গত ২৭ সেপ্টেম্বর দুপুরে ঢাকার কাকরাইলে অবস্থিত ইনস্টিটিউট অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স, বাংলাদেশ (আইডিইবি) ভবনে ফোরাম অব ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার্স বাংলাদেশ (এফডিইবি)-এর বার্ষিক কাউন্সিল অধিবেশনে প্রধান অতিথি হিসেবে ভাষণ দেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান। ভাষণে তিনি বলেন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী যদি ভবিষ্যতে ক্ষমতায় আসার সুযোগ পায় তাহলে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থার সংস্কার, সমাজে মর্যাদা নির্ধারণের মানদণ্ড পরিবর্তন ও দুর্নীতি রুখে দেওয়া হবে। বক্তব্যের এক পর্যায়ে জামায়াতের আমির ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিজ্ঞানী ড. এপিজে আব্দুল কালামের প্রসঙ্গ টেনে দাবি করেন, ‘পাশের দেশ, ড. আব্দুল কালাম, তাদের নিউক্লিয়ার সায়েন্টিস্ট। তিনি কি মাস্টার্স ডিগ্রি ছিলেন নাকি? গ্র্যাজুয়েট ছিলেন? ইন্টারমিডিয়েট ছিলেন? হাইস্কুল পাশ করেছেন? কিছুই না। কিন্তু পরবর্তী পর্যায়ে অনেক কিছুই হয়েছে তার। সেই জাতি তো তাকে সম্মান দিয়েছে। কী জন্যে? তার কন্ট্রিবিউশানের জন্যে। তার কাজের জন্য।’
অর্থাৎ, দাবি করা হয় ড. এপিজে আব্দুল কালামের কোনো ডিগ্রি ছিল না, এমনকি হাইস্কুলও পাশ করেননি তিনি।
গণমাধ্যমে প্রচারিত এরূপ দাবি সম্বলিত জামায়াতের আমির ডা. শফিকুর রহমানের ভাষণ দেখুন এখানে, এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বিজ্ঞানী ড. এপিজে আব্দুল কালামের কোনো ডিগ্রি ছিল না, এমনকি হাইস্কুলও পাশ করেননি শীর্ষক দাবি সঠিক নয়। প্রকৃতপক্ষে, তিনি উচ্চমাধ্যমিক পাশ করে সেন্ট জোসেফ কলেজ থেকে স্নাতক করেছিলেন এবং মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি থেকে অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে ডিগ্রি অর্জন করেছিলেন।
এ বিষয়ে অনুসন্ধানে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘নিউজ১৮’ এর ওয়েবসাইটে ২০২২ সালের ১৫ অক্টোবরে ড. এপিজে আব্দুল কালামের বিষয়ে একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘বিদ্যালয় জীবনে কালামের ফলাফল ছিল গড়পড়তা, তবে তাকে একজন মেধাবী ও পরিশ্রমী শিক্ষার্থী হিসেবে বর্ণনা করা হয়, যার শেখার প্রতি প্রবল আগ্রহ ছিল। তিনি পড়াশোনায়, বিশেষ করে গণিতে, দীর্ঘ সময় ব্যয় করতেন। তিনি রামনাথপুরমের শোয়ার্টজ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল থেকে তার স্কুলজীবন সম্পন্ন করেন। স্কুল শেষ করার পর, কালাম তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফস কলেজে ভর্তি হন। সেন্ট জোসেফস কলেজ থেকে তিনি ১৯৫৪ সালে পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৫৫ সালে তিনি অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়নের জন্য মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে ভর্তি হন।
১৯৬০ সালে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি থেকে স্নাতক সম্পন্ন করার পর, কালাম ডিফেন্স রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশনের (DRDO) অ্যারোনটিক্যাল ডেভেলপমেন্ট এস্টাবলিশমেন্টে একজন বিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেন, DRDS-এর সদস্য হওয়ার পর। ১৯৬৯ সালে কালামকে ভারতীয় মহাকাশ গবেষণা সংস্থা (ISRO)-তে স্থানান্তর করা হয়, যেখানে তিনি ভারতের প্রথম স্যাটেলাইট লঞ্চ ভেহিকলের প্রকল্প পরিচালক হিসেবে কাজ করেন।’ (অনূদিত)
অনুসন্ধানে ভারত সরকারের প্রেস ইনফরমেশন ব্যুরোর আর্কাইভে ২০১০ সালের ৮ জুন প্রকাশিত এপিজে আব্দুল কালামের একটি বায়োডাটা পাওয়া যায়। তাতে বলা হয়, ‘তিরুচিরাপল্লির সেন্ট জোসেফস কলেজ থেকে স্নাতক ডিগ্রি অর্জনের পর আব্দুল কালাম পরবর্তীতে মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়ন করেন, যা পঞ্চাশের দশকে দক্ষিণ ভারতের প্রযুক্তিগত শিক্ষার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিত ছিল। অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে স্নাতক সম্পন্ন করার পর, আব্দুল কালাম প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের টেকনিক্যাল ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড প্রোডাকশন অধিদপ্তরে যোগ দেন।’ (অনূদিত)
এছাড়াও, অনুসন্ধানে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘ইন্ডিয়া টুডে’র ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের ১৫ অক্টোবর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ড. এপিজে আব্দুল কালাম তার বই ‘মাই জার্নি: ট্রান্সফর্মিং ড্রিমস ইনটু অ্যাকশনস’ এ উল্লেখ করেন, কালামের স্বপ্ন ছিল ফাইটার পাইলট হওয়া। কিন্তু একটুর জন্য তা হতে পারেননি তিনি। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ‘মাদ্রাজ ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (MIT) থেকে অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে স্নাতক সম্পন্ন করার আগেই কালাম ভারতীয় বিমানবাহিনীতে (IAF) যোগ দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা পোষণ করতেন। যদিও তিনি বিমানবাহিনীতে যোগ দিতে ব্যর্থ হন, তবুও আকাশের প্রতি তার আকর্ষণ তিনি হারাননি এবং অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং অধ্যয়নের পথ বেছে নেন।’
অনুসন্ধানে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘দ্য হিন্দু’ এ এপিজে আব্দুল কালামকে নিয়ে ২০০৬ সালের ২৪ সেপ্টেম্বরে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনের আর্কাইভ পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, সেসময় তিনি তিরুচির সেন্ট জোসেফ’স কলেজের একজন শিক্ষকের সাথে দেখা করেন যার কাছে তিনি ১৯৫০ থেকে ১৯৫৪ এর মধ্যবর্তী সময়ে পদার্থবিজ্ঞান পড়েছিলেন।
এছাড়াও, ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘টাইমস অফ ইন্ডিয়া’র ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের ১৮ মার্চ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে বলা হয়, ‘রমনাথপুরম জেলার ২০০ বছরেরও বেশি পুরনো প্রতিষ্ঠান শোয়ার্টজ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল, যেখানে ভারতের প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ড. এ.পি.জে. আব্দুল কালাম পড়াশোনা করেছিলেন, এখন কোয়েম্বাটুরভিত্তিক এক অলাভজনক সংস্থার সহায়তায় পুনর্নির্মাণের/সংস্কারের পথে।’ (অনূদিত)
এ থেকে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ড. এপিজে আব্দুল কালাম উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা লাভ করেছেন এবং পরবর্তীতে পদার্থবিজ্ঞান ও অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং এ ডিগ্রীও অর্জন করেছেন।
সুতরাং, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান কর্তৃক দাবিকৃত ড. এপিজে আব্দুল কালামের কোনো ডিগ্রি ছিল না, এমনকি হাইস্কুলও পাশ করেননি শীর্ষক দাবি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- News18 – Celebrity Education Qualification: Dr APJ Abdul Kalam is a Physics Graduate, Had Average Grades in School
- PIB, Government of India – BIO-DATA : AVUL PAKIR JAINULABDEEN ABDUL KALAM
- India Today – APJ Abdul Kalam: The scientist who missed pilot’s seat, but sent India to the stars
- The Hindu – Kalam meets the teacher who moulded him
- Times of India – Kalam’s alma mater in Ramnad set for renovation
- Rumor Scanner’s analysis