নির্বাচন প্রসঙ্গে সেনাবাহিনী ও শিবিরকে জড়িয়ে ড. কামাল হোসেনের নামে ভুয়া মন্তব্য প্রচার 

দীর্ঘদিন ধরে ‘সেনাবাহিনীকে ভয় করলে শিবিরকে দিন।‘ শীর্ষক শিরোনামে ড. কামাল হোসেনের নামে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে একটি বক্তব্য প্রচার করা হচ্ছে।

২০১৮ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে

২০২০ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে৷ আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে

 ২০২২ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে৷ আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে

২০২৩ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে
আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে

এসব পোস্টে ড. কামাল হোসেনের নামে যা প্রচার করা হচ্ছে-

‘সেনাবাহিনীকে ভয় করলে শিবিরকে দিন নির্বাচন কমিশনকে একটা পরামর্শ দিতে পারি, নির্বাচনে সেনাবহিনীকে মোতায়েন করলে যদি আপনাদের ভয় লাগে, তাহলে নির্বাচন সুষ্ঠু করার জন্য ইসলামী ছাত্র শিবির মোতায়েন করেন। দেখবেন নির্বাচন সুষ্ঠু গ্রহনযোগ্য হয়েছে, কারণ এদের কাছে সেনাবাহিনীর ট্রেনিং না থাকতে পারে, ইসলামি আদর্শের ট্রেনিং আছে।’

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, নির্বাচন সুষ্ঠু করতে নির্বাচন কমিশনকে দেওয়া ড. কামাল হোসেনের পরামর্শ দাবিতে দীর্ঘদিন ধরে প্রচার হয়ে আসা ‘নির্বাচনে সেনাবাহিনীকে ভয় করলে শিবিরকে দিন’ শীর্ষক মন্তব্যটি ড. কামাল হোসেন করেননি। প্রকৃতপক্ষে ২০১৮ সালে অনুষ্ঠিত একাদশ নির্বাচনের পূর্ব থেকে তার নামে উক্ত মন্তব্যটি কোনো ধরনের তথ্যসূত্র ছাড়াই ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে। 

ফেসবুকে উক্তিটি প্রথম কখন পাওয়া যায়? 

ড. কামাল হোসেনের নামে দীর্ঘদিন ধরে প্রচারিত উক্ত মন্তব্যটির উৎস অনুসন্ধানে দেখা যায়, অন্তত ২০১৮ সালের ১৯ নভেম্বর থেকে তার নামে উক্ত মন্তব্যটি ফেসবুকে প্রচার হয়ে আসছে। ২০১৮ সালে ফেসবুকে প্রচারিত এমন পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে, এখানে। আর্কাইভ দেখুন এখানে, এখানে, এখানে। 

Image Collage by Rumor Scanner

তবে এসব পোস্ট বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এগুলোর কোথাও তার এই সম্পর্কিত বক্তব্যের কোনো তথ্যসূত্র উল্লেখ করা হয়নি। অর্থাৎ ড. কামাল হোসেন কখন, কোথায় এমন মন্তব্য করেছেন সে বিষয়ে পোস্টগুলোতে কোনো তথ্য নেই।

পাশাপাশি একই সময়ে উক্ত পোস্টগুলোর বিপরীতে সেসময়ে ফেসবুকে এমন কিছু পোস্টও পাওয়া যায়, যেখানে ড. কামাল হোসেনের নামে প্রচারিত উক্ত উক্তিটিকে ভুয়া হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এমন কিছু ফেসবুক পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে

Image Collage by Rumor Scanner

পরবর্তীতে দাবিটি নিয়ে আরও অধিকতর অনুসন্ধানে ২০১৮ সাল ও পরবর্তী বিভিন্ন সময়ে ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে করা বিভিন্ন গণমাধ্যমের একাধিক প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে রিউমর স্ক্যানার টিম। 

যেমন, ২০১৮ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর একাদশ নির্বাচনকে ঘিরে ব্রিটিশ গণমাধ্যম বিবিসি বাংলাকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে ড. কামাল হোসেন বলেন, বর্তমান সংবিধানিক কাঠামো এবং ক্ষমতাসীন সরকারের অধীনে নির্বাচনে যোগদান করতে তারা নীতিগতভাবে রাজি আছেন। তবে এ ব্যাপারে তাদের নবগঠিত জোটের শরীকদের সাথে কোন কথা হয়নি। এটি শুধুই তার দলের অবস্থান।

Screenshot: BBC Bangla 

একই গণমাধ্যমে ২০১৮ সালের ২৮ নভেম্বর ‘কেন নির্বাচন করছেন না জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতা ড. কামাল হোসেন‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ড. কামাল হোসেন বলেন রাজনৈতিক ব্যাপারে যতটুকু যা করার তা তিনি করবেন, কিন্তু তিনি নির্বাচন করবেন না শুধু বয়সের কারণেই।

Screenshot: BBC Bangla 

বেসরকারি টিভি চ্যানেল এনটিভির ২০১৮ সালের ১১ নভেম্বর ‘নির্বাচন কমিশনকে ড. কামাল হোসেনের চিঠি‘ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিলে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শরিক রাজনৈতিক দল হিসেবে দলীয় প্রতীক ‘উদীয়মান সূর্য’ নিয়ে অংশ নিতে চায় গণফোরাম। এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছিলেন দলটির সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন।

জার্মান গণমাধ্যম ডয়েচে ভেলেতে ২০১৮ সালের ১৪ ডিসেম্বর ‘জামায়াত নিয়ে প্রশ্ন করায় ড. কামালের ধমক‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, শহীদ বুদ্ধিজীবীদের শ্রদ্ধা জানাতে মিরপুরে শহীদ বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধে গিয়ে এক সাংবাদিকের  ‘‘জামায়াতকে নিয়ে আপনাদের সর্বশেষ অবস্থান কী?” শীর্ষক প্রশ্নে উত্তেজিত হয়ে পড়েন ড. কামাল হোসেন। 

Screenshot: DW Bangla 

তার এ উত্তেজিত হয়ে যাওয়া প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরামের প্রশিক্ষন সম্পাদক ও লেখক রফিকুল ইসলাম পথিক সেসময় গণমাধ্যমটিকে বলেন, ‘‘এখানে তো স্বাধীনতাবিরোধী কেউ নেই৷ জামায়াতকে নির্বাচন কমিশন থেকেই নিষিদ্ধ করা হয়েছে৷ ফলে জামায়াত তো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে না৷ তবে হ্যাঁ, যারা নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, তারা কয়েকজন ব্যক্তি৷ তারা যদি এখন কোনো খারাপ কাজ করে, তখন ব্যবস্থা নেয়া যাবে৷ আর স্বাধীনতাবিরোধী কোথায় নেই? প্রধানমন্ত্রীর আত্মীয় নেই, শেখ সেলিম সাহেব বিএনপি নেতার সঙ্গে আত্মীয়তা করেননি? তাহলে এখানে এসব নিয়ে কথা হচ্ছে কেন? আর ড. কামাল সাহেব তো জামায়াতের সঙ্গে যাননি৷ উনার সঙ্গে বিএনপি আছে৷ এখন বিএনপির সঙ্গে জামায়াত নেতাদের একটা সম্পর্ক আছে, সেটা যেভাবেই হোক, তার দায়-দায়িত্ব তো ড. কামাল হোসেন নেবেন না৷” ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা হিসেবে কী দায় ড. কামাল হোসেনের উপর বর্তায় না? এ প্রশ্নের জবাবে জনাব পথিক বলেন, ‘‘আমরা তো স্বীকারই করছি না৷ তাহলে আমাদের উপর কেন দায় বর্তাবে? এটা ঠিক নয়৷”

Screenshot: DW Bangla 

এই প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, ড. কামাল হোসেনের দল গণফোরাম ইসলামি ছাত্রশিবিরের মূল সংগঠন জামায়াতে ইসলামীকে অস্বীকার করছে।

মূলধারার অনলাইন পোর্টাল জাগোনিউজ২৪ এ ২০১৯ সালের ২৫ মার্চ ‘সঞ্চালনায় সাবেক শিবির সভাপতি, বক্তব্যে ড. কামাল‘ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ইসলামী ছাত্রশিবিরের কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও জামায়াত থেকে বহিষ্কৃত নেতা মজিবুর রহমান মঞ্জুর সঞ্চালনায় এক অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রেখেছিলেন গণফোরাম সভাপতি ও জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন। তবে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের আগ থেকেই জামায়াত-শিবিরের রাজনীতির বিরোধিতা করে আসছিলেন তিনি। এ বিরোধিতার জেরে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনেও জামায়াত ইস্যুতে টানাপোড়েন সৃষ্টি হয় ড. কামাল হোসেন গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের মধ্যে। পরে জামায়াত নেতারা ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে আলাদাভাবে নির্বাচনে অংশ নেন।

Screenshot: Jago News24

অনলাইন নিউজ পোর্টাল বিডিনিউজ২৪ এ ২০১৮ সালের ৪ ডিসেম্বর ‘এনডিআইকে নির্বাচন পরিস্থিতি জানালেন কামাল হোসেন‘ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক ইন্সটিটিউটের (এনডিআই) সাথে সকালে বৈঠকে ড. কামাল হোসেন নির্বাচন ও নির্বাচনের পরিবেশ প্রভৃতি বিষয়ে নিয়ে আলোচনা করেন। 

Screenshot: BD News24

জাতীয় দৈনিক সমকালের ২০১৭ সালের ২১ সেপ্টেম্বর ‘সেনা মোতায়েন চান ড. কামাল‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ড. কামাল হোসেন নির্বাচনের সময় সরকার ও প্রশাসনের নিরপেক্ষ ভূমিকা পালনের বিষয়টি নিশ্চিত করতে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। ইসি আয়োজিত রাজনৈতিক দলের ধারাবাহিক সংলাপে এ আহবান জানান তিনি। এসময় সশস্ত্র বাহিনীকে অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাবও দেওয়া হয় দলটি থেকে।

Screenshot: Samakal 

বেসরকারি টিভি চ্যানেল আরটিভির ২০১৮ সালের ২৫ নভেম্বর ‘সিইসির পদত্যাগ চান ড. কামাল‘ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ড. কামাল হোসেন বলেন, নির্বাচন কতটা সুষ্ঠু ও সুন্দর হবে সেটা নির্ভর করে নির্বাচনকালীন সরকার এবং নির্বাচন কমিশনের উপর। যেখানে নির্বাচন কমিশন পক্ষপাতিত্ব আচরণ করে সেই নির্বাচন কমিশনের কাছ থেকে সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। এজন্য প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদার পদত্যাগ চান তিনি। 

Screenshot: RTV 

দৈনিক নয়াদিগন্তের ‘ড. কামালের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের অভিযোগ‘ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ড. কামালের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগ নেতারা অভিযোগ করেন, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ড. কামাল হোসেন পাকিস্তানে সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের সাথে ছিলেন। তবে এসব অভিযোগের মধ্যে ড. কামালের শিবির ও সেনাবাহিনী সংশ্লিষ্ট মন্তব্যের ব্যাপারে কোনো উল্লেখ নেই।

Screenshot: Naya Diganta 

এসব প্রতিবেদনেরও কোথাও এমন কোনো তথ্য খুঁজে পাওয়া যায়নি, যা সুষ্ঠু নির্বাচন প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে উদ্দেশ্য করে ‘সেনাবাহিনীকে ভয় করলে শিবিরকে দিন।’ শীর্ষক মন্তব্য করেছেন ড. কামাল হোসেন এমন দাবিকে সমর্থন করে। 

এছাড়া সাম্প্রতিক সময়েও ড. কামাল হোসেনের শিবির ও সেনাবাহিনীকে জড়িয়ে এমন কোনো বক্তব্য খুঁজে পাওয়া যায়নি। 

এই দাবি প্রসঙ্গে ড. কামাল হোসেনের পরিবার কি বলছে? 

অনুসন্ধানের এই পর্যায়ে রিউমর স্ক্যানার টিম দাবিটির সত্যতা নিয়ে আরও নিশ্চিত হতে ড. কামাল হোসেনের মেয়ে ব্যারিস্টার সারাহ হোসেনের সঙ্গে যোগাযোগ করে।

Statement of Sara Hossain (daughter of Dr Kamal Hossain).

এই বিষয়ে তিনি রিউমর স্ক্যানারকে বলেন, ‘ড. কামাল হোসেনের নামে প্রচারিত এই মন্তব্যটি পুরোপুরি মিথ্যা। তিনি কখনো এমন মন্তব্য করেননি।’

মূলত, ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনের কিছুদিন পূর্ব থেকে দীর্ঘদিন ধরেই গণফোরাম সভাপতি ও সেসময় বাংলাদেশের সমমনা রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের আহবায়ক ড. কামাল হোসেনের নামে ‘সেনাবাহিনীকে ভয় করলে শিবিরকে দিন।’ শীর্ষক একটি বক্তব্য ফেসবুকে প্রচার করা হচ্ছে। তবে রিউমর স্ক্যানারের অনুসন্ধানে দেখা যায়, সেসময় ড. কামাল হোসেনের নামে উক্ত মন্তব্যটি প্রচার করা হলেও ফেসবুকের সেসব পোস্টে এই মন্তব্যটির কোনো তথ্যসূত্র বা সময়কাল উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া রিউমর স্ক্যানারের সার্বিক অনুসন্ধানেও এই দাবির পক্ষে কোনো সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। একইসাথে ড. কামাল হোসেনের পরিবার থেকেও রিউমর স্ক্যানারকে নিশ্চিত করা হয়েছে যে, ড. কামাল হোসেনের নামে প্রচারিত এই বক্তব্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

সুতরাং, নির্বাচন সুষ্ঠু করা প্রসঙ্গে নির্বাচন কমিশনকে উদ্দেশ্য করে ‘সেনাবাহিনীকে ভয় করলে শিবিরকে দিন।’ শীর্ষক দাবিতে ড. কামাল হোসেনের নামে ফেসবুকে প্রচারিত মন্তব্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা। 

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img