সম্প্রতি কতিপয় ফেসবুক পোস্টে “প্রায় ৩৯ হাজার কোটি বৃক্ষের আমাজন রেইনফরেস্ট পৃথিবীর ২০ শতাংশ অক্সিজেন উৎপাদন করে।” শীর্ষক একটি দাবি প্রচারিত হয়েছে। পোস্টগুলোতে পৃথিবীর বেশিরভাগ অক্সিজেন গাছ থেকে আসে না বিষয়টি খণ্ডন করতে গিয়ে ‘আমাজন পৃথিবীর অক্সিজেনের ২০% উৎপাদন করে’ শীর্ষক বিষয়ের উল্লেখ করা হয়।

ফেসবুক প্রচারিত এ দাবির কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আমাজন পৃথিবীর অক্সিজেনের ২০% উৎপাদন করে শীর্ষক দাবিটি সঠিক নয় বরং এটি দীর্ঘদিন ধরে চলে আসা একটি মিথ।
অনুসন্ধানে ২০১৯ সালের ২৮ আগস্ট ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ওয়েবসাইটে “Why the Amazon doesn’t really produce 20% of the world’s oxygen” শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে লেখা হয়,
“গত সপ্তাহে আমাজনে দাবানলের খবর সারাবিশ্বে ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে রেইনফরেস্টের গুরুত্ব সম্পর্কে একটি বিভ্রান্তিকর দাবি বারবার প্রচার হচ্ছে যে এটি বিশ্বের অক্সিজেনের ২০ শতাংশ উৎপাদন করে। বিশ্বের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি এবং গণমাধ্যমও এ দাবিটি করেছে এবং অনেকে আমাজন কে ‘পৃথিবীর ফুসফুস’ হিসেবে সম্বোধন করেছে। তবে “পৃথিবীর ফুসফুস” উপাধি দেওয়ার বিষয়টি অত্যন্ত অতিরঞ্জিত। সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কয়েকজন বিজ্ঞানী উল্লেখ করেছেন, আমরা শ্বাসের সাথে যে অক্সিজেন নিই তাতে অ্যামাজনের নেট অবদান সম্ভবত শূন্যের কাছাকাছি।
ম্যাসাচুসেটসের উডস হোল রিসার্চ সেন্টারে অ্যামাজন প্রোগ্রাম পরিচালনাকারী আর্থ সিস্টেম বিজ্ঞানী মাইকেল কো মন্তব্য করেছেন, “আপনি কেন অ্যামাজনকে জায়গায়(ঠিক) রাখতে চান তার অনেকগুলি কারণ রয়েছে, কেবল অক্সিজেন তাদের মধ্যে একটি নয়।”
Coe জানান, তার কাছে ঐ দাবিটি কোন ফিজিক্যাল সেন্স তৈরি করে না, কারণ গাছের জন্য গ্রহের অক্সিজেনের সম্পূর্ণ পঞ্চমাংশে সালোকসংশ্লেষণ করার জন্য বায়ুমণ্ডলে পর্যাপ্ত কার্বন ডাই অক্সাইড নেই।
চিন্তা করুন, গাছপালা বাতাস থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড গ্রহণ করে, তার প্রতিটি অণুর জন্য তারা প্রায় একই রকম সংখ্যক অক্সিজেন অণুও বাতাসে ছড়িয়ে দেয়। এখন বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইডের পরিমাণ ০.৫ শতাংশেরও কম, অপরদিকে অক্সিজেনের পরিমাণ ২১ শতাংশ হলে অ্যামাজন রেইনফরেস্টের পক্ষে এতো বেশি অক্সিজেন উৎপাদন করা সম্ভব নয়।
কয়েকজন বিজ্ঞানী আরও নির্ভরযোগ্য অনুমান দিয়েছেন। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ পরিবর্তন ইনস্টিটিউটের একজন পরিবেশবিদ্যাবিদ যাদবিন্দর মালহি তার গণনাটি ২০১০ সালের একটি গবেষণার উপর ভিত্তি করে করেছেন, যা অনুমান করে যে স্থলভাগে ঘটে যাওয়া সকল সালোকসংশ্লেষণের প্রায় ৩৪ শতাংশের জন্য ক্রান্তীয় অরণ্য দায়ী। এর আকারের ভিত্তিতে, আমাজন এর প্রায় অর্ধেকের জন্য দায়ী হবে। এর মানে হল যে আমাজন স্থলভাগে উৎপাদিত অক্সিজেনের প্রায় ১৬ শতাংশ উৎপাদন করে, মালহি তার একটি সাম্প্রতিক ব্লগ পোস্টে বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করেছেন। সমুদ্রে ফাইটোপ্ল্যাংকটন দ্বারা উৎপাদিত অক্সিজেনকে বিবেচনায় নেওয়ার সময় এই শতাংশটি ৯ শতাংশে নেমে আসে।
কিন্তু এটিই পুরো গল্প নয়। গাছগুলো শুধু অক্সিজেন ছাড়ে না বরং তারা সেলুলার শ্বসন নামক প্রক্রিয়ায় তা গ্রহণও করে, যেখানে তারা দিনের বেলায় সংগৃহীত শর্করাকে শক্তিতে রূপান্তর করে। এই প্রক্রিয়াকে ক্ষমতায়িত করতে অক্সিজেন ব্যবহার করে। সুতরাং রাতের বেলা যখন সালোকসংশ্লেষণের জন্য সূর্য থাকে না, তখন তারা অক্সিজেনের নেট শোষক হয়। মালহির গবেষণা দল ধারণা করে যে গাছগুলি এইভাবে উৎপাদিত অক্সিজেনের অর্ধেকেরও বেশি নিজেরাই ব্যবহার করে। বাকি অংশ সম্ভবত অ্যামাজনে বসবাসকারী অসংখ্য অণুজীব দ্বারা ব্যবহৃত হয়।
কলোরাডো স্টেট ইউনিভার্সিটির বায়ুমণ্ডলীয় বিজ্ঞানী স্কট ডেনিং ব্যখ্যা করেন, “আমাজন বা অন্য যে কোন জীবব্যবস্থার নেট অক্সিজেনের প্রভাব আসলে প্রায় শূন্য। কারণ অক্সিজেন উৎপাদন এবং ভোগের মধ্যে এই ভারসাম্যের কারণে আধুনিক বাস্তুতন্ত্রগুলি বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের মাত্রা খুব একটা পরিবর্তন করে না। বরং আমরা যে অক্সিজেন শ্বাস নিই, তা হলো সমুদ্রের ফাইটোপ্ল্যাংকটনের উত্তরাধিকার, যা বিলিয়ন বছর ধরে ধীরে ধীরে অক্সিজেন জমা করে এসেছে এবং বায়ুমণ্ডলকে শ্বাসযোগ্য করে তুলেছে।”
২০ শতাংশের এই ভ্রান্ত ধারণাটি কয়েক দশক ধরেই চলছে, যদিও এটি কোথায় থেকে উদ্ভূত হয়েছে তা অস্পষ্ট। মালহি এবং কো বলেছেন, এটি এমন ধারণা থেকে উদ্ভূত হয়েছে যে, আমাজন বনভূমি স্থলে সালোকসংশ্লেষণের মাধ্যমে উৎপাদিত অক্সিজেনের প্রায় ২০ শতাংশ সরবরাহ করে। এই সংখ্যাটি ভুলভাবে জনসাধারণের জ্ঞানে ‘বায়ুমণ্ডলে অক্সিজেনের ২০ শতাংশ’ হিসাবে প্রবেশ করে থাকতে পারে।
আমাজন আমাদের অক্সিজেনের ২০ শতাংশ দেয় না এর অর্থ এই নয় যে আমাজন গুরুত্বপূর্ণ নয়। অবশ্যই এটা নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ।”
২০১৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান FactCheck.org এবং AP যথাক্রমে Amazon Doesn’t Produce 20% of Earth’s Oxygen এবং Take a breath: the Amazon does not produce 20% of the world’s oxygen শিরোনামে ‘আমাজন পৃথিবীর অক্সিজেনের ২০% উৎপাদন করার দাবিটিকে মিথ্যা চিহ্নিত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করে।
মূলত, আমাজন পৃথিবীর অক্সিজেনের ২০% উৎপাদন করে দাবিটি একটি মিথ, যা কয়েক দশক ধরে প্রচারিত হয়ে আসছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন যে আমাজন বিশ্বের বাস্তুতন্ত্রের জন্য গুরুত্বপূর্ণ, তবে এটি বিশ্বের অক্সিজেনের ২০% উৎপাদন করে না। প্রকৃতপক্ষে, এটি যতটা অক্সিজেন তৈরি করে তার প্রায় একই পরিমাণ অক্সিজেন নিজের ব্যবহারের জন্য শোষণ করে। তাই আমরা শ্বাসের সাথে যে অক্সিজেন নিই তাতে অ্যামাজনের নেট অবদান প্রায় শূন্যের কাছাকাছি।
সুতরাং, অ্যামাজন পৃথিবীর ২০% অক্সিজেন উৎপাদন করে শীর্ষক দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- National Geographic – Why the Amazon doesn’t really produce 20% of the world’s oxygen by
- FactCheck.org – Amazon Doesn’t Produce 20% of Earth’s Oxygen by
- AP – Take a breath: the Amazon does not produce 20% of the world’s oxygen by