ক্ষমতাধর দেশের তালিকায় বাংলাদেশের অবস্থান নিয়ে ভুয়া প্রচারণায় সয়লাব ইন্টারনেট

সম্প্রতি, অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ৮ মাসে চমক দেখিয়ে ১২৩তম স্থান থেকে ৪৭তম ক্ষমতাধর দেশে পরিণত করেছে বাংলাদেশকে – এমন একটি দাবি ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।

এমন দাবির ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানেএখানেএখানেএখানেএখানেএখানে।

একই দাবিতে গণমাধ্যমের প্রতিবেদন দেখুন ইনকিলাববাংলাদেশ প্রতিদিন (ইউটিউব), বাংলাভিশন (ফেসবুক), জুমবাংলা 

থ্রেডসে প্রচারিত দাবি দেখুন এখানে।

ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে

টিকটকে প্রচারিত দাবি দেখুন: এখানে

এক্সে (সাবেক টুইটার) প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে।

এছাড়া সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কিছু পোস্টে পাল্টা দাবি হিসেবে বলা হচ্ছে, র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ আগে ৪০তম অবস্থানে ছিল, ৮ মাসে পিছিয়ে এখন ৪৭তম হয়েছে।

উক্ত দাবির ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানেএখানে, এখানে।  

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, অন্তর্বর্তী সরকার মাত্র ৮ মাসে বাংলাদেশকে ৪৭তম ক্ষমতাধর রাষ্ট্রে পরিণত করেছে এবং র‍্যাঙ্কিংটিতে বাংলাদেশ আগে ৪০তম ছিল, ৮ মাসে পিছিয়ে এখন ৪৭তম হয়েছে শীর্ষক দাবিগুলো সঠিক নয় বরং ২০২৪ সালের ২২ মার্চ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের সময়ে হওয়া জরিপের ওপর ভিত্তি করে এই তালিকাটি গত বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হয়। এই তালিকার সাথে তাই বর্তমান অন্তর্বতীকালীন সরকারের কার্যক্রমের কোনো সম্পর্ক নেই।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, দাবিগুলোর সূত্র হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে ইউএস নিউজ (US NEWS) নামে একটি ওয়েবসাইটের নাম। কিওয়ার্ড সার্চ করে দেখা যায়, ইউএস নিউজ মূলত মার্কিন মিডিয়া কোম্পানি যারা সংবাদের পাশাপাশি গেল কয়েক বছর ধরে নিয়মিত বিভিন্ন ক্যাটাগরির র‍্যাঙ্কিং ও বিশ্লেষণ প্রকাশ করে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে যে র‍্যাঙ্কিং নিয়ে আলোচনা হচ্ছে তাতে দেখা যাচ্ছে, ৮৯টি দেশের মধ্যে সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম। এছাড়া দেশের বিভিন্ন ক্যাটাগরিভিত্তিক র‍্যাঙ্কিংও আছে। যেমন, ক্ষমতা বা পাওয়ারের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান দেখাচ্ছে ৪৭তম।  

রিউমর স্ক্যানার যাচাই করে দেখেছে, এই তালিকাটি সম্প্রতি বা এ বছর প্রকাশ হয়নি। তালিকাটি প্রকাশিত হয়েছে ২০২৪ সালের ১০ সেপ্টেম্বর। মূলত জরিপের তথ্য ব্যবহার করে এই র‍্যাঙ্কিং প্রকাশিত হয়। এই র‍্যাঙ্কিংয়ের জরিপ হয়েছে ২০২৪ সালের ২২ মার্চ থেকে ২৩ মে পর্যন্ত।

অর্থাৎ, সর্বশেষ যে র‍্যাঙ্কিং ইউএস নিউজের ওয়েবসাইটে রয়েছে তা বাংলাদেশের বিগত আওয়ামী লীগের সরকারের সময়ে হওয়া জরিপের ওপর ভিত্তি করে প্রকাশিত হয়েছিল।

রিউমর স্ক্যানার ইউএস নিউজের ওয়েবসাইটের বিভিন্ন সময়ের আর্কাইভ বিশ্লেষণ করে দেখেছে, সাইটটি প্রতি বছরের সেপ্টেম্বরে এই র‍্যাঙ্কিং প্রকাশ করে থাকে এবং এ সংক্রান্ত জরিপ হয় সে বছরের এপ্রিল থেকে জুলাইয়ের মধ্যে।

যেমন, ২০২৩ সালেরটি প্রকাশিত হয় সে বছরের ০৬ সেপ্টেম্বর (জরিপ হয় সে বছরের ১৭ মার্চ থেকে ১২ জুন)। ৮৭ দেশকে নিয়ে করা এই জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ক্ষমতাধর ক্যাটাগরিতে ৪০তম। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৬৯তম।

একইভাবে, ২০২২ সালেরটি প্রকাশিত হয় সে বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর (জরিপ হয় সে বছরের ৩০ এপ্রিল থেকে ১৩ জুলাই)। ৮৫ দেশকে নিয়ে করা এই জরিপে বাংলাদেশের অবস্থান ক্ষমতাধর ক্যাটাগরিতে ৪৪তম, সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশের অবস্থান ৭১তম।

এসব তথ্য বিশ্লেষণ থেকে এটা নিশ্চিত যে, ২০২৫ সালের র‍্যাঙ্কিং এখনও প্রকাশ করেনি ইউএস নিউজ। রেওয়াজ অনুযায়ী তা চলতি বছরের সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত হবে।

দাবি অনুযায়ী, বাংলাদেশ ১২৩তম স্থান থেকে উন্নীত হয়ে বর্তমানে ৪৭তম অবস্থানে এসেছে বলে বলা হলেও ওয়েবসাইটটির আর্কাইভ বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার দেখতে পায়, বাংলাদেশ এই র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রথম অন্তর্ভুক্ত হয় ২০২২ সালে। ওই বছর থেকে পরবর্তী সময়গুলোতে র‍্যাঙ্কিংয়ে অন্তর্ভুক্ত দেশের সংখ্যা ছিল যথাক্রমে: ২০২২ সালে ৮৫টি, ২০২৩ সালে ৮৭টি এবং ২০২৪ সালে ৮৯টি। এ পর্যন্ত কোনো বছরেই র‍্যাঙ্কিংয়ে ১২৩টি দেশ অন্তর্ভুক্ত ছিল না, ফলে বাংলাদেশের কখনো ১২৩তম অবস্থানে থাকার দাবি বাস্তবসম্মত নয়।

২০২৪ সালের সেপ্টেম্বরের এই র‍্যাঙ্কিং নিয়ে হঠাত আলোচনা শুরুর প্রেক্ষাপটও জানার চেষ্টা করেছে রিউমর স্ক্যানার। গত ১০ ফেব্রুয়ারি Asian SEA Story নামে একটি ফেসবুক পেজ থেকে ইউএস নিউজকে সূত্র দেখিয়ে শিরোনামে ২০২৫ সালের র‍্যাঙ্কিং দাবি করে এ সংক্রান্ত প্রথম পোস্টটি করা হয় বলে প্রতীয়মান হয়। এরপর Global Statistics নামের একটি এক্স অ্যাকাউন্ট থেকে গত ০৬ এপ্রিল রাতে একই পোস্ট করা পরই বিষয়টি আলোচনায় আসে।

এছাড়া, ৮ মাসে বাংলাদেশ ৪০তম থেকে ৪৭তম অবস্থানে চলে গেছে শীর্ষক দাবিটির বিষয়ে অনুসন্ধান করে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, দাবিটির সূত্রপাত Ceoworld Magazine নামের একটি ওয়েবসাইটে প্রকাশিত তালিকা। ২০২৪ সালের ০৪ এপ্রিল প্রকাশিত এই তালিকায় দেখা যায়, ১৪২টি ক্ষমতাধর দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ৪০তম।

অর্থাৎ, বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলেই এই তালিকাটি প্রকাশিত হয়। এই তালিকার সাথে ভিন্ন আরেকটি ওয়েবসাইটের ৪৭তম অবস্থানের তুলনা করে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে।  

সুতরাং, অন্তবর্তী সরকারের ৮ মাসে ৪৭তম হওয়া কিংবা ৮ মাসে ৭ পিছিয়ে ৪৭তম হওয়া সংক্রান্ত দুটো দাবিই ভুয়া।

তথ্যসূত্র 

আরও পড়ুন

spot_img