মির্জা ফখরুলের বাসা থেকে ৬০ কোটি টাকা উদ্ধার ও তাকে আটকের দাবিটি মিথ্যা

সম্প্রতি, সেনাবাহিনীর অভিযানে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসা থেকে নগদ ৬০ কোটি টাকা, স্বর্ণালংকার এবং বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধার করা হয়েছে দাবিতে একটি ভিডিও ইন্টারনেটে প্রচার করা হয়েছে। প্রচারিত ভিডিওটি দাবি করা হয়, এ ঘটনায় তাকে আটক করে ডিবি কার্যালয়ে নেওয়া হয়েছে। এছাড়াও ‘টাকাগুলো বিএনপির কালো তহবিল থেকে এসেছে’ বলে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান মন্তব্য করেছেন বলেও দাবি করা হয়।

টিকটকে প্রচারিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ইউটিউবে প্রচারিত একই ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

এই প্রতিবেদন প্রকাশ অবধি ইউটিউবে প্রচারিত ভিডিওটি দেখা হয়েছে প্রায় ছয় লক্ষ বার। এছাড়াও ভিডিওটিতে প্রায় সাড়ে ৫ হাজারেরও বেশি পৃথক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসা থেকে সেনা অভিযানে নগদ ৬০ কোটি টাকা ও স্বর্ণালংকার পাওয়ার দাবিটি মিথ্যা। এছাড়াও এ বিষয়ে সেনাপ্রধানের মন্তব্য করার দাবিটিও ভুয়া। প্রকৃতপক্ষে, ২০২৩ সালের অক্টোবরে বিএনপির মহাসমাবেশে দলটির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের প্রেক্ষিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আটকের বিষয়ে সেসময় প্রচারিত প্রতিবেদনের অংশবিশেষের সাথে ভিন্ন ভিন্ন ঘটনার ছবি যুক্ত করে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে।

অনুসন্ধানের শুরুতে আলোচিত ভিডিওটি পর্যালোচনা করে রিউমর স্ক্যানার, এতে দুটি সংবাদপাঠের ফুটেজ ও সেনাবাহিনীর অভিযান পরিচালনার একাধিক ছবি দেখা যায়। সংবাদপাঠের ফুটেজগুলোতে বলা হয় মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে তার গুলশানের বাসা থেকে আটক করা হয়েছে। অপরদিকে সেনাবাহিনীর অভিযানের ছবিগুলো দ্বারা তার বাসায় চালানো অভিযান ও সেখান থেকে টাকা উদ্ধারের চিত্র হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। 

ভিডিও যাচাই 

আলোচিত ভিডিওটিতে দেখানো দুটো সংবাদপাঠের ফুটেজের বিষয়ে অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে Jamuna TV এবং BanglaVision NEWS এর ইউটিউব চ্যানেলে ২০২৩ সালের ২৯ অক্টোবর প্রচারিত মূল প্রতিবেদন দুটো খুঁজে পাওয়া যায়। প্রতিবেদনগুলো দেখুন যমুনা টেলিভিশন এবং বাংলাভিশন

প্রতিবেদনগুলো থেকে জানা যায়, ২০২৩ সালের ২৮ অক্টোবর আয়োজিত বিএনপির মহাসমাবেশকে কেন্দ্র করে বিএনপির নেতা-কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষের ঘটনায় সেসময় বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে আটক করা হয়। উক্ত প্রতিবেদনগুলোতে তার বাসা থেকে অর্থ কিংবা স্বর্ণালংকার উদ্ধারের বিষয়ে কোনো কিছু বলা হয়নি। 

এছাড়াও অনুসন্ধানে সাম্প্রতিক সময়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসায় সেনাবাহিনীর অভিযান পরিচালনা করে তাকে আটকের বিষয়ে গণমাধ্যম কিংবা অন্যকোনো নির্ভরযোগ্য সূত্রে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। বরং জানা যায়, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৮০তম অধিবেশনে প্রধান উপদেষ্টার সফরসঙ্গী হয়ে যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্কে যান। সেখানে গত ২৭ সেপ্টেম্বর তিনি ‘এনআরবি কানেক্ট ডে: এমপাওয়ারিং গ্লোবাল বাংলাদেশি’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে বক্তব্যও প্রদান করেন।

ছবি যাচাই

আলোচিত ভিডিওটিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসায় সেনা অভিযান পরিচালনা ও নগদ অর্থ উদ্ধারের দৃশ্য দাবিতে বেশ কয়েকটি ছবি প্রচার করা হয়। 

ভিডিওতে দেখতে পাওয়া সেনা অভিযান সংক্রান্ত ছবিগুলোর বিষয়ে প্রথমে অনুসন্ধান করা হয়। ভিডিওর প্রথম ছবিটির বিষয়ে অনুসন্ধানে রিভার্স ইমেজ সার্চের মাধ্যমে Channel 24 এর ওয়েবসাইটে ২০২৪ সালের ৮ নভেম্বর প্রকাশিত একটি প্রতিবেদনে ছবিটির সন্ধান পাওয়া যায়। প্রতিবেদনটি থেকে জানা যায়, ছবিটি টঙ্গীর কেরাণিটেক বস্তিতে র‍্যাব ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযান পরিচালনার সময়কার। সেসময় অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক দ্রব্য, নগদ ২২ লাখ টাকা উদ্ধারের পাশাপাশি মাদক কারবারের সঙ্গে জড়িত ৪০ জনকে আটক করা হয়। এছাড়াও জানা যায়, গণমাধ্যমের সাথে কথা বলতে দেখা সেনা কর্মকর্তার নাম মেজর ইয়াসমিন আক্তার। গণমাধ্যমে কথা বলার পর তিনি সেসময় ব্যাপক আলোচিত হয়ে ওঠেন।

পরবর্তীতে ভিডিওটিতে আরও চারটি সেনা অভিযানের ছবি দেখানো হয়। অনুসন্ধানে দেখা যায়, যার মাঝে তিনটি সেনা অভিযানের ছবি এবং একটি বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বোর্ড (বিএএসবি) এর মেডিকেল ডিসপেনসারি উদ্বোধনের সময় ধারণ করা ছবি। সেনা অভিযানের প্রথম ছবিটি গতবছর অক্টোবর মাসে মোহাম্মদপুরে যৌথ বাহিনীর চালানো একটি অভিযানের ছবি।

দ্বিতীয়টি এবছর আগস্টে লক্ষ্মীপুরে অবসরপ্রাপ্ত এক সেনা কর্মকর্তার বাড়ি থেকে দুটি এলজি, বিপুল পরিমাণ দেশীয় অস্ত্র, ইয়াবা ও নগদ অর্থ উদ্ধারের ঘটনার ছবি। 

অপরটি গত জুন মাসে রাজধানীর মহাখালী বাস টার্মিনালে চাঁদাবাজি, অতিরিক্ত ভাড়া আদায় ও যাত্রী হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধ দমনে সেনাবাহিনীর চালানো অভিযানের ছবি। 

সর্বশেষ ছবিটি ২০২৪ সালের অক্টোবরে সেনাবাহিনী প্রধান কর্তৃক ঢাকাসহ সারাদেশে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনী বোর্ড (বিএএসবি) এর ৩০টি মেডিকেল ডিসপেনসারি উদ্বোধনের দিন তোলা ছবি। 

এছাড়াও আলোচিত ভিডিওটিতে মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসা থেকে টাকা উদ্ধারের ছবি দাবিতে দুটি ছবি দেখানো হয়। যার একটি গতবছরের সেপ্টেম্বরে উত্তরার পশ্চিম থানা এলাকা থেকে ঢাকা মহানগর পুলিশ ও সেনাবাহিনীর যৌথ অভিযানে কয়েক বস্তা ভর্তি টাকাসহ ৩ জনকে গ্রেফতারের ঘটনার ছবি। 

অপরটি কিশোরগঞ্জের পাগলা মসজিদের সিন্দুক থেকে রেকর্ড পরিমাণ ৫ কোটি ৫৯ লাখ টাকা পাওয়ার ঘটনায় প্রকাশিত সংবাদে ব্যবহৃত একটি ছবি।

অর্থাৎ, ২০২৩ সালে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর আটক হওয়ার ঘটনায় প্রকাশিত প্রতিবেদনের সাথে সেনাবাহিনী ভিন্ন ভিন্ন অভিযানের ছবি যুক্ত করে আলোচিত ভিডিওটি তৈরি করা হয়েছে। 

এছাড়াও সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামান বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে ‘টাকাগুলো বিএনপির কালো তহবিল থেকে এসেছে’ শীর্ষক মন্তব্য করেছেন কিনা জানতে অনুসন্ধান করা হলে এমন তথ্যের সত্যতা পাওয়া যায়নি। 

সুতরাং, বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের বাসা থেকে নগদ ৬০ কোটি টাকা, স্বর্ণালংকার এবং বৈদেশিক মুদ্রা উদ্ধারের পাশাপাশি তাকে আটক করা হয়েছে দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

আরও পড়ুন

spot_img