যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরে ‘টরেনাজা’ নামের অস্তিত্বহীন দেশের নাগরিক আসার ঘটনাটি ভুয়া

সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজন নারীর কয়েকটি ছবিসহ আরো কয়েকটি ছবি সংযুক্ত করে দাবি প্রচার করা হয়েছে, ‘আমেরিকার JFK এয়ারপোর্টে ঘটল এক আশ্চর্য ঘটনা। এক বয়স্ক মহিলা জাপান থেকে আগত প্লেন থেকে নামেন। তার পাসপোর্ট দেখে এয়ারপোর্টে স্টাফ অবাক হয়ে যান। তার দেশের নাম TORENAZA,  এই নামের কোন দেশ পৃথিবীর মানচিএ নেই। অথচ তার পাসপোর্ট এ ডজনের উপর দেশ ভ্রমণের সিল আছে যে দেশগুলো পৃথিবীতে অস্তিত্ব নেই। আরও আশ্চর্যের বিষয় হল, তার পাসপোর্ট এ বায়োমেট্রিক, সিল সব কিছু অরজিনাল।তাকে যখন সব কিছু বলা হল, তিনি তখন বলেন, আমি মনে হয় অন্য গ্রহে এসেছি। তাকে একদম স্বাভাবিক ট্রাভেলারের মতই মনে হচ্ছিল। তাই এয়ারপোর্টে স্টাফ তাকে নিয়ে পযবেক্ষন রুমে রাখা হল। তিনি সেখানে ৩০ মিনিট বসে ছিলেন, হঠাত সি সি ক্যামেরা গুলো অচল হয়ে গেল। তাকে আর সেখেনে দেখা গেল না।’

এরূপ দাবিতে ফেসবুকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ) এবং এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে টিকটকে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে ইউটিউবে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

এরূপ দাবিতে ইনস্টাগ্রামে প্রচারিত পোস্ট দেখুন এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, আলোচিত দাবির অনুরূপ যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক বিমানবন্দরে ‘Torenaza’ নামের কোনো অস্তিত্বহীন দেশ থেকে কোনো নারী যাত্রী আসেননি। প্রকৃতপক্ষে প্রচারিত নারীর ছবি/দৃশ্য ‘এয়ারলাইন’ নামের একটি রিয়েলিটি শো এর ২০০৪ সালে সম্প্রচারিত একটি এপিসোডের দৃশ্য থেকে নেওয়া হয়েছে। এছাড়া, হুট করে এমনভাবে অদৃশ্য হওয়ার ঘটনার সাথে কোনো বাস্তব ঘটনা নয় বরং জাপানি একটি উপকথার সাদৃশ্য পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে অনুসন্ধানে যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক টিভি নেটওয়ার্ক ‘A&E’ এর ইউটিউব চ্যানেলে ‘Airline: Best Full Episodes of 2024 MARATHON | A&E’ শিরোনামে ২০২৪ সালের ৮ নভেম্বরে প্রচারিত একটি ভিডিও পাওয়া যায়। ভিডিওটির ২২ মিনিট পরবর্তী নানা সময়ে আলোচিত দাবিতে প্রচারিত নারীর দৃশ্য প্রদর্শিত হতে দেখা যায়। 

Comparison : Rumor Scanner

উক্ত ইউটিউব ভিডিওটির বর্ণনা অংশ থেকে জানা যায়, এটি ‘এয়ারলাইন’ নামক সিরিজের ‘লস্ট ইন ট্রান্সলেশন’ নামক একটি এপিসোডের দৃশ্য। উক্ত দৃশ্যে দেখা যায়, আলোচিত ঐ নারী যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোর থেকে লস অ্যাঞ্জেলেস এসেছেন। উল্লেখ্য, আলোচিত দাবির অনুরূপ নিউ ইয়র্কের JFK বিমানবন্দরের উল্লেখ পাওয়া যায়নি। উক্ত নারী এয়ারলাইন স্টাফের ইংরেজি কথা বুঝতে অপারগ দেখা যায় এবং উক্ত নারীর কাগজপত্র দেখে স্টাফ ধারণা করেন তিনি আরবি ভাষাভাষী নারী। পরবর্তীতে উক্ত স্টাফ ভিন্ন একজন দোভাষী/বহুভাষীর সাথে সেই নারীকে কথা বলিয়ে বুঝতে পারেন তাকে আব্দুল্লাহ নামে কেউ একজন নিতে আসবে এবং পরবর্তীতে সে আসে। উক্ত ভিডিওতে কোথাও ‘টরেনাজা’ নামক কোনো অস্তিত্ত্বহীন দেশের উল্লেখ করা হয়নি বরং সৌদি আরব উল্লেখ করতে শোনা যায়।

পরবর্তীতে উক্ত এপিসোডের বিষয়ে অনুসন্ধানে মুভি সিরিজ বিষয়ক প্ল্যাটফর্ম আইএমডিবিরোটেন টমেটোজে ওয়েবপেজ পাওয়া যায়। বলা হয় এটি এয়ারলাইন নামক একটি রিয়েলিটি শো এর সীজন ২ এর ১১ নাম্বার এপিসোড যেখানে ইংরেজি না বোঝা একজন সৌদি আরবের নারীর সাথে ‘ইয়োলান্ডা’ নামের এক চরিত্র পরিস্থিতি সামলান। এপিসোডটি ২০০৪ সালের ১৩ সেপ্টেম্বরে সম্প্রচার করা হয়েছিল। শো বা সিরিজটির পরিচয়ে বলা হয়, এটি একটি বড় বিমানবন্দরকে নিখুঁতভাবে চালু রাখতে এয়ারলাইন কর্মীদের একটি দলের দৈনন্দিন কঠিন অভিজ্ঞতা দেখায়।

অর্থাৎ, প্রচারিত নারীর ছবি প্রকৃতপক্ষে একটি রিয়েলিটি শো এর দৃশ্য। এছাড়াও, আলোচিত দাবিতে প্রচারিত পোস্টের একটি ছবি যুক্তরাষ্ট্রের পাসপোর্টের।

পরবর্তীতে প্রাসঙ্গিক কি-ওয়ার্ড সার্চ করলে যুক্তরাষ্ট্রের JFK বিমানবন্দরে প্রকৃতপক্ষে এরূপ কোনো অস্তিত্বহীন দেশের নাগরিক আসার দাবির সপক্ষে নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি।

এছাড়াও, অনুসন্ধানে ফ্রান্সভিত্তিক ফ্যাক্টচেকিং প্ল্যাটফর্ম ‘এএফপি ফ্যাক্টচেক’ এর ওয়েবসাইটেও গত ১৭ অক্টোবরে এ বিষয়ে প্রকাশিত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন পাওয়া যায় যেখানে আলোচিত দাবিকে ভুয়া বলা হয়। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, আলোচিত দাবি “ম্যান ফ্রম টাওরেড” নামে পরিচিত এক দশক-প্রাচীন শহুরে উপকথার পুনঃকল্পিত সংস্করণ বলে মনে হচ্ছে। ওই উপকথা অনুসারে, ১৯৫০-এর দশকে এক রহস্যময় যাত্রী জাপানের টোকিওর হানেদা বিমানবন্দরে নেমেছিলেন, যার পাসপোর্ট ছিল একটি অস্তিত্বহীন দেশ “টাওরেড” থেকে। সাম্প্রতিক অনলাইন পোস্টগুলোর মতোই, “ম্যান ফ্রম টাওরেড” কাহিনিতে বলা হয় যে তাকে তার উৎস সম্পর্কে তদন্তের জন্য রাতে আটক রাখা হয়েছিল। কিন্তু সকালে দেখা যায়, সেই ব্যক্তি এবং তার সব জিনিসপত্র উধাও — যা থেকে দাবি ওঠে যে তিনি নাকি এক প্যারালাল মহাবিশ্বে চলে গিয়েছিলেন। এই গল্পের কোনো বিশ্বাসযোগ্য প্রমাণ নেই। তবে, পরবর্তীতে গবেষকরা এই মিথটিকে বাস্তব এক ঘটনার সঙ্গে যুক্ত করেন — জন জেগ্রাস নামের এক প্রতারকের সঙ্গে, যাকে টোকিওতে একটি কাল্পনিক দেশের ভুয়া পাসপোর্টসহ গ্রেপ্তার করা হয়েছিল।

সুতরাং, রিয়েলিটি শো এর দৃশ্যের নারীর ছবিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিমানবন্দরে ‘টরেনাজা’ নামের অস্তিত্বহীন দেশের নাগরিক আসার ঘটনা দাবিতে প্রচার করা হয়েছে; যা মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img