মাথা ঠোকাঠুকিতে শিং গজায়?

ছোটবেলা থেকেই আমরা নানা ধরনের ‘শোনা কথা’র সাথে পরিচিত হয়ে এসেছি। আমরা কখনোই হয়ত সেই কথা বা রীতির সত্যতা খুঁজে পাই নি কিন্তু আবহমানকাল ধরেই সেই রীতিগুলো টিকে আছে। কিন্তু এমন যদি হয়, মেনে আসা সেসব রীতি সত্যি হয়েছে ভিন্ন কোনো কারণে? গেল দুই দশকে মাথা নিয়ে এমনই এক ‘শোনা কথা’ সত্যি হওয়ার কিছু খবর এসেছে সংবাদমাধ্যমে।

মাথা নিয়ে যে রীতি প্রচলিত

১. সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে গত ৯ আগস্ট The Babumoshai নামক পেজ থেকে একটি পোস্ট (আর্কাইভ) করা হয়। ঘোড়ার ছবিযুক্ত পোস্টটির ক্যাপশনে উল্লেখ করা হয়, “মাথায় ঠোকাঠুকি লাগলে শিং গজায়।”

একই দাবিতে ফেসবুকের আরো কিছু পোস্ট দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে। আর্কাইভ ভার্সন দেখুন এখানে, এখানে এবং এখানে

২. বিনোদন জগতের বিভিন্ন কন্টেন্টেও মাথায় ঠোকাঠুকিতে শিং গজানোর ব্যাপারটি এসেছে। যেমন, গত ১২ জুলাই চ্যানেল আই’তে প্রচারিত হয় নাটক ‘ভাই বড় বিপদে’। এই নাটকের একটি দৃশ্যে (আর্কাইভ) দেখা যায়, অভিনেতা অপূর্বর সাথে অভিনেত্রী কেয়া পায়েলের মাথায় ঠোকাঠুকি হয়। এরপর অপূর্ব পুনরায় পায়েলকে মাথায় ঠোকাঠুকি করতে বলেন, যাতে শিং না গজায়।

২০০৮ সালে ভারতে মুক্তিপ্রাপ্ত বাংলা চলচ্চিত্র ‘ভালোবাসা ভালোবাসা’তেও একই ধরনের দৃশ্যায়ন (আর্কাইভ) দেখা যায়।

মাথায় শিং কি সত্যিই গজাতে পারে?

জাতীয় দৈনিক প্রথম আলো ২০১৬ সালের ১৬ জুলাই ‘বৃদ্ধের মাথায় শিং‘ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানে  উল্লেখ করা হয়, জামালপুরে আয়াত আলী নামে এক বৃদ্ধের মাথায় শিংয়ের মতো একটি বস্তু গজিয়েছে। বছরখানেক আগে ফোঁড়া দেখা দেওয়ার পর থেকে ধীরে ধীরে সেটি শিংয়ের আকৃতিতে রূপ নেয়। জামালপুর জেনারেল হাসপাতালে সার্জিক্যাল চিকিৎসক নূর-এ আলম বলেন, “এই রোগটির নাম সেফাসিয়াস হর্ন।” সে সময়ে এই রোগটিকে সকল গণমাধ্যমে সেফাসিয়াস হর্ন বলে পরিচয় দিলেও প্রকৃতপক্ষে এটি সেবাসিয়াস হর্ন (Sebaceous horn)। এটি কিউটেনিয়াস হর্ন (Cutaneous horn) নামেও পরিচিত। এটিকে অনেকে ডেভিলস হর্নও বলে থাকেন।

Source: prothomalo

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম NDTV ২০১৯ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে জানায়, দেশটির মধ্যপ্রদেশের রহলি গ্রামের কৃষক শ্যামলাল যাদবের মাথায় ৪ ইঞ্চি লম্বা শিং গজিয়েছে। ৭৪ বছর বয়সী এই বৃদ্ধের ২০১৪ সালে মাথায় আঘাত লেগে ফেটে গিয়েছিল। সেরে উঠার পর থেকেই মাথার ওই অংশ একটু একটু করে ফুলতে থাকে। প্রথম প্রথম মাথার তালুতে গজানো শক্ত, অসাড় আঙুলের মতো অংশটি নাপিত দ্বারা কেটে ফেলতেন তিনি। কিন্তু তাতে আরও দ্রুত আকারে বাড়তে দেখেন সেটি। বিগত কয়েক বছরে এটি চার ইঞ্চি লম্বা শিং-এর চেহারা নিয়েছে। তাই তিনি চিকিৎসকের শরণাপন্ন হন।

হাসপাতালের চিকিৎসকেরা শিং পরীক্ষা করে জানান, শ্যামলালের মাথায় ‘কিউটেনিয়াস হর্ন’ বা ‘ডেভিলস হর্ন’ গজিয়েছে। 

Image Source: Goal Post Media/SWNS

শুধু এই দুই ঘটনাই নয়, গেল দুই দশকে এই ধরনের বেশ কয়েকটি ঘটনাই খবর হয়েছে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম The Sun এই ধরনের কিছু ঘটনা নিয়ে ২০১৯ সালের ১৯ সেপ্টেম্বর একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এই প্রতিবেদনে ৮৭ বছর বয়সী লিয়াং জিউজেন (Liang Xiuzhen) নামের চীনা এক বৃদ্ধার ব্যাপারে জানা যায়, যিনি একই সমস্যায় পড়েন। ২০১৩ সালে মাথায় শিং সদৃশ বস্তু জন্মাতে দেখেন জিউজেন। একই প্রতিবেদনে জাং রুইফাং (Zhang Ruifang) নামে ১০১ বছর বয়সী আরেক চীনার বৃদ্ধার ব্যাপারে জানা যায়, যার মাথায় ২০০৯ সালে দুইটি শিং সদৃশ বস্তু গজাতে শুরু করে। সান-এর প্রতিবেদনে আরো বেশকিছু ঘটনার ব্যাপারে উল্লেখ করা হয়েছে যেখানে মাথা ছাড়াও পুরুষাঙ্গের পাশে, কানে, হাতে এই ধরনের শিং সদৃশ বস্তু জন্মাতে দেখা গেছে। প্রতিবেদনে সবগুলো ঘটনাকেই ‘কিউটেনিয়াস হর্ন’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তবে এসব ঘটনা মাথায় ঠোকাঠুকির ফলে হয়েছে- এমন কোনো তথ্য দেওয়া হয় নি প্রতিবেদনে।

কিউটেনিয়াস হর্নই কালপ্রিট?

আমাদের শরীরের ত্বকের উপরের স্তর তৈরিতে কেরাটিন নামে একটি প্রোটিনের ভূমিকা রয়েছে। ত্বক ছাড়াও নখ ও চুলের গঠনেও কেরাটিনের ভূমিকার কথা জানা যায়। এই কেরাটিনই ত্বকে এক ধরনের ক্ষত বা অস্বাভাবিক বৃদ্ধি ঘটিয়ে শিং সদৃশ বস্তু তৈরি করে। দেখতে প্রাণীর শিংয়ের মতো হয় বলে এর নাম দেওয়া হয়েছে কিউটেনিয়াস হর্ন। দ্য সানের প্রতিবেদনে একে ‘ত্বকের টিউমার’ হিসেবে আখ্যা দেওয়া হয়েছে।

মাথায় শিং গজানোর এমন অদ্ভূত ঘটনা সম্পর্কে প্রথম জানা যায় ১৫৮৮ সালে। The Journal of Cutaneous Medicine- এ ২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সে সময় (১৫৮৮) মার্গারেট গ্রিফিথ নামে যুক্তরাজ্যের এক নারীর কপালে চার ইঞ্চি লম্বা শিং গজায়। লোককাহিনী অনুযায়ী, মার্গারেটের স্বামী মৃত্যুর আগে অবিশ্বস্ততার জন্য তার মাথায় শিং গজাবে বলে অভিযোগ করে গিয়েছিল। কিন্তু মার্গারেট এই অভিযোগ অস্বীকার করে বলেছিলেন, ব্যভিচারী হলেই তবে গজাতে পারে শিং। কিংবদন্তী অনুসারে, পরবর্তীতে শিং গজাতে দেখা যায় মার্গারেটের কপালে।

Source : JCM

এরপর বহুবারই মানুষের মাথা ও কপালে এমন শিং গজানোর খবর এসেছে। অতীতে এই ধরনের ঘটনাগুলো ভয়, শঙ্কা এবং কুসংস্কার ছড়িয়েছে দেশে দেশে।

২০০৪ সালে তুরস্কের আদনান মেনডেরেস বিশ্ববিদ্যালয়ের (Adnan Menderes University) একদল গবেষক কিউটেনিয়াস হর্ন বিষয়ে তাদের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। বিগত চার বছরে এই রোগে আক্রান্ত ১১ জন রোগীর উপর গবেষণা করে তারা দেখতে পান যে সকল রোগীরই দীর্ঘ সময় রোদে থাকার ইতিহাস ছিল। রোদ পড়ে ত্বকের এমন স্থানেই (যেমন মাথা, কান, নাক, হাত) তাই এই রোগের উপসর্গের উপস্থিতির দেখা মেলে।

Source: ncbi

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম Zee News বলছে, শুধু কপালে বা মাথায় নয়, কানে, ঘাড়ে, হাঁটু বা কনুইয়েও গজাতে পারে কিউটেনিয়াস হর্ন। তবে সব সময়েই যে সেগুলো ২-৩ ইঞ্চি লম্বা হবে, তার কোনও মানে নেই। কিউটেনিয়াস হর্ন ৩-৪ সেন্টিমিটার লম্বাও হতে পারে। এটি শরীরে ধীরে ধীরে বেড়ে ওঠে।

Source: zeenews

স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট Healthline এ প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ঠিক কী কারণে অদ্ভুত এই রোগে মানুষ আক্রান্ত হয় তা জানা যায় নি এখনো। তবে সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মির বিকিরণ একটি কারণ হতে পারে। এছাড়া হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাসেরও এই রোগের পেছনে হাত থাকতে বলে মত দেওয়া হয়েছে একই প্রতিবেদনে।

সাধারণত ষাটোর্ধ্ব ব্যক্তিরাই এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। নারীদের তুলনায় পুরুষরাই এই রোগে বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকেন।

Source: healthline

২০১৩ সালে নিউজিল্যান্ডের হক’স বে হসপিটালের মেডিকেল অনকোলজি রেজিস্ট্রার ডাঃ টিনা টিয়ান সে দেশের ত্বক বিষয়ক ওয়েবসাইট DermNet NZ এ লেখা এক কলামে উল্লেখ করেন, ফর্সা ত্বকের ব্যক্তিদেরও এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই রোগ সংক্রামক নয়, তাই একজন থেকে আরেকজনে ছড়াতে পারে না।

স্বাস্থ্য বিষয়ক ওয়েবসাইট Medical News Today বলছে, শুধু মানুষই নয়, এই রোগে বিড়াল এবং কুকুরেরও আক্রান্ত হওয়ার ইতিহাস রয়েছে। 

অন্য কোনো কারণে শিং গজাতে পারে মাথায়?

২০১৮ সালের ২০ ফেব্রুয়ারী বিশ্বখ্যাত জার্নাল ‘Nature‘ এ Prominent exostosis projecting from the occipital squama more substantial and prevalent in young adult than older age groups শিরোনামে প্রকাশিত এক গবেষণা প্রতিবেদন ঘিরে তোলপাড় শুরু হয়। অষ্ট্রেলিয়ার দুই গবেষক ডেভিড সাহার ও মার্ক সেয়ার্সের করা এই গবেষণায় দেখা যায়, আশ্চর্যজনক সংখ্যক যুবক তাদের মাথার খুলির পিছনে হাড়ের বৃদ্ধি ঘটাচ্ছে। গবেষকরা দাবি করেছেন যে রোগীরা বিভিন্ন ডিভাইসের (বিশেষত মোবাইল) স্ক্রিনের দিকে তাকানোর জন্য যে পরিমাণ সময় ব্যয় করেছেন তার কারণে এটি হয়েছিল। দেখতে ‘শিং’-এর মতো বাড়তি এই হাড়ের উপস্থিতি উদ্বেগজনক বলে অভিমত দেওয়া হয় গবেষণায়।

গবেষকরা ১৮ থেকে ৮৬ বছর বয়সী ১২০০ মানুষের উপর এই গবেষণা পরিচালনা করেন। কিন্তু একজন মানুষেরও মোবাইল বা অন্য ডিভাইস ব্যবহারের বিষয়টি মূল্যায়ন করা হয় নি গবেষণাটিতে। তাই ডিভাইস ব্যবহারই যে এই ধরনের সমস্যা সৃষ্টির পেছনে প্রধান কারণ তা বলা যায় না। ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম বিবিসি ২০১৯ সালের ১৩ জুন এ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশের পর গবেষণাটি ঘিরে সে সময় বিতর্ক সৃষ্টি হয়। আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে মোবাইল ব্যবহারে শিং গজায় এমন শিরোনাম দিয়েও খবর প্রকাশিত হতে দেখা যায়।

এর প্রেক্ষিতে পরের বছর (২০১৯) গবেষণাটির কিছু অংশ সম্পাদনা করে গবেষকরা Nature-এ একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেন। গবেষকরা দাবি করেন, তাদের এই গবেষণায় মোবাইল ব্যবহারের সাথে শিং সদৃশ বস্তু সৃষ্টির সম্পর্কটি অনুমান নির্ভর ছিল। তারা এই দু’টি বিষয়ের মধ্যে সরাসরি কোনো যোগাযোগ খুঁজে পান নি।

Source: Nature

কিন্তু মূল গবেষণাপত্রটি এখনও ইন্টারনেটে থাকায় এটি নিয়ে এখনও বিভ্রান্তিকর তথ্য ছড়ানোর শঙ্কা রয়েছে।

অর্থাৎ, বহু বছর ধরে ভিত্তিহীনভাবে কোনো তথ্যসূত্র ছাড়াই একজনের সাথে আরেকজনের মাথায় ঠোকাঠুকি হলে শিং গজানোর তথ্যটি প্রচার হয়ে আসছে। কিন্তু এই তথ্যের স্বপক্ষে একটিও প্রমাণ পাওয়া যায় না। বরং শিং গজানোর সমস্যাটিকে ‘কিউটেনিয়াস হর্ন’ নামক একটি রোগ হিসেবে অভিহিত করা হয়। এই রোগ সৃষ্টির পেছনে যে কারণগুলোর কথা বলছেন বিজ্ঞানীরা সেখানে মাথায় ঠোকাঠুকি সংক্রান্ত কোনো তথ্য নেই। সুতরাং, মাথায় ঠোকাঠুকি হলে শিং গজায় এমন দাবির কোনো ভিত্তি নেই।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img