দীর্ঘদিন ধরে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়াকে উদ্ধৃত করে ‘জামায়াতে ইসলাম এরা হলো বেইমান মুনাফেক’ শীর্ষক একটি বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে।

সম্প্রতি ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।
২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ) এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
২০২১ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)
২০২০ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ইউটিউবে প্রচারিত এমন একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

টিকটকে প্রচারিত এমন একটি ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বাংলাদেশের ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক দল জামায়াতে ইসলামীকে বিএনপি চেয়ারপারসন ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া কর্তৃক বেইমান মুনাফেক বলার দাবিতে প্রচারিত ভিডিওর বক্তব্যটি এডিটেড। প্রকৃতপক্ষে ২০১৪ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি জনসভায় দেওয়া খালেদা জিয়ার বক্তব্যকে সম্পাদনা বা বিকৃত করে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।
দাবিটি নিয়ে অনুসন্ধানের শুরুতেই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওগুলোর সূত্রে জানা যায়, বিএনপি নেত্রী ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার বক্তব্য প্রদানের উক্ত সমাবেশটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল।

এই তথ্যের সূত্রে কি-ওয়ার্ড অনুসন্ধানে জাতীয় দৈনিক প্রথম আলোতে ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছেছেন খালেদা জিয়া‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগাম নির্বাচনের দাবিতে এবং গুম-খুন-নির্যাতন, জাতীয় সম্প্রচার নীতিমালা ও বিচারপতিদের অভিশংসনের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফিরিয়ে দেওয়ার প্রতিবাদে ২০-দলীয় জোট উদ্যোগে আয়োজিত সমাবেশে যোগ দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া।
পরবর্তীতে এই প্রতিবেদনের সূত্রে অনুসন্ধানে ফেসবুকে ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর দৈনিক বিএনপি’র সংবাদপত্র নামের একটি ফেসবুক পেইজে ‘আওয়ামী লীগ মুনাফেক-বেঈমান : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খালেদা‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি পোস্ট খুঁজে পাওয়া যায়।

পোস্টটিতে উল্লেখ করা হয়, ‘বর্তমান সরকার অবৈধ মন্তব্য করে বিএনপি চেয়ারপার্সন ও ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া বলেছেন, আওয়ামী লীগ হলো মুনাফেক, বেইমান। তিনি বলেন, এদের কাছে দেশ ও দেশের মানুষের চেয়ে টাকা বড়। তাই দেশ রক্ষায় এদের বিরুদ্ধে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহবান জানান তিনি।
আজ মঙ্গলবার ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ মুহম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ২০ দলীয় জোট আয়োজিত জনসভায় তিনি এসব কথা বলেন। বিকেল ৫ টা ১৬ মিনিটে তিনি বক্তব্য শুরু করে সন্ধ্যা প্রায় ৬ টার দিকে বক্তব্য শেষ করেন।’
একইদিনে একই শিরোনামে প্রকাশিত ফেসবুকে আরও কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে।

এসব পোস্ট ব্যতীত সেই সময় বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া জামায়াতেইসলামীকে ‘মুনাফেক-বেইমান’ আখ্যায়িত করেছেন এমন কোনো তথ্য গণমাধ্যম বা নির্ভরযোগ্য কোনো সূত্রে খুঁজে পাওয়া যায় না। বরং অনুসন্ধানে দেখা যায়, খালেদা জিয়ার অংশগ্রহণে ২০ দলীয় জোট আয়োজিত ঐ জনসভায় জামায়াতের নায়েবে আমীর অধ্যাপক মুজিবুর রহমানও বক্তব্য দিয়েছিলেন।

ঐদিনের সমাবেশে জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে কি বলেছিলেন খালেদা জিয়া?
জামায়াতে ইসলামীকে খালেদা জিয়া ‘মুনাফেক-বেইমান’ বলেছেন কি না এমন তথ্য অনুসন্ধানে অনলাইন নিউজ পোর্টাল বাংলানিউজ২৪ এ ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ‘জেলে ভয় পাই না, তবে পরের বিষয়টি ভেবে দেখবেন‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়।

প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নিয়াজ মোহাম্মদ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠে ২০ দলীয় জোট আয়োজিত জনসভায় পৌনে এক ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্য রাখেন বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া।
বক্তব্যের এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগের হাতে কোনো ধর্মই নিরাপদ নয় উল্লেখ করে খালেদা জিয়া বলেন, ‘সময় আসবে তখন ভুলে যাবেন না। এদের হাতে আপনাদের রক্ত। শুধু আলেম বা মুসলমান না, কোনো মানুষই নিরাপদ না। চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মূর্তি ভেঙে দিয়েছে। সারা দেশে হিন্দুদের মন্দির ভেঙে দিয়েছে। এ কারণে এ সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের কোনো আস্থা নেই। এরা বেঈমান, মুনাফেক। এদের কাছে টাকা আর ক্ষমতাই বড়।‘

বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধ ইস্যুতে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিএনপির সঙ্গে আছে বলে এখন জামায়াতে ইসলাম খারাপ, স্বাধীনতা বিরোধী। কিন্তু এই জামায়াতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল। তখন তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ছিল।

অর্থাৎ খালেদা জিয়া আওয়ামী লীগ ও জামায়াতে ইসলামীকে নিয়ে আলাদা আলাদা বক্তব্য দেন এবং আওয়ামী লীগ নিয়ে বক্তব্যের অংশে দলটিকে ‘বেঈমান, মুনাফেক।’ হিসেবে উল্লেখ করেন। অপরদিকে জামায়াতে ইসলামী সম্পর্কে বলেন, জামায়েত ইসলাম যখন আওয়ামী লীগের সাথে ছিল তখন তারা স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি ছিল, এখন বিএনপির সঙ্গে আছে বলে এখন জামায়াতে ইসলাম খারাপ, স্বাধীনতা বিরোধী।
পরবর্তীতে খালেদা জিয়ার বক্তব্যটি অধিকতর অনুসন্ধানে রিউমর স্ক্যানার টিম সেদিনের বক্তব্যটির ভিডিও সংস্করণ খুঁজে।
অনুসন্ধানে Shahjalal Saju নামের একটি ইউটিউব চ্যানেলে ২০২২ সালের ২৮ জুন ‘পিলখানা হত্যাকাণ্ড সহ আওয়ামী লীগের কুকর্ম নিয়ে খালেদা জিয়ার ঐতিহাসিক ভাষণ (আর্কাইভ)’ শীর্ষক শিরোনামে প্রচারিত প্রায় ২২ মিনিটের একটি ভিডিও খুঁজে পাওয়া যায়।

এই ভিডিওটির সঙ্গে খালেদা জিয়া কর্তৃক জামায়াতে ইসলামকে ‘বেইমান মুনাফেক’ আখ্যায়িত করার দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটির মিল খুঁজে পাওয়া যায়।

এই ভিডিওটির ৪ মিনিট ৫৭ সেকেন্ড সময়কালে খালেদা জিয়া বলেন, ‘এই সরকারের হাতে কোনো ধর্মের মানুষ নিরাপদ নয়। আপনারা দেখেছেন না, পার্বত্য চট্টগ্রামে বৌদ্ধ মন্দিরগুলোতে কি অবস্থা করেছে! সারা দেশে হিন্দুদের মন্দির ভেঙে দিয়েছে। এ কারণে এ সরকারের ওপর সাধারণ মানুষের কোনো আস্থা নেই। এরা বেঈমান, মুনাফেক। এদের কাছে টাকা আর ক্ষমতাই বড়।’
একই বক্তব্যের ৮ মিনিট ৩৪ সেকেন্ডে খালেদা জিয়া বলেন, ‘জামায়াতে ইসলামকে বলে…জামায়াতে ইসলাম বিএনপির সঙ্গে আছে, এখন তাই জামায়াতে ইসলামকে নানা অপবাদ দেওয়া হয়। জামায়াত ইসলাম খারাপ, জামায়াতে ইসলামীকে কখনো জঙ্গী বানায়, কখনো স্বাধীনতা বিরোধী, যা ইচ্ছা তাই বলে। কিন্তু জামায়াতে ইসলাম যখন আওয়ামী লীগের সাথে ছিল তখন তারা ছিল আওয়ামী লীগের বন্ধু, স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি।’
অর্থাৎ, রিউমর স্ক্যানার টিমের সার্বিক অনুসন্ধানে প্রতীয়মান হয় যে, জামায়াতে ইসলামীকে খালেদা জিয়া ‘মুনাফেক-বেইমান’ বলেছেন দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খালেদা জিয়ার দেওয়া একটি দীর্ঘ বক্তব্যের দুইটি খন্ডিত অংশ জোড়া দিয়ে তৈরী করা।
মূলত, ২০১৪ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ২০-দলীয় জোট উদ্যোগে আয়োজিত এক সমাবেশে যোগ দিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় যান বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সেই সমাবেশে আওয়ামী লীগ সরকারের সমালোচনা সহ নানা বিষয় তুলে ধরে পৌনে এক ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্য রাখেন তিনি। এই সময়ে বক্তব্য প্রসঙ্গে তিনি জামায়াত ইসলামী নিয়েও কথা বলেন৷ রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, তার দীর্ঘ পৌনে এই এক ঘণ্টার বক্তব্য থেকেই আলাদা আলাদা আলোচনার দুইটি অংশ কেটে জোড়া দিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে যে, জামায়াতে ইসলামীকে খালেদা জিয়া ‘মুনাফেক-বেইমান’ বলেছেন।
সুতরাং, বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ২০১৪ সালের দীর্ঘ একটি বক্তব্য থেকে আলাদা আলাদা দুইটি অংশ কেটে নিয়ে তিনি জামায়াতে ইসলামীকে বেইমান বলেছেন-মুনাফেক দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে; যা সম্পূর্ণ এডিটেড বা বিকৃত।
তথ্যসূত্র
- দৈনিক বিএনপি’র সংবাদপত্র ফেসবুক পোস্ট: আওয়ামী লীগ মুনাফেক-বেঈমান : ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় খালেদা
- Daily Prothom Alo: ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় পৌঁছেছেন খালেদা জিয়া
- Banglanews24: জেলে ভয় পাই না, তবে পরের বিষয়টি ভেবে দেখবেন
- Shahjalal Saju_Youtube: পিলখানা হত্যাকাণ্ড সহ আওয়ামী লীগের কুকর্ম নিয়ে খালেদা জিয়ার ঐতিহাসিক ভাষণ (আর্কাইভ)