বৃহস্পতিবার, অক্টোবর 3, 2024
spot_img

ভারতীয় নারীর সাপের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার ভাইরাল দাবিটি ভুয়া

সম্প্রতি, ‘ভারতে মহিলার পেটে সাপের বাচ্চা’ শীর্ষক দাবিতে একটি ভিডিও বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচার করা হচ্ছে। 

ফেসবুকে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

বাংলাদেশের আলোচিত ইসলামি বক্তা গিয়াসউদ্দিন তাহেরির ফেসবুকে প্রচারিত এই সম্পর্কিত ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ)। 

ইউটিউবে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও দেখুন এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

টিকটকে প্রচারিত এমন কিছু ভিডিও এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ), এখানে (আর্কাইভ)।

ফ্যাক্টচেক

রিউমর স্ক্যানার টিমের অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভারতে এক নারীর সাপের বাচ্চা জন্মদানের দাবিতে প্রচারিত তথ্যটি ভিত্তিহীন। প্রকৃতপক্ষে ভারতে এমন কোনো ঘটনাই ঘটেনি বরং বিভিন্ন সময়ে ধারণকৃত একাধিক ভিন্ন ভিন্ন ভিডিও ক্লিপ যুক্ত করে উক্ত দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে।

ভারতে কি এমন কোনো ঘটনা ঘটেছে?

দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম প্রথমেই তথ্যের সূত্র খুঁজতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওগুলো নিয়ে বিশ্লেষণ করে। বিশ্লেষণে দেখা যায়, এই ভিডিওগুলোতে কেউ সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্য উপস্থাপন করতে পারেননি। বরং দেখা যায়, কেউ কেউ দাবি করছেন, উক্ত ঘটনাটি ভারতের ব্যাঙ্গালোরের, কেউ দাবি করছেন ঘটনাটি ঝাড়খণ্ডের, আবার কারো দাবি , এটি মুম্বাই শহরের ঘটনা। 

Image Collage: Rumor Scanner 

ভিডিওগুলো বিশ্লেষণে কোনো তথ্যসূত্র খুঁজে না পাওয়ায় পরবর্তীতে রিউমর স্ক্যানার টিম প্রাসঙ্গিক বিভিন্ন কি-ওয়ার্ড ধরে গণমাধ্যমে অনুসন্ধান করে। কিন্তু ভারতের নির্ভরযোগ্য কোনো গণমাধ্যমেও দেশটিতে এমন কোনো ঘটনার বিষয়ে কোনো তথ্য খুঁজে পায়নি।

স্বাভাবিকভাবেই ভারতে এমন কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা ঘটলে সেটা ভারতীয় গণমাধ্যমসহ আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রচারিত হওয়াটা অনুমেয়। অর্থাৎ পুরো দাবিটিই কোনো সুনির্দিষ্ট তথ্যসূত্র ছাড়া বিভিন্ন এলাকার নাম উল্লেখ করে প্রচার করা হচ্ছে।

এছাড়া রিউমর স্ক্যানার টিম দাবিটির সত্যতা যাচাইয়ে ভারতীয় গণমাধ্যম The Indian Express এর ফ্যাক্টচেকার অংকিতা দেশকরের সঙ্গে যোগাযোগ করে। তিনি রিউমর স্ক্যানারকে জানান, ‘কোনো বিশ্বস্ত গণমাধ্যম সূত্রে ভারতে এমন কোনো ঘটনার বিষয় সম্পর্কে তথ্য পাইনি।’

ভিডিওতে দৃশ্যমান নারী ও চিকিৎসকদের পরিচয় সম্পর্কে যা জানা যাচ্ছে 

ভারতে মহিলার পেট থেকে সাপের বাচ্চা পাওয়ার দাবিতে প্রচারিত ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, উক্ত দাবিতে ভারতের হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের ভিডিও দাবির ফুটেজটি আরও আগে থেকেই ইন্টারনেটে বিদ্যমান।

এ নিয়ে অনুসন্ধানে ভিডিও শেয়ারিং প্লাটফর্ম টিকটকে চলতি বছরের গত ২০ এপ্রিল Ehtishad (আর্কাইভ) নামের একটি অ্যাকাউন্টে ভারতের হাসপাতালের অস্ত্রোপচার কক্ষের ভিডিও ফুটেজ দাবিতে প্রচারিত ভিডিওটি খুঁজে পাওয়া যায়। 

Image Collage: Rumor Scanner

এটি ছাড়াও ভিডিওটিতে থাকা আরেকটি ফুটেজ নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, মুখ থেকে সাপ বের করার ভিডিওটি মূলত রাশিয়ার দাগেস্তানের ২০২০ সালের একটি ঘটনা। 

Image Collage: Rumor Scanner 

মূলত, সাপটি ঐ নারীর ঘুমন্ত অবস্থায় তার মুখের ভিতর ঢুকে গিয়েছিল। যা পরবর্তীতে অপারেশনের মাধ্যমে বের করা হয় এবং এটি ভিডিও ধারণ করা হয়। 

পাশাপাশি ভিডিওটিতে যে মহিলাটি দেখা যাচ্ছে, তার পরিচয় জানার জন্য অনুসন্ধান চালালেও কোনো ফল পাওয়া যায়নি। বরং উক্ত দাবিতে প্রচারিত ভিডিওগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, একেক ভিডিওটিতে একেক নারীর ছবি ব্যবহার করা হয়েছে। 

Image Collage: Rumor Scanner

অর্থাৎ ইন্টারনেট থেকে বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ফুটেজ সংগ্রহ করে একসাথে যুক্ত করে আলোচিত দাবিতে প্রচার করা হচ্ছে। 

সাপ-মানুষের জৈবিক বৈশিষ্ট্য  

আলোচিত দাবিটির সত্যতা বিশ্লেষণের এই পর্যায়ে জেনে নেওয়া যাক মানুষ ও সাপের জৈবিক বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে। 

মানুষ স্তন্যপায়ী প্রাণী, যারা সন্তান প্রসব করে। অপরদিকে সাপ হল সরীসৃপ, যারা বেশিরভাগ ডিম পাড়ে। মানুষ ও সাপের জিনগত বৈশিষ্ট্য, শারীরবৃত্তীয় কাঠামো এবং প্রজনন প্রক্রিয়া মৌলিকভাবেই আলাদা। 

এই জৈবিক কারণগুলো ছাড়াও এখন পর্যন্ত এমন কোনো ঘটনার সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি, যেখানে কোনো মানব মহিলা কখনো সাপ বা অন্য প্রজাতির জন্ম দিয়েছে। ইন্টারনেটে ইতোপূর্বে এমন দাবিতে যা প্রচার হয়েছে, সেগুলো গুজব বলেই প্রমাণিত হয়েছে। 

পূর্বেও এমন ভিত্তিহীন দাবি ছড়ানোর রেকর্ড 

সাপ-মানুষের জৈবিক বৈশিষ্ট্য নিয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে রিউমর স্ক্যানার টিম ইন্টারনেটে বিভিন্ন সময়ে আলোচিত দাবিটির ন্যায় প্রচারিত একাধিক ঘটনা খুঁজে পায়৷ 

যেমন, ২০১২ সালে ভারতেই মহারাষ্ট্র রাজ্যের যায়াভাতমাল জেলায় এক নারী কর্তৃক সাপ সদৃশ শরীর নিয়ে ‘অলৌকিক শিশু’ জন্মের একটি ঘটনার ভিডিও ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছিল। 

Screenshot: Times of India 

তবে পরবর্তীতে পুরো বিষয়টিই গুজব হিসেবে প্রমাণিত হয় এবং এই ধরনের কোনো ঘটনার অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি।

এমন আরেকটি ঘটনার সন্ধান পাওয়া যায় ২০১৪ সালে ইন্দোনেশিয়ায়। সে সময় ইন্দোনেশিয়ার প্রত্যন্ত ওয়েনান্টু গ্রামে এক গর্ভবতী নারীর গিরগিটি জাতীয় সরীসৃপ জন্ম দেওয়ার একটি ঘটনা ইন্টারনেটে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার পর স্থানীয়রা ঐ নারীর উপর উত্তেজিত হয়ে উঠে এবং তাকে প্রকাশ্যে হত্যা করতে চায়। তবে পরবর্তীতে দেশটির কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপে জানা যায়, এটি পুরোপুরি একটি ভুয়া খবর ছিল। 

Screenshot: IBT

এছাড়াও আমেরিকান ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠান Snopes ২০১৭ সালে ‘Does This X-Ray Show a Snake Inside a Woman’s Body?‘ শীর্ষক শিরোনামে প্রকাশিত একটি ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, বিভিন্ন ঘটনা যুক্ত করে নারীর পেটে এক্সরের সময় সাপ দেখা গিয়েছে এমন একটি দাবি সম্বলিত ছবি প্রচার হয়েছিল। তবে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ঐ ভাইরাল ছবিটি আসলে একটি ডিজিটাল আর্টওয়ার্ক ছিল।

Screenshot: Snopes 

উল্লেখ্য, সম্প্রতি ভারতে নারী কর্তৃক সাপ জন্ম দেওয়ার ঘটনায় ভারতীয় গণমাধ্যমে এ সংক্রান্ত কোনো প্রতিবেদন না পাওয়ার বিপরীতে দেশটির একাধিক ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানের ফ্যাক্টচেক প্রতিবেদন খুঁজে পাওয়া যায়। এই প্রতিবেদনগুলোতে ফ্যাক্টচেকিং প্রতিষ্ঠানগুলো পুরো বিষয়টিকেই গুজব হিসেবে উল্লেখ করেছে। 

এমন কিছু প্রতিবেদন দেখুন 

মূলত, সম্প্রতি ভারতে এক নারীর সাপের বাচ্চা জন্ম দেওয়ার একটি ভিডিও ইন্টারনেটে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এ নিয়ে অনুসন্ধানে দেখা যায়, ভিডিওটিতে উক্ত ঘটনাটির বিষয়ে সুনির্দিষ্ট কোনো তথ্যসূত্র নেই বরং একেকজন এই ঘটনাটির বিষয়ে একেকরকম তথ্য উপস্থাপন করছে। এছাড়া আলোচিত ঘটনাটি নিয়ে যে ভিডিওটি প্রচার করা হচ্ছে, সেটিও ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত বিভিন্ন ঘটনার পুরানো ফুটেজ ও সূত্রহীন ছবি ব্যবহার করে প্রচার করা হচ্ছে। পাশাপাশি মানুষ ও সাপের জীনগত বৈশিষ্ট্য ও শারিরীক বিন্যাসও সম্পূর্ণ আলাদা হওয়ায় বৈজ্ঞানিকভাবেও এমন কোনো ঘটনা ঘটার সম্ভাবনা নেই।

সুতরাং, ভারতে এক নারী কর্তৃক সাপের বাচ্চা জন্মদানের দাবিতে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রচারিত ভিডিওটি সম্পূর্ণ বানোয়াট এবং আলোচিত দাবিটিও সম্পূর্ণ মিথ্যা।

তথ্যসূত্র

RS Team
Rumor Scanner Fact-Check Team
- Advertisment -spot_img
spot_img
spot_img