প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত ২২ মে উপদেষ্টা পরিষদের নিয়মিত বৈঠকে তার পদত্যাগের ভাবনার কথা জানান। জানা যায়, এ সময় তিনি সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগে নানা প্রতিবন্ধকতার কথা বলেন। প্রায়ই সড়ক আটকে আন্দোলন, সংস্কারসহ বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর মধ্যে ঐকমত্য না হওয়া, রাষ্ট্রীয় কাজে নানা পক্ষের অসহযোগিতাসহ দেশের বিরাজমান পরিস্থিতিতে ক্ষোভ ও হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি। এরই প্রেক্ষিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ সর্বত্র এ বিষয়ে আলোচনা শুরু হয়। একইসাথে এই ইস্যুকে কেন্দ্র করে ভুয়া তথ্যের প্রবাহও লক্ষ্য করেছে রিউমর স্ক্যানার। ২২ থেকে ২৫ মে এই চারদিনে ড. ইউনূস পদত্যাগের গুঞ্জনকে ঘিরে অন্তত ১৬টি ভুয়া তথ্য শনাক্ত করে ফ্যাক্টচেক প্রকাশ করেছে রিউমর স্ক্যানার।
ড. ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন ইস্যুতে প্রকাশিত ফ্যাক্টচেকগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, এসব ভুয়া তথ্যের মধ্যে ড. ইউনূসকে আটটিতে, উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলকে একটিতে, উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদকে জড়ানো হয়েছে একটিতে। এছাড়া, জাতীয় নাগরিক পার্টির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলামকে জড়িয়ে একটি, দলটির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহকে জড়িয়ে দুইটি এবং একই দলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্য সচিব তাসনিম জারাকে জড়িয়ে একটি ভুল তথ্য প্রচার করা হয়েছে। আরেক রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমীর ডা. শফিকুর রহমানকে জড়ানো একটি ভুল তথ্যের প্রচারে। একই ইস্যুতে জড়িয়েছে সেনাবাহিনীর নামও। জড়ানো হয়েছে সশস্ত্র বাহিনীকেও। ছড়িয়েছে হাল আমলের প্রযুক্তির আধুনিক সংস্করণ ডিপফেক ভিডিও-ও।
ভুয়া এসব তথ্য বিশ্লেষণে রিউমর স্ক্যানার দেখেছে, ১৬টি ফ্যাক্টচেকের মধ্যে সাতটিই ছিল রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বক্তব্য সংক্রান্ত। এসবের মধ্যে কিছু বক্তব্য বিকৃত করে প্রচার করা হয়েছে। আবার এমন কিছু বক্তব্যও প্রচার করা হয়েছে যা তারা বলেননি। এসব ভুয়া বক্তব্য প্রচারে ব্যবহার হয়েছে গণমাধ্যমের ভুয়া ফটোকার্ড।
এর বাইরে পাঁচটি ঘটনায় পুরোনো ভিডিও ব্যবহার করে তা ড. ইউনূসের সাম্প্রতিক পদত্যাগ ইস্যুর প্রেক্ষাপটে প্রচার করতে দেখা গেছে। এর মধ্যে ড. ইউনূসের ভাষণ দেওয়ার একটি ভিডিও-ও ছিল যা কিনা দুই মাসের পুরোনো। উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুলের একটি ফেসবুক লাইভ প্রচার করে দাবি করা হচ্ছিল, প্রধান বিচারপতি পদত্যাগ করেছেন। অথচ, যাচাই করে দেখা গেল, এই ভিডিওটি গত বছরের ১০ আগস্টের। একইভাবে পুরোনো ভিডিও ব্যবহার করে অপপ্রচার চালানো হয়েছে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে নিয়েও। গত বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর টহল দেওয়ার ভিডিওকে ড. ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন ইস্যুতে ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ বাংলাদেশ সেনাবাহিনী নিয়েছে দাবিতে প্রচার করা হয়েছে। ড. ইউনূসের পদত্যাগের ঘোষণা দাবিতে একটি ডিপফেক ভিডিও-ও প্রচার হতে দেখেছে রিউমর স্ক্যানার।
রাজনৈতিক এসব ভুয়া তথ্যে নারী রাজনীতিবিদদের বিষয়ে আপত্তিকর শব্দের ব্যবহার যেমন দেখা গেছে, তেমনি অপতথ্যগুলোকে বিশ্বাসযোগ্য করে তুলতে গণমাধ্যমের ভুয়া এবং সম্পাদিত ফটোকার্ডের ব্যবহার ছিল লক্ষ্যণীয়। এই এক ইস্যুতেই গণমাধ্যমের নামে ভুয়া এবং সম্পাদিত ফটোকার্ডে অপতথ্য প্রচারের হার ছিল প্রায় ৫৬ শতাংশ। অপতথ্য ছড়াতে ব্যবহার হয়েছে কালের কণ্ঠ, বিবিসি বাংলা, যমুনা টিভি, সমকাল, যুগান্তর ও ফেস দ্যা পিপলের ভুয়া ও সম্পাদিত ফটোকার্ড।
ড. ইউনূসের পদত্যাগের গুঞ্জন ইস্যুতে প্রচার হওয়া ভুয়া তথ্যের কোনোটিতে দাবি করা হয়েছে, সাবেক সেনাপ্রধান ইকবাল করিম ভুঁইয়া ‘ড. ইউনুস দেশ ছাড়ার প্রস্তুতি নিয়ে সঠিক কাজটি করেছেন, সেনাশাসিত সরকারই বর্তমান বাংলাদেশকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করতে পারে, সেনা অভুত্থান এর জন্য সবাই তৈরী থাকুন।’ কোনোটিতে বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর লোগো সংবলিত কথিত প্রেস রিলিজ দাবি করে “বাংলাদেশ সেনা, নৌ ও বিমান বাহিনীর সৈনিক ও জুনিয়র অফিসারবৃন্দ” এর নামে প্রচার করা হচ্ছিল যে, “এই অযোগ্য সরকার দেশের নিরাপত্তার জন্য হুমকি। এই উপদেষ্টা পরিষদকে অবিলম্বে অপসারণ করে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের নিয়ে নতুন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের প্রয়োজনীয়তা আমরা অনুভব করছি।” আদতে এই প্রেস রিলিজটি ছিল ভুয়া।
ফ্যাক্টচেকগুলো দেখুন এখানে।
বার্তা প্রেরক
তানভীর মাহতাব আবীর
জ্যেষ্ঠ ফ্যাক্টচেকার,
রিউমর স্ক্যানার বাংলাদেশ।