বাংলাদেশের পাঠ্যবইগুলোতে ভুলের প্রবণতার বিষয়টি বেশ কয়েক বছর ধরেই সমালোচিত হয়ে আসছে। সাম্প্রতিক সময়ে নবম-দশম শ্রেণির পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের একটি তথ্যগত ভুল নিয়ে আলোচনা হচ্ছে সামাজিক মাধ্যমে।
যে ভুল নিয়ে আলোচনা
নবম দশম শ্রেণীর পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ১৪৩ নাম্বার পৃষ্ঠায় লেখা রয়েছে, “মহাকাশে বাতাস নেই, তাই বাতাসের চাপও নেই, তাই সেখানে শরীরের ভেতরের চাপকে কাটাকাটি (প্রশমিত অর্থে) করার জন্য কিছু নেই এবং এ রকম পরিবেশে মুহূর্তের মাঝে মানুষের শরীর তার ভেতরকার চাপে বিস্ফোরিত হয়ে যেতে পারে৷’

এই তথ্যের বিষয়ে ফেসবুকের কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
পোস্টগুলোর আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, মহাকাশে কোনো স্পেস স্যুট ছাড়া মানুষের দেহ মুহূর্তের মাঝে বিস্ফোরিত হবে না বরং বাতাসের চাপের ভারসাম্যহীনতায় শ্বাস বন্ধ হয়ে অভ্যন্তরীণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং মানবদেহ ফুলে যাবে।
কি-ওয়ার্ড সার্চের মাধ্যমে মহাকাশ ও জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ক ওয়েবসাইট ‘Space’ এর How to Die in Space বইয়ের লেখক পল এম. সাটার (Paul M. Sutter) এর লেখা “Lost In Space Without a Spacesuit? Here’s What Would Happen (Podcast)” শিরোনামের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, মহাকাশে স্পেস স্যুট ছাড়া কেউ বিস্ফোরিত হয় না। তবে আপনি বিস্ফোরিত হবেন না তার মানে এই নয় যে আপনি স্ফীত (inflate) হবেন না। আপনার ত্বকের পৃষ্ঠের কাছে আপনার রক্ত প্রবাহে দ্রবীভূত নাইট্রোজেন ছোট বুদবুদ তৈরি করবে। এই বুদবুদগুলো প্রসারিত হয়ে আপনাকে আপনার আকারের প্রায় দ্বিগুণ করে দেয়, এটি একটি বাস্তব জিনিস: একে বলা হয় ইবুলিজম।

যুক্তরাষ্ট্রের ওয়েস্ট টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয়ের (West Texas A&M University) ওয়েবসাইটে ২০১২ সালের ১৭ ডিসেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বিশ্ববিদ্যালয়টির পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. ক্রিস্টোফার এস. বাইর্ড জানান, “মানুষ মহাকাশে বিস্ফোরিত হয় না। যদিও বাইরের স্থান বায়ুর চাপের অভাবকে প্রতিনিধিত্ব করে, যা সাধারণত আমাদের শরীরের অভ্যন্তরীণ চাপকে মোকাবেলা করে। কিন্তু আমাদের টিস্যু ভারসাম্যহীনতা পরিচালনা করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী।”
মার্কিন লেখক রিচার্ড হার্ডিংয়ের লেখা বই Survival in Space এর বরাতে তিনি বলেন, “রক্তনালীগুলো বিস্ফোরিত না হয়েই অভ্যন্তরীণ চাপ সহ্য করতে পারে। স্পেস স্যুট ছাড়া মহাকাশে রেখে গেলে মানুষ মারা যায়। যারা অক্সিজেনের অভাব অনেকক্ষণ পানির নিচে পড়ে থাকে তারাও একই কারণে মারা যায়।”

এ বিষয়ে জানতে অধ্যাপক ড. ক্রিস্টোফার এস. বাইর্ডের সাথে যোগাযোগ করে রিউমর স্ক্যানার টিম৷ তিনি বলছিলেন, “মানুষের ত্বক আসলে অভ্যন্তরীণ চাপ ধারণ করার জন্য যথেষ্ট শক্তিশালী। অন্য কথায়, শূন্যে রাখা মানুষটি বিস্ফোরিত হয় না। যাইহোক, এটি এখনও বিপজ্জনক। শূন্যে থাকা একজন মানুষ খুব দ্রুত অক্সিজেনের অভাবে মারা যায়। এছাড়াও, বাহ্যিক চাপ মোকাবেলা না করে অভ্যন্তরীণ চাপ মানুষের ত্বক খুব শক্ত (tight) না হওয়া পর্যন্ত ফুলে যায়।”
হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এর ওয়েবসাইটের ব্লগে ২০১৩ সালের ৩০ জুলাই “THE HUMAN BODY IN SPACE: DISTINGUISHING FACT FROM FICTION” শীর্ষক শিরোনামের একটি প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনে বলা হয়, মহাশূন্যের তীব্র চাপে মানুষ জমে যাবে না, এমনকি বিস্ফোরিতও হবে না।

নাসার এক্সপেরিমেন্টে কী দেখা গিয়েছিল?
১৯৬৬ সালে নাসার সাবেক মহাকাশ প্রকৌশলী জিম লেব্ল্যাঙ্ক (Jim LeBlanc) একটি বিশাল ভ্যাকুয়াম চেম্বারে স্পেসসুট প্রোটোটাইপগুলোর কার্যকারিতা পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন। পরীক্ষার এক পর্যায়ে, তার স্যুটে চাপ দেওয়া বাতাসের পায়ের পাতার মোজাবিশেষ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ইউটিউবে এ সংক্রান্ত এক ভিডিওতে লেব্ল্যাঙ্ক বলছিলেন, “আমি পিছন দিকে হোঁচট খাওয়ার সাথে সাথে এবং অজ্ঞান হওয়ার ঠিক আগে আমার জিহ্বায় লালা বুদবুদ হতে শুরু করে এমন অনুভব করতে শুরু করি এবং এটি আমার মনে রাখার শেষ জিনিস।” এভাবে প্রায় ২৫ সেকেন্ড কেটে গিয়েছিল। এরপর সহকর্মী চেম্বারে প্রবেশ করে তাকে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেন৷

কী বলছে নাসা?
মহাকাশ গবেষণায় প্রথম সারির প্রতিষ্ঠান হিসেবে ভাবা হয় যুক্তরাষ্ট্রের সরকারি সংস্থা The National Aeronautics and Space Administration (NASA) কে। সংস্থাটিতে Element Scientist হিসেবে কর্মরত আছেন ক্রিস লেনহার্টড (Kris Lehnhartd)। ক্রিসের সাথে যোগাযোগ করলে তিনিও একই মত প্রকাশ করে রিউমর স্ক্যানারকে জানান, “আপনি বিস্ফোরিত হবেন না। তবে আপনার শরীরের তরল পানীয় গ্যাসে পরিবর্তিত হবে এবং সমস্ত ধরণের ক্ষতি করবে।”
মূলত, বহু বছর ধরেই মহাশূন্যে স্পেস স্যুট ছাড়া মানুষ গেলে বায়ুর চাপের তারতম্যের কারণে মুহুর্তেই দেহ বিস্ফোরিত হবে বলে পাঠ্যবইয়ে শিক্ষার্থীদের পড়ানো হচ্ছে। কিন্তু বিজ্ঞান বিষয়ক একাধিক আন্তর্জাতিক ওয়েবসাইটে সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা এই তথ্য সঠিক নয় বলে মত দিয়েছেন। এ বিষয়ে নাসার এলিমেন্ট সায়েন্টিস্ট ক্রিস লেনহার্টড রিউমর স্ক্যানারকে বলেছেন, “মহাকাশে স্পেসস্যুট ছাড়া আপনি বিস্ফোরিত হবেন না। তবে আপনার শরীরের তরল পানীয় গ্যাসে পরিবর্তিত হবে এবং সমস্ত ধরণের ক্ষতি করবে।”
সুতরাং, মহাকাশের বায়ুহীন স্থানে কোনো স্পেস স্যুট ছাড়া মানুষ গেলে মুহুর্তেই মানবদেহ বিস্ফোরণ হওয়ার দাবিটি মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Harvard blog : THE HUMAN BODY IN SPACE: DISTINGUISHING FACT FROM FICTION
- Youtube : Space Suit Testing
- Statement from Kris Lehnhardt, Element Scientist, NASA
- Statement from Dr. Christopher S. Baird, Associate Professor of Physics, West Texas A&M University
- Space: Lost In Space Without a Spacesuit? Here’s What Would Happen (Podcast)
- West Texas A&M University : How long can a human in outer space last without a spacesuit before exploding?