতা কম সেসব দেশ অতিরিক্ত চাপের মুখে পড়বে।
অপরদিকে কানাডাভিত্তিক সংবাদ প্রতিষ্ঠান ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্ট বৈদেশিক ঋণখেলাপি হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে– এমন দেশের তালিকা প্রকাশ করেছে। এ তালিকা করতে ব্লুমবার্গের ডেটা ব্যবহার করেছে। যেখানে স্থানে বিশ্বের ২৫ দেশের নামের মধ্যেও বাংলাদেশের নাম পাওয়া যায়নি। যেখানে দক্ষিণ এশিয়া থেকে একমাত্র রয়েছে পাকিস্তানের নাম।

মূলত, বার্তা সংস্থা রয়টার্স গত ১৬ তারিখ বিশ্বের ডজনখানেক দেশের অর্থনৈতিকভাবে দেউলিয়া হওয়ার ঝুঁকির আশংকা নিয়ে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের নাম না থাকলেও তাদের প্রতিবেদনে ব্যবহার করা কিছু দেশের রাজস্ব আদায়ের কতটুকু ঋণের সুদ পরিশোধের জন্য ব্যয় করা হয় এমন একটি গ্রাফিক্সে বাংলাদেশের নাম পাওয়া যায়। পরবর্তীতে এই প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে দেশীয় গণমাধ্যম আরটিভি সংবাদ প্রচার করলেও সংবাদটিতে এর কোনো স্পষ্ট ব্যাখ্যা না থাকায় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভ্রান্তি ছড়িয়ে পড়ে।
সুতরাং, মোট ১২ টি দেশের মধ্যে শ্রীলংকার পরে ৮ নাম্বারেই বাংলাদেশ দেউলিয়ার পথে থাকার তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
Reuters.com: The big default? The dozen countries in the danger zone
Visualcapitatist.com: Countries with the Highest Default Risk in 2022
BBC News: Sri Lanka crisis is a warning to other Asian nations