প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ছয় দিনের সফরে গত ২৪ এপ্রিল থাইল্যান্ড গিয়েছেন। ২৯ এপ্রিল অর্থাৎ আগামীকাল পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করবেন। মূলত থাই প্রধানমন্ত্রী স্রেথা থাভিসিনের আমন্ত্রণে দেশটি সফরে গেলেও শেখ হাসিনা এই সফরে জাতিসংঘের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের অর্থনৈতিক ও সামাজিক কমিশনের (ইউএনএসকাপ) ৮০তম অধিবেশনে যোগ দেবেন। এই সফরকে কেন্দ্র করে গতকাল (২৭ এপ্রিল) SOMOY 63 নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দাবি করা হয়, থাইল্যান্ড সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হামলার শিকার হয়েছেন এবং তার গাড়িও ভাংচুর করা হয়েছে। এমনও দাবি করা হয়েছে যে পুলিশের সাথে বিএনপির সংঘর্ষ হয়েছে।
আমরা ০৮ মিনিট ৩৬ সেকেন্ডের পুরো ভিডিওটি (আর্কাইভ) পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, এখানে শুরুর দিকে সংবাদ পাঠক সদৃশ কন্ঠেও একই দাবি করতে দেখা যায়। সেসময় কিছু স্থিরচিত্র দেখানো হয়, এর মধ্যে একটি ছবি হচ্ছে ২০০৪ সালের ২১ আগস্টের গ্রেনেডে হামলার ঘটনার৷ সংবাদ পাঠকের এ সংক্রান্ত তথ্য উপস্থাপনের পর ০১ মিনিট ৩২ সেকেন্ড সময়ে এই সংক্রান্ত দাবির বিস্তারিত অংশ দেখার আহ্বান জানানো হয়। এরপর দাবিটির পক্ষে দুইটি ভিডিও দেখানো হয়েছে। শেষে আবার একজন উপস্থাপক সারমর্ম টেনে ভিডিও শেষ করেন।
ফ্যাক্টচেক
রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চলমান সফরে তার ওপর হামলার কোনো ঘটনা ঘটেনি বরং ২০২৩ সালের মে মাসে যুক্তরাষ্ট্রে প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় বিএনপির বিক্ষোভের পুরোনো ভিডিওর মাধ্যমে এই ভুয়া দাবি প্রচার করা হয়েছে।
রিউমর স্ক্যানার টিম এ বিষয়টি নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে ভিডিওর মূল দুইটি ফুটেজ খুঁজে বের করেছে। প্রথম ফুটেজটি (০১ মিনিট ৩৩ সেকেন্ড থেকে ০৬ মিনিট ১২ সেকেন্ড সময়) পাওয়া যায় ‘Probasi TV । আমেরিকার পথেপ্রান্তরে’ নামে একটি ফেসবুক পেজে। ২০২৩ সালের ০৩ মে বাংলাদেশ সময় মধ্যরাতের এই লাইভ ভিডিওটি ধারণ করা হয় যুক্তরাষ্ট্রের ভার্জিনিয়া স্টেটের টাইসনস কর্নার এলাকা থেকে। সেদিন (০২ মে) সেখানকার রিজ কার্লটন হোটেলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে প্রবাসী বাংলাদেশিদের পক্ষ থেকে সংবর্ধনা দেওয়া হয়। সেসময় হোটেলের বাইরে বিক্ষোভ করে বিএনপি সমর্থকরা। এই লাইভ ভিডিওটি সেসময়েরই। প্রায় ৪২ মিনিটের লাইভ ভিডিওটির বিভিন্ন অংশ কেটে প্রায় পাঁচ মিনিটের ফুটেজ ব্যবহার করা হয় আলোচিত ভিডিওটিতে।

লাইভ ভিডিওটির পুরো অংশ পর্যবেক্ষণ করে অবশ্য কোনো হামলা বা সংঘর্ষের ঘটনা লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি এই ভিডিওতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনারই উপস্থিতি ছিল না৷ আমরা সেসময়ের সংবাদগুলো পর্যালোচনা করে দেখেছি, এই বিক্ষোভের আগের দিনও বিএনপির কর্মসূচী ছিল। সেদিন আ.লীগ ও বিএনপির মধ্যে মারামারির ঘটনা ঘটে। তবে প্রধানমন্ত্রী হামলার শিকার হননি বা তার গাড়ি ভাঙচুর করার মতো কোনো ঘটনা ঘটেনি।
এদিকে আলোচিত ভিডিওতে থাকা পরবর্তী ফুটেজটির (০৬ মিনিট ১৩ সেকেন্ড থেকে ০৭ মিনিট ৪৫ সেকেন্ড) বিষয়ে অনুসন্ধানে একই ফেসবুক পেজেই (‘Probasi TV । আমেরিকার পথেপ্রান্তরে’) এটির মূল ভিডিও পাওয়া যায়। এখানে মূলত বিএনপির ঢাকা জেলার সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট নিপুণ রায় চৌধুরীকে বক্তব্য দিতে দেখা যায়। নিপুন রায় ২০২৩ সালের ২৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র সফরে যান। এটিও ০২ মে এর ভিডিও। ভার্জিনিয়ায় বিএনপির বিক্ষোভে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। সেখানেই বক্তব্য দেওয়ার ফুটেজ এটি।

এই ভিডিও পর্যবেক্ষণ করেও প্রধানমন্ত্রী হামলার শিকার হওয়া বা তার গাড়ি ভাঙচুর করার মতো কোনো ঘটনা লক্ষ্য করা যায়নি।
অর্থাৎ, প্রায় ১১ মাস পূর্বের ভিন্ন ঘটনার ভিডিও ব্যবহার করে থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হামলার শিকার হয়েছেন শীর্ষক গুজব প্রচার করা হয়েছে। তাছাড়া, প্রধানমন্ত্রীর চলমান থাইল্যান্ড সফরে সেখানে বিএনপির কোনো বিক্ষোভ বা মারামারির কোনো খবর গণমাধ্যমে পাওয়া যায়নি।
‘সময় সিক্সটি থ্রি’ নামে আলোচিত চ্যানেলটি পর্যবেক্ষণ করে দেখা যায়, প্রায় ২ লাখ ৩৩ হাজার সাবস্ক্রাইবার সমৃদ্ধ এই চ্যানেলটি চালু করা হয় ২০২২ সালের ১১ অক্টোবর। দেখা গেছে, নিয়মিতই বিভিন্ন চটকদার থাম্বনেইল, টাইটেল ও ক্যাপশনের মাধ্যমে পুরোনো ও ভিন্ন ঘটনার ভিডিওকে চ্যানেলটি সাম্প্রতিক বিভিন্ন ঘটনার সাথে জড়িয়ে ভুল তথ্য প্রচার করে আসছে। মানুষ নিয়মিতই যে সেসব দেখছে তার প্রমাণ পাওয়া যায় ভিডিওগুলোর ভিউ দেখেই এবং এর ফলে ভুল তথ্যে প্রভাবিত হচ্ছে। তবে থাম্বনেইল বা ভিডিওর ভেতরে থাকা ছবিগুলো যে অনেক সময় প্রতীকী অর্থেও প্রকাশ করা হয় তা প্রতিটি ভিডিওর বিস্তারিত অংশে উল্লেখ করা হয়েছে। এমনকি থাম্বনেইলের ছবি ও টাইটেল দেখে কাউকে বিভ্রান্ত না হওয়ারও আহ্বান জানানো হয়েছে।

ভিডিওগুলোতে এক ব্যক্তিকে উপস্থাপনা করতে দেখা যায়। তার নাম পিয়াস মাহমুদ। কপিরাইটসহ যে কোনো অভিযোগ এবং বিজ্ঞাপনের জন্য চ্যানেলটির পক্ষ থেকে যোগাযোগ করতে [email protected] নামে একটি ইমেইল ঠিকানাও দেওয়া হয়েছে।

মূলত, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত ২৪ এপ্রিল থাইল্যান্ড গিয়েছেন। ২৯ এপ্রিল পর্যন্ত তিনি সেখানে অবস্থান করবেন। এই সফরকে কেন্দ্র করে গতকাল (২৭ এপ্রিল) SOMOY 63 নামের একটি ইউটিউব চ্যানেল থেকে প্রকাশিত এক ভিডিওতে দাবি করা হয়, থাইল্যান্ড সফরে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হামলার শিকার হয়েছেন এবং তার গাড়িও ভাংচুর করা হয়েছে। এমনও দাবি করা হয়েছে যে পুলিশের সাথে বিএনপির সংঘর্ষ হয়েছে। কিন্তু রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে জানা যায়, থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রীর চলমান সফরে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি। প্রকৃতপক্ষে, ২০২৩ সালের মে মাসে প্রধানমন্ত্রীর যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় কয়েক দফায় বিক্ষোভ করে বিএনপি। সে সময়ের দুইটি ভিডিও ফুটেজ ব্যবহার করে ভুয়া এই দাবি প্রচার করা হয়েছে।
সুতরাং, ২০২৩ সালের ভিন্ন ঘটনার ভিডিও ব্যবহার করে সম্প্রতি থাইল্যান্ডে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা হামলার শিকার হয়েছেন শীর্ষক একটি দাবি ইউটিউবে প্রচার করা হয়েছে; যা সম্পূর্ণ মিথ্যা।
তথ্যসূত্র
- Probasi TV । আমেরিকার পথেপ্রান্তরে: Facebook Post 1
- Probasi TV । আমেরিকার পথেপ্রান্তরে: Facebook Post 2
- Rumor Scanner’s own investigation